আত্মত্যাগের স্বর্ণোজ্জ্বল পদচিহ্ন নান্দনিক নির্মাণশৈলীর ‘শহিদ আহনাফ মেমোরিয়াল’
প্রকাশিতঃ 9:38 pm | September 29, 2024
এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, অ্যাকটিং এডিটর:
ছাত্র-জনতার রক্তঝরা গণঅভ্যুত্থানের সফল সমাপ্তি দেখা হয়ে ওঠেনি বুলেটবিদ্ধ শহীদ শাফিক উদ্দিন আহম্মেদ আহনাফের। বিজয়ে উদিত সূর্যের কয়েক ঘণ্টা আগে চিরতরে নিভে যায় তাঁর জীবন বাতি। রাজধানীর বিএএফ শাহীন কলেজের মেধাবী ছাত্র ১৭ বছর বয়সী এই তরুণের তারুণ্যে পদার্পণ করার স্বর্ণালি সময়টা আস্বাদন করা হয়নি মোটেও। কিন্তু তাকে ভুলেনি রক্তের দামে কেনা দ্বিতীয় স্বাধীনতা উদযাপন করা বাংলাদেশ। তাঁর স্বপ্ন, দর্শন, আত্মত্যাগকে চির অম্লান করে রাখতে তাঁর স্মৃতিঘেরা কলেজ প্রাঙ্গণে নির্মিত হয়েছে- ‘শহিদ আহনাফ মেমোরিয়াল’।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহিদ হওয়ার আগে আহনাফ প্রায় সময়েই পরিবারকে বলতো সে এমন কিছু করবে যেন সবাই তাকে নিয়ে গর্ব করে। তাকে নিয়ে এখন সত্যিই গর্বিত পরিবারের সদস্যরা! তবে তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এভাবে গর্বিত হতে চাননি তাঁরা। তবুও নিজের আত্মজের জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষের এমন সম্মান স্বভাবতই আপ্লুত করেছে বাবা নাসির উদ্দিন আহমেদ ও মা সাফাত সিদ্দিকীকে।
রবিবার (২৯ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর বিএএফ শাহীন কলেজে শহিদ শাফিক উদ্দিন আহম্মেদ আহনাফের স্বদেশের রূপান্তরে তুমুল সাহসিকতা, অশ্রু আর রক্তভেজা অমিত গৌরবের অধ্যায়কে চির জাগরূক করে রাখতে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চীফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন যখন ‘শহিদ আহনাফ মেমোরিয়াল’ উদ্বোধন করছিলেন ঠিক সেই মুহুর্তটিতে সম্ভবত তাঁর বাবা-মা’র হৃদয়ের অলিন্দে হাহাকার করে ওঠে বৈষম্যবিহীন রাষ্ট্র বিনির্মাণে পথপ্রদর্শক সন্তানের মায়াবি স্মৃতির মোহনা।
বাংলাদেশ বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চীফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন বলেন, ‘শহিদ আহনাফ আহম্মেদ একজন অকুতোভয় বীর। ছাত্র আন্দোলনে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে সে অন্যদের ন্যায় নেমে আসে রাজপথে এবং করে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ। ভবিষ্যতে তার এই আত্মত্যাগ সকল শিক্ষার্থীদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার প্রেরণা যোগাবে।’
জানা যায়, শহিদ আহনাফের অমর কীর্তির বহুমাত্রিক মূল্যায়নের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করে বিএএফ শাহীন কলেজ পরিচালনা পর্ষদ। কলেজ প্রাঙ্গণে নির্মিত হয়েছে নান্দনিক নির্মাণশৈলীর ‘শহিদ আহনাফ মেমোরিয়াল’। দেশপ্রেমের দৃপ্ত অঙ্গীকারে স্বর্ণোজ্জ্বল পদচিহ্ন আঁকা আহনাফের স্মৃতির চিরন্তন দ্যুতি ছড়ানো আত্মোপলব্ধির, আত্মজাগরণের—মধ্যাহ্ন সূর্যের মতো মানস পরিবেশকে বিমুক্ত করে ‘না ভোলা বাণীর ঘন যামিনীর মাঝে’ এর মতোই অরুণরাঙা সুপ্রভাতের মতোই বিএএফ শাহীন কলেজ কর্তৃপক্ষ আহনাফের মৃত্যু দিবসকে ‘আহনাফ দিবস’ হিসেবে প্রতি বছর কলেজে উদযাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।
শুধু তাই নয়, ছোট ভাই ইফতেখার উদ্দিন আহমেদ’র মাঝেই যেন সবাই খুঁজে ফিরেন ছাত্র-জনতার রক্তস্নাত অভ্যুত্থানে প্রাণ হারানো অকুতোভয় আহনাফকে। মানবিকতার অতলান্তিক গভীরতায় তাঁর ছোট ভাইকে বিএএফ শাহীন কলেজে বিনা বেতনে পড়াশুনার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ইফতেখার উদ্দিন আহমেদকে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে কলেজ পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি, বিমান বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা, শহিদ আহনাফের বাবা-মা, ছোট ভাই এবং শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন।
জুলাইয়ে জোয়ার ওঠা শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন একপর্যায়ে পরিণত হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে। শত শত প্রাণের বিনিময়ে আন্দোলন বিজয়ের বরমাল্য নিয়ে আসে। এই আন্দোলনে সোচ্চার থেকে গত ৪ আগস্ট রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বরে বুলেট ঝাঁঝরা করে দেয় কিশোর আহনাফের স্বপ্নভরা বুক। বুক তাঁর যেন বাংলাদেশের হৃদয়! ২০২৫ সালে তাঁর এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। আন্দোলন শেষে রাজধানীর বিএফ শাহীন কলেজে আহনাফের সকল সহপাঠী ক্লাসে-পরীক্ষার টেবিলে ফিরলেও ফেরেনি আন্দোলনে বুলেটবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারানো আহনাফ। তাঁর টেবিলটা আজও ফাঁকা। ‘তারে স্মরণ করে কিছুদিন আগে সবাই সাজায় ফুলের ডালা’। এই হৃদয়ের মালায় সবাই গেঁথে রেখেছে অদম্য আহনাফের নাম।
কালের আলো/এমএএএমকে