আইন সবার জন্য সমান?
প্রকাশিতঃ 3:57 pm | February 12, 2018
প্রভাষ আমিন:
দুর্নীতির মামলায় ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের রায় মাথায় নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন ও তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এখন নাজিম উদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি জীবনযাপন করছেন। কারাগার শব্দটি এলেই আমরা নির্জন শব্দটি ব্যবহার করি। যদিও এমনিতে কারাগার অত নির্জন হয় না। তবে নাজিম উদ্দিন রোডের কারগারটি সত্যি নির্জন। কারণ, বেগম খালেদা জিয়া এখন এই কারাগারের একমাত্র বন্দি এবং সম্ভবত শেষ বন্দি। বেগম খালেদা জিয়া কারাগারের কোথায় আছেন, কেমন আছেন, তার সঙ্গে কে আছে, তিনি কী খাচ্ছেন, কোন টেলিভিশন দেখছেন, কোন পত্রিকা পড়ছেন- ইত্যাদি নানান কৌতূহল মানুষের মনে। প্রাথমিকভাবে আদালত থেকে ডিভিশনের কোনও আদেশ না থাকায় তাকে সাধারণ বন্দি হিসেবে রাখা হয়। আইজি প্রিজন সৈয়দ ইফতেখারউদ্দিন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, অন্তত সাংসদ না হলে কারাগারে কেউ ডিভিশন পান না। সাবেক রাষ্ট্রপতি পেলেও সাবেক প্রধানমন্ত্রী পান না। তবে শনিবার আদালত বেগম জিয়াকে ডিভিশন দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আনুষ্ঠানিকভাবে ডিভিশন দেওয়া না হলেও কারা কর্তৃপক্ষ সামাজিক মর্যাদা বিবেচনায় বেগম খালেদা জিয়াকে বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে। তবে যত বাড়তি সুবিধা বা ডিভিশনই দেওয়া হোক না কেন, সারা জীবন আয়েশী জীবনযাপন করে আসা বেগম খালেদা জিয়ার জন্য নাজিম উদ্দিন রোডের শত বছরের পুরনো ভবনে থাকাটা অবশ্যই বিশাল শাস্তির।
বেগম খালেদা জিয়াসহ এই মামলার অন্য সব আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে বলেই আদালত তাদের সবাইকে দণ্ড দিয়েছেন। অন্য সবার ১০ বছরের কারাদণ্ড হলেও বয়স, সামাজিক মর্যাদা বিবেচনায় বেগম খালেদা জিয়ার ৫ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। একই সঙ্গে সবার ২ কোটি ১০ লাখ টাকা জরিমানা হয়েছে। বিএনপি সমর্থকরা বলছেন, এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা। খালেদা জিয়াকে নির্বাচন থেকে, রাজনীতি থেকে মাইনাস করার জন্যই এ রায় দেওয়া হয়েছে। তবে মামলাটি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে করা নয়। ওয়ান-ইলাভেন সরকারের সময়ে দায়ের করা মামলায় রায় হয়েছে ১০ বছর পরে। তাই এ রায়কে তাড়াহুড়ো করে দেওয়া বলা যাবে না। বিএনপির আইনজীবীরা আদালতে বলেছেন, বিদেশ থেকে আসা টাকা ব্যয় হয়নি। তাই একে আত্মসাৎ বা তহবিল তছরুপ বলা যাবে না। তাদের এ অভিযোগ দৃশ্যত সত্যি। কারণ, এতিমদের জন্য আসা টাকা ব্যয় হয়নি। বরং ব্যাংকে থাকা টাকা সুদে আসলে আরো বেড়েছে। সৌদি আরব থেকে এতিমদের জন্য আসা টাকা এতিমদের জন্য ব্যয় হয়নি, এতিমখানাও নির্মাণ হয়নি। নির্দিষ্ট কারণে আসা টাকা ব্যয় করতে না পারা অদক্ষতা বা অযোগ্যতা হতে পারে, কিন্তু অপরাধ হবে কীভাবে? বেগম খালেদা জিয়াসহ অন্যদের সাজা দেওয়া হয়েছে এতিমদের তহবিল বেআইনি ব্যবহারের অভিযোগে। এতিমদের জন্য টাকা এসেছিল প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিলে। সে টাকা ‘জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট’ গঠন করে সেখানে স্থানান্তর করা হয়েছে। পরে সেখান থেকেও টাকা ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করে এফডিআর করা হয়েছে। অপরাধটা আত্মসাতের নয়, বেআইনি ব্যবহারের। অনেকে বলছেন, মাত্র ২ কোটি টাকা বেআইনি ব্যবহারের দায়ে তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে ৫ বছরের কারাদণ্ড লঘুপাপে গুরুদণ্ড। রায়ের পরদিন একটি দৈনিকের শিরোনাম নিয়েও অনেক আলোচনা হয়েছে। শিরোনামটি ছিল ‘দুই কোটি টাকা দুর্নীতির দায়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ৫ বছর জেল’। অনেকে এই শিরোনামের শুরুতে একটা অদৃশ্য ‘মাত্র’ শব্দ দেখতে পাচ্ছেন। যেন দুই কোটি টাকার দুর্নীতির মামলায় ৫ বছরের সাজা অনেক বেশি। পাপটা লঘু না গুরু, দণ্ডটা লঘু না গুরু; সে বিবেচনা করবেন আদালত। বেগম খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবেন। সেখানে নিশ্চয়ই মামলার চুলচেরা বিশ্লেষণ হবে। হাইকোর্টে রায় বদলেও যেতে পারে। তবে টাকার অঙ্ক ২ কোটি টাকা না ২ হাজার কোটি টাকা, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। প্রশ্নটা হলো নৈতিকতার। আর অভিযোগটা যখন একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে, তখন সেটা অবশ্যই গুরুতর। ২ কোটি ১০ লাখ টাকা বেগম খালেদা জিয়া ব্যক্তিগত কাজে খরচ করেছেন, ব্যাপারটা কিন্তু এমন নয়। কিন্তু টাকাটা নয়ছয় হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর তখনকার বাসভবনের ঠিকানা ব্যবহার করে এবং তার জ্ঞাতসারে। প্রধানমন্ত্রীর শপথ নেওয়া যে কাউকে সবকিছুতে স্বচ্ছ থাকতে হয়। এখানে যে কোনও ব্যত্যয়ই অপরাধ। হয়তো বেগম খালেদা জিয়া পুত্র তারেক রহমান এবং অন্য স্বজনদের প্ররোচনায় এ বেআইনি ব্যবহারে সায় দিয়েছেন। কিন্তু দায় তাকে নিতে হবে এবং নিচ্ছেনও।
অনেকে এমনও বলছেন, দুই কোটি টাকা বেআইনি ব্যবহারের দায়ে বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে আর হাজার কোটি টাকা লোপাট করে অনেকে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এটা অবশ্যই একটা যৌক্তিক প্রশ্ন। ২ টাকা লোপাট করলেও যেমন অপরাধ, ২ কোটি টাকা লোপাট করলেও অপরাধ, ২ হাজার কোটি টাকা লোপাট করলেও সেটা অপরাধ। সেটা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী করলেও অপরাধ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী করলেও অপরাধ। বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রায়ের মাধ্যমে একটা বিষয় প্রতিষ্ঠিত হলো, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। অপরাধ করলে সবাইকে সাজা পেতে হবে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় দুর্নীতি দমন কমিশন পক্ষে রায় পেয়েছে। এর মাধ্যমে দুদকের দায়িত্ব আরো বেড়ে গেলো। দুদককে যে সরকারি দলের নেতাদের ‘দুর্নীতিমুক্ত’ সার্টিফিকেট দেওয়ার প্রতিষ্ঠান বা নখদন্তহীন বাঘ বলা হয়; তাদের এখন সেই দায় মোচনের পালা। তাদের মামলাগুলো দল নির্বিশেষে দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করতে হবে। আর দুর্নীতির যে অভিযোগগুলো দৃশ্যমান, সেগুলোর ব্যাপারেও দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। সোনালী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, ফারমার্স ব্যাংক লুটের জন্য দায়ী করা? শেয়ারবাজারে বারবার লুটের জন্য কারা দায়ী? বাংলাদেশ থেকে কারা হাজার কোটি টাকা পাচার করছে? দুদক কেন তাদের ধরছে না। অনুমতি পাওয়ার অল্প কদিনের মধ্যেই ফারমার্স ব্যাংককে ধসিয়ে দিয়ে পদত্যাগ করে দায় এড়াতে চাইছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড.মহীউদ্দীন খান আলমগীর। কিন্তু একটি ব্যাংক ধসিয়ে দেওয়ার শাস্তি পদত্যাগ নয়। অবশ্যই এর শাস্তি হতে হবে। দৃশ্যমান বড় বড় কেলেঙ্কারির জন্য কারা দায়ী, তা খুঁজে বের করতে হবে।
ব্যাপারটা তো এমন নয়, বিএনপি ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার পর তাদের আমলের দুর্নীতির বিচার হবে বা আওয়ামী লীগ আমলের দুর্নীতির বিচারের জন্য তাদের ক্ষমতাচ্যুত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। দেশে আইনের শাসন থাকলে, সুশাসন থাকলে সব দুর্নীতির বিচার হবে। যখন যে দুর্নীতি করবে, তখনই তার বিচার হবে। কে কোন দল করে, কে কতটা ক্ষমতাশালী; সেটা নিশ্চয়ই দুদকের বিবেচ্য হওয়ার কথা নয়, উচিত নয়। অপরাধ করলে সাজা পেতে হয়, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়, আইনের চোখে সবাই সমান; বেগম খালেদা জিয়ার সাজার মাধ্যমে এই বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখন এই ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। দলমত নির্বিশেষে এমন আরও দুর্নীতির সাজা হলেই আমরা বিশ্বাস করবো, বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে দেওয়া রায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ