পিছিয়ে পড়া নারীদের অনুপ্রেরণা গৃহিণী থেকে ইউপি চেয়ারম্যান হয়ে ওঠা রুমকী
প্রকাশিতঃ 6:06 pm | March 21, 2024
কালের আলো প্রতিবেদক:
বিশ্বের কাছে এক সময় রক্তাক্ত জনপদ হিসেবে পরিচিত ছিলো জেলার রাণীনগর ও আত্রাই উপজেলা। সেই জনপদের পিছিয়ে পড়া নারীদের কাছে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণার নাম হচ্ছে ১নং খট্টেশ্বর রাণীনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোছা. চন্দনা সারমিন রুমকি। তিনিই প্রথম নারী চেয়ারম্যান হিসেবে রাণীনগর উপজেলার ইতিহাসে নিজের নাম লিখিয়েছেন।
১৯৮২ সালের ৩১ ডিসেম্বর উপজেলার লোহাচুড়া গ্রামে একটি সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন চন্দনা শারমিন রুমকী। তার পিতার নাম গোলাম হোসেন আকন্দ এবং মা নিলুফা সুলতানা। লাজুক ও শান্তশিষ্ট স্বভাবের রুমকী কৈশোরের সংজ্ঞা বুঝে ওঠার আগেই ১৯৯৭ সালে সংসার জীবনে পা রাখেন। আর ৩৫ বছর বয়সে স্বামীকে হারানোর পর শুরু হয় তার নতুন যুদ্ধ। রুমকীর বড় মেয়ে অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন, আর ছোট মেয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
রুমকীর স্বামী গোলাম মোস্তফা ছিলেন উপজেলা যুবলীগের সভাপতি। স্বপ্ন দেখেছিলেন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে রাণীনগর ইউনিয়নকে মডেল পরিষদ হিসেবে গড়ে তোলার। ২০১৯ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান মোস্তফা। স্বামীকে হারিয়ে সংসার সামলিয়ে উঠতে একপ্রকার লড়াই করেন রুমকী। কিন্তু স্বামীর সেই স্বপ্নকে মিলিয়ে যেতে দেননি তিনি। সব চড়াইউতড়াই পেরিয়ে রাণীনগরের ইউপি চেয়ারম্যান হয়েছেন নির্বাচিত হয়েছেন। আর এই কাজে তার পাশে দাঁড়ান স্বামীর বড় ভাই ও স্থানীয় সংসদ সদস্য (এমপি) মো. আনোয়ার হোসেন হেলাল।
চন্দনা শারমিন রুমকী বলেন, আমার স্বামী গোলাম মোস্তফা উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ছিলেন। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হয়ে জনগণের সেবা করবেন এবং সদর ইউনিয়নকে একটি মডেল পরিষদ হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই স্বপ্ন তার পূরণ হয়নি। ২০১৯ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর অপরাজিতা সদস্য হলেও রাজনৈতিক চাপে অনিয়মিত হয়ে পড়ি। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ২০২০ সালে তৎকালীন এমপি ইসরাফিল আলমের মৃত্যু হয়। এরপর উপনির্বাচনে নতুন এমপি নির্বাচিত হন আমার স্বামীর বড় ভাই মো. আনোয়ার হোসেন হেলাল। বদলে যায় রাজনৈতিক দৃশ্যপট। আবার অপরাজিতা সভায় নিয়মিত হতে থাকি। অপরাজিতার প্রকল্প চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করার আশা দেখায়। এ বিষয়ে এমপির সঙ্গে পরামর্শের করলে তিনি অপরাজিতা কর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করেন। এছাড়া জনসংযোগ করার জন্য অপরাজিতা প্রকল্পের সকল অনুষ্ঠানে আমাকে সম্পৃক্ত করার পরামর্শ দেন।
২০২২ সালে ইউপি নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন রুমকী। নির্বাচনের দুই মাস পরে উপজেলা নারী উন্নয়ন ফোরামের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। এরপর ইউনিয়নের সকল স্থায়ী কমিটি পুনর্গঠন করেছেন এবং অপরাজিতা সদস্যদের স্থায়ী কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
রুমকী চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে হাত বাড়িয়েছেন সমাজের পিছিয়ে পড়া নারীদের উন্নয়নে। এক্ষেত্রেও সফল হবেন বলেই বিশ্বাস করেন তিনি। সমাজের নির্যাতিত ও পিছিয়ে পড়া নারীদের নেতৃত্ব বিকাশের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্তর স্থাপন করতে চান রুমকী। তিনি বলেন, ‘এ কাজ করতে গিয়ে একসময় মানুষের অনেক গালমন্দ সহ্য করতে হয়েছে। মানুষের সকল সমালোচনাকে পেছনে ফেলে পরিবার ও ইউনিয়নবাসীর সহযোগিতায় স্বামীর স্বপ্ন পূরণে কাজ করতে পারায় নিজেকে সফল মনে করি।’
ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেতে অপরাজিতা প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে বলে জানান রুমকী। তিনি আরও বলেন, ‘আমার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে অপরাজিতা প্রকল্প উৎসাহ, সাহস, তথ্য সহায়তা ও মনোনয়ন পাওয়াসহ সকল ক্ষেত্রে ব্যাপক সহায়তা করেছে। অপরাজিতা প্রকল্পের স্বপ্নই চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পাথেয় হিসেবে কাজ করেছে। অপরাজিতা প্রকল্পের সংস্পর্শে এসে পাওয়া জ্ঞান-দক্ষতাকে পুঁজি করে পিছিয়ে পড়া নারীদের উন্নয়নে কাজ করছি। ইতোমধ্যে স্থানীয় এমপির সহযোগিতায় ইউনিয়নের প্রায় ৩টি ব্যাচে ৬০ জন নারীকে সেলাই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত নারীরা এই শিক্ষাকে পুঁজি করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করছেন।’
প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা মানুষের দ্বারে দ্বারে ছুটে চলেছেন চন্দনা সারমিন রুমকী। খোঁজ নেন এলাকার মানুষের। যার কারণে সকলে তাকে ভালোবেসে ডাকেন ‘রুমকী আপা’। রুমকী স্বপ্ন দেখেন এক বৈষম্যহীন সমতাভিত্তিক সমাজের , যেখানে নারী-পুরুষ সমান বিকাশের সুযোগ পাবে। সে লক্ষ্যেই কাজ করে যেতে চান তিনি।
কালের আলো/বিএস/এমএম