সংসদে নিজের শেষ ভাষণে সংঘাত ভুলে আলোচনায় গুরুত্ব রাষ্ট্রপতির

প্রকাশিতঃ 10:49 pm | April 07, 2023

এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, অ্যাকটিং এডিটর; সংসদের বিশেষ অধিবেশন থেকে :

বাঙালি জাতির চির আরাধ্য পুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য ৩০ লক্ষ শহীদের আত্মদান শেষে ১৯৭৩’র সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত হয়েছিল স্বাধীন বাংলার প্রথম জাতীয় সংসদ। স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে গঠিত এই সংসদ যাত্রা শুরু করে ওই বছরের ৭ এপ্রিল। রক্তে অর্জিত সংসদ পার করেছে ৫০ বছর। প্রথম জাতীয় সংসদে গণপরিষদ সদস্য হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রাষ্ট্রপতি মো.আবদুল হামিদ। সুবর্ণজয়ন্তীর বিশেষ অধিবেশনেও উপস্থিত তিনি। শুক্রবার (০৭ এপ্রিল) বিকেলে রাষ্ট্রপতি হিসেবে স্মারক ভাষণে ৫০ বছর পরেও সেই সংসদে উপস্থিত থাকতে পেরে শুরুতেই সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান রাষ্ট্রপতি।

এ সময় তিনি বলেন, ‘বর্তমান সংসদে গণপরিষদ ও প্রথম জাতীয় সংসদে আমি যাদের সঙ্গে ছিলাম তাদের অনেকের ছেলে-মেয়ে এমনকি নাতিরাও সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।’ মহামান্যের এই বক্তব্যে হাসির রোল পড়ে যায়। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অভিযাত্রা মসৃণ ছিল না-এমন উচ্চারণে রাষ্ট্রপতি অতীত স্মরণ করেন। সাফ সাফ জানিয়ে দেন-‘দেশের গণতন্ত্র আজ নিরাপদ ও সুরক্ষিত। নির্বাচিত ছাড়া রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণের সুযোগ নেই।’

রাষ্ট্রপতি হিসেবে আবদুল হামিদের দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হবে আগামী ২৪ এপ্রিল। রাষ্ট্রপতি হামিদ আটবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি ডেপুটি স্পিকার এবং স্পিকারের দায়িত্বও পালন করেছেন। সুবর্ণজয়ন্তীর বিশেষ অধিবেশনে রাষ্ট্রপতি মো.আবদুল হামিদের ভাষণে উঠে আসে তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের বর্ণনা। সেই সঙ্গে সংসদকে কার্যকর করতে সংসদ সদস্যদের কী ভূমিকা রাখা উচিত সেটিও তুলে ধরেন তিনি। সংসদে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিজের শেষ ভাষণে মো.আবদুল হামিদ বলেন, ‘রাজনীতির মতপার্থক্য ও নীতি আদর্শে ভিন্নতা থাকতে পারে। কিন্তু সংসদকে গণতন্ত্র ও উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করার ক্ষেত্রে কোন ভিন্নতা থাকতে পারে না।
তাই আপনাদের প্রতি আমার আকুল আহ্বান সংসদকে কার্যকর করতে ঐক্যবদ্ধ হোন। হৃদয়স্পর্শী নিজের শেষ ভাষণে গর্বের সঙ্গেই উচ্চারণ করলেন, রাষ্ট্রপতি হিসেবে নয়, বঙ্গবন্ধুর সৈনিক পরিচয়েই গর্ববোধ করি।’

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে। নির্বাচনই ক্ষমতা বদলের একমাত্র পথ। তাই আন্দোলনের নামে সংঘাত-সহিংতা থেকে বেরিয়ে গণতন্ত্রের স্বার্থে সব দলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান রাষ্ট্রপতি। তিনি বলেন, ‘ক্ষমতায় যাওয়া বা পরিবর্তন আনার একমাত্র উপায় নির্বাচন। আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস ও হিংসার রাজনীতি কোন দেশ, সমাজ বা অর্থনীতির জন্য কল্যাণকর হতে পারে না।

বরং তা রাজনীতির পরিবেশকে তমশাচ্ছন্ন করে তুলে। সংঘাত ভুলে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঐক্যমতে এসে গণতন্ত্রকে বিকশিত হতে আমাদের সকলের সহযোগিতা করা উচিত। প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি ও মহান সংবিধানের আলোকেই বাংলাদেশের জনগণ নিরপেক্ষভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে বাংলাদেশে গণতন্ত্র চর্চার ইতিহাসকে আরও সমৃদ্ধ ও বেগবান করবে এটিই সকলের প্রত্যাশা।’

মহামান্য রাষ্ট্রপতি দেশ থেকে উগ্রবাদ ও ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড দূর করতে জনগণকেও সচেষ্ট হওয়ার ডাক দেন। তিনি বলেন, ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ এই মহান সংসদে দাঁড়িয়ে আজ আমি দলমত নির্বিশেষে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি আসুন সকলের সম্মিলিত প্রয়াসে মাতৃভূমি থেকে সংঘাত-সংঘর্ষ ও যেকোন উগ্রবাদ ও ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড থেকে দূরে থেকে কল্যাণমুখী রাষ্ট্র গঠনে শামিল হোই।

দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান রাষ্ট্রপতি। জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। রাষ্ট্রপতি তাঁর নির্ধারিত আসন গ্রহণের সময় বিউগলে সুর বেজে উঠে। এরপর জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়।

অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান
গণতন্ত্রকে বিপন্ন করে তোলে এমন যে কোনো অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। তিনি বলেন, ‘জাতির বীর, সাহসী সূর্যসন্তানেরা লাখো প্রাণের বিনিময়ে আমাদের একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ উপহার দিয়ে গেছেন। আমাদের দায়িত্ব এই দেশ ও জাতির অগ্রযাত্রাকে বেগবান করা।’

রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ জানান তিনি রাষ্ট্রপতি পরিচয়ে নয়, বঙ্গবন্ধুর একজন সৈনিক হিসেবে পরিচয় দিতেই গর্ববোধ করেন। তিনি জানান, বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে তার রাজনীতিতে হাতেখড়ি। আর উত্থান হয়েছে তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে। তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর হাতে হয়েছিল আমার রাজনীতির হাতেখড়ি ও প্রথম উত্থান আর ১৯৯৬ সালে দ্বিতীয় উত্থান ঘটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতেই এবং তার উদ্যোগেই।’তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর অপার স্নেহ আর তার দূরদর্শিতার কারণেই আমি আজকে এই অবস্থানে পৌঁছেছি। রাষ্ট্রপতি হিসেবে নয় বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একজন সৈনিক হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে আমি বেশি গর্ববোধ করি।’

সংসদে দেওয়া তাঁর বিদায়ী ভাষণে সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী সেদিন আমাকে ডেপুটি স্পিকারের পদমর্যাদা না দিলে হয়ত বা কিশোরগঞ্জ ঘিরে আমার রাজনীতি আবর্তিত হতো।’ রাষ্ট্রপতি বলেন, ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার পরিচয়। আমি তখন কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজের ছাত্র। পরিচয় থেকেই বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শের অনুসারী হয়ে যাই। আবদুল হামিদ বলেন, মাঝে মাঝে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হতো অনেক সময় তিনি নিজেও ডেকে পাঠাতেন। সে সময় বঙ্গবন্ধু ছিলেন আমার একমাত্র ধ্যান-ধারণা তাঁর নীতি, আদর্শ ও নির্দেশনাই আমার কাছে সবচেয়ে বেশি অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় বিষয় ছিল।

রাষ্ট্রপতি স্মৃতিচারণ করেন, ‘শুধু আমি কেন ওই সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অনেক যুবকের কাছে বঙ্গবন্ধু ছিলেন একমাত্র আদর্শ; যার পিঠে একবার বঙ্গবন্ধুর হাত পড়েছে বা স্নেহের ছোঁয়া লেগেছে তার পক্ষে বঙ্গবন্ধুকে ভুলে যাওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়।’

কালের আলো/এমএএএমকে