শীতে বাড়ছে অগ্নিদগ্ধ রোগী

প্রকাশিতঃ 10:44 am | January 23, 2023

কালের আলো রিপোর্ট:

বন্ধুদের সঙ্গে মাঠে খেলতে গিয়েছিল ৯ বছরের রবিউল। সন্ধ্যার দিকে মাঠের এক কোণে শিশুরা আগুন জ্বালিয়ে পোহাচ্ছিল। সেখানে অন্যমনস্ক হয়ে আগুনে পা চলে যায় ওর। এতে পা কিছুটা পুড়ে যায়। পাশের বাসার ভাড়াটিয়ার পরামর্শে ওর পায়ে চুন লাগানো হয়। এতে ক্ষত জায়গায় ইনফেকশন হয়েছে। পরে স্থানীয় চিকিৎসকরা বার্ন ইনস্টিটিউটে যাওয়ার পরামর্শ দেন। এজন্য রবিউলকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নিয়ে এসেছেন নানা শফিক মিয়া। চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ।দীর্ঘসময় চিকিৎসকের অপেক্ষায় বসে আছেন।

গত বৃহস্পতিবার (১৯ জানুয়ারি) শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আউটডোরে ঘুরে এমন চিত্র চোখে পড়লো। আউটডোরজুড়ে রোগীদের উপচেপড়া ভিড়। তাদের মধ্যে শিশু ও নারীর সংখ্যাই বেশি। চিকিৎসক-নার্সরা রোগীদের ড্রেসিংয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন। চারদিকে শুধুই ছোটাছুটি।

হাসপাতাল সূত্র বলছে, প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত আউটডোরের টিকিট দেওয়া হয়। এ চার ঘণ্টায় প্রতিদিন ২৮০-৩০০ রোগী আসেন। তবে ১৯ জানুয়ারি দুপুর পৌনে ১২টা পর্যন্ত রোগী এসেছেন ৩০২ জন। দায়িত্বরত চিকিৎসকরা জানান, আউটডোরে সবসময়ই রোগীদের ভিড় থাকে। তবে শীতকালে তুলনামূলক দগ্ধ রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। প্রতিদিন আউটডোর থেকে ছয় থেকে সাতজন রোগী আবার হাসপাতালে ভর্তি হয়ে থাকেন। আসন ফাঁকা থাকলে আরও বেশি রোগীকেও ভর্তি করা হয়।

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের মতো একই অবস্থা ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের শিশু ওয়ার্ডের চারতলার। এই ওয়ার্ডের ব্লু ইউনিটের ৫ নম্বর বেডে শুয়ে কাতরাচ্ছে ঝিনাইদহের মহেশপুরের লামিয়া (৮)। ওর শরীরের ৩৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। ওর বয়সী ফুপুর সঙ্গে মাঠে নারিকেলমালায় আগুন দিয়ে রান্নাবান্না খেলার সময় ফ্রকে আগুন ধরে যায়। আগুন দেখে সবাই ভয়ে পালিয়ে যায়। লামিয়ার বাবা মোহাম্মদ নূহ নবী বিপু বলেন, দোতলা থেকে একজন আগুন দেখে চিৎকার করলে তা নেভানোর চেষ্টা করা হয়। গত বছরের ১২ ডিসেম্বর এ ঘটনা ঘটে।

শীতকালে আগুন পোহানোসহ আগুনের এমন বহুবিধ ব্যবহারে বাড়ছে দগ্ধ শিশুর সংখ্যাও বাড়ছে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বছরের এই সময়টায় শিশুদের অগ্নিদগ্ধ হওয়ার সংখ্যা বেড়ে যায়। ঢামেক বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের তথ্য মতে, চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি ৩০০ শয্যার মধ্যে ২৫৮ জন বিভিন্ন ধরনের পোড়া রোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন। তাদের মধ্যে শিশু রয়েছে ৬০ জন।

ঢামেকের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের প্রধান ডা. বিধান সরকার বলেন, সারা দেশ থেকে পোড়া রোগী আসছে। শীতজনিত কারণে অগ্নিদগ্ধ রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগুনে পোড়া মানুষ এখানে আনা হয় চিকিৎসার জন্য। পথে অনেকটা সময় ব্যয় হয়ে যায়।

তবে পোড়ার পর ২৪ ঘণ্টা খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে জানান বিধান সরকার। তিনি বলেন, ‘আগুনে শরীরের এডুকেট সম্পূর্ণ শেষ হয়ে যায়। যত শতাংশ পুড়ে গেছে সেই হিসাব অনুযায়ী যদি তখনি রোগীকে এডুকেট স্যালাইন দেওয়া যায়, তাহলে রোগীকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব; কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ওই রোগীগুলো দেশের দূর-দূরান্ত থেকে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা পরে আমাদের কাছে এসে পৌঁছায়। এডুকেট স্যালাইন পেয়ে না আসার কারণে তাদের শরীরে এডুকেট স্যালাইন দিলেও সেটি পূরণ হয় না।’

শীতকালে আগুনে পোড়া রোগী বেড়েছে কি না, জানতে চাইলে শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবুল কালাম বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবেই শীতের সময় আগুনে পোড়া রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। বার্ন রোগীদের জন্য আমাদের নির্ধারিত শয্যা রয়েছে। এরপরেও শয্যা বাড়ানো হয়েছে। আমরা সর্বোচ্চসংখ্যক রোগী ভর্তির চেষ্টা করে থাকি। সারাদেশ থেকেই এখানে রোগী আসেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে কষ্ট হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘রোগীদের ৮০ শতাংশ ঢাকার বাইরে থেকে আসেন। তবে তাদের বেশিরভাগই পর্যাপ্ত প্রাথমিক চিকিৎসা পাচ্ছেন না। এটি না হওয়ার কারণ দুটি। একটি হচ্ছে, চিকিৎসকসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে অজ্ঞতা রয়েছে। রোগীদের পোড়া অংশে ঐতিহ্যগতভাবে চুন, টুথপেস্ট, ডিম লাগানো হয়। এগুলো অত্যন্ত ক্ষতিকর। যেমন- কাঁচা ডিমে প্রোটিন থাকে। প্রোটিন যেখানে থাকবে, সেখানে ইনফেকশন হবেই। টুথপেস্টে ক্যামিকেলস থাকে, চুনের উপাদান বার্নটিকে আরও ডিপ করে। যেটা হয়তো ১০ দিনে ঠিক হয়ে যেতো, সেটা ঠিক হতে দীর্ঘসময় লাগে। এক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা হিসেবে পানি ছাড়া আর কিছু ব্যবহার করা যাবে না। পোড়া স্থানে ঠান্ডা পানি ব্যবহার করা যেতে পারে। টানা ৪০ মিনিট ঠান্ডা পানি ঢাললেও রোগী অনেক উপকার পাবেন।’

কালের আলো/এসবি/এমএম

Print Friendly, PDF & Email