শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে নতুন বই পাওয়া উচ্ছ্বসিত শিক্ষার্থীদের আনন্দ মিলেমিশে একাকার

প্রকাশিতঃ 5:11 pm | January 01, 2023

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:

পুরো মাঠের চিত্র এক ও অভিন্ন। একই রঙের পোশাকে হাজারো শিক্ষার্থী। পৌষের সকালের শীতের জবুথবু ভাব নেই কারও। সবার হাতে নতুন বই। আনন্দে উদ্বেলিত মুহুর্ত। কখনো হর্ষধ্বনি দিয়ে উঠছিল। কখনো একসঙ্গে বই উঁচু করে দেখাচ্ছিল। ওদের আনন্দ-উল্লাস ছড়িয়ে পড়ে পুরো মাঠে। গাজীপুরের কাপাসিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠের দৃশ্য এটি। নতুন বছরের প্রথম দিন রবিবার (১ জানুয়ারি) সকালে এখানেই বই উৎসবের উদ্বোধন করে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনিও যেন আনন্দ ভাগাভাগি করলেন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। শিক্ষার্থীদের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস ছুঁয়ে যায় তাকেসহ অন্য অতিথিদের।

করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে গত দুই বছর বই উৎসব হয়নি। মহামারি নিয়ন্ত্রণে এসেছে, তাই এবার রবিবার (১ জানুয়ারি) নতুন শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিনে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে উৎসব করে শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে পাঠ্যবই তুলে দেওয়া হয়েছে। অথচ কাগজের সঙ্কট, চড়ামূল্য বা লোডশেডিংয়ের কারণে অন্যান্য বছরের তুলনায় এই বছর বেশ দেরিতে বিনামূল্যের পাঠ্যবই মুদ্রণের কাজ শুরু হয়। কিন্তু সব সঙ্কট মোকাবেলা করে নির্ধারিত সময়ে বই পৌঁছে দেয়ার সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী ডা: দীপু মনি। নির্ধারিত সময়ে বই পৌছে দিতে দ্রুত ছাপার কাজ ও মান নিয়ন্ত্রণেও কঠোর মনিটরিং করেন মন্ত্রী। এসবের সুফল হিসেবে এবারও বছরের প্রথম দিনেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়ার কঠিন এক চ্যালেঞ্জে উত্তীর্ণ হয়েছে তাঁর নেতৃত্বাধীন শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

গাজীপুরের কাপাসিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে রবিবার (১ জানুয়ারি) বই উৎসবের উদ্বোধন করেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। এ সময় পাশেই বসা ছিলেন শিক্ষার্থী ইসফা মেজবিন সিফা, নিশাত তাবাচ্ছুম ও তার মা শিরিন শীলা। মা শিরিন শীলা জানান, নতুন বইয়ের জন্য এখানে আসবে বলে রাত থেকেই ওর কতরকম প্রস্তুতি যে চলছিল। আগ্রহের আতিশয্যে ভোর না হতেই ঘুম ভেঙে যায় নিশাতের।

আফরা হোসাইন মিথি এবার সপ্তম শ্রেণিতে উঠলো। নতুন বই হাতে পেয়ে একের পর এক পৃষ্ঠা উল্টে দেখছিল মুগ্ধতার সঙ্গে। কাপাসিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থীর নাম জিজ্ঞেস করতেই লজ্জা পেয়ে বইয়ের ভাঁজে মুখ লুকিয়ে বলে ‘আফরা হোসাইন মিথি’।

কিংবা অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী প্রীতি সরকারের কথাই ধরা যাক না! পাশের চেয়ারে তার মা পার্বতী সরকার। প্রীতি পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় আঁকা ছবিগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখছে। মা পার্বতী সরকারের অনুভূতি জানতে চাইলে বলেন, ‘অভিভাবক হিসেবে আনন্দটা ভাষায় প্রকাশের মতো নয়। ভীষণ ভালো লাগছে। বছরের প্রথম দিনই বই হাতে পেলে একজন শিক্ষার্থী কতটা খুশি হয়, তা না দেখলে কেউ অনুভব করতে পারবে না।’

গাজীপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) আনিসুর রহমান জানান, জেলায় এই বছর ১ম থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত ৬ লাখ ১২ হাজার ৩৫১ জন শিক্ষার্থীর হাতে ২৫ লাখ ৪০ হাজার ২৩৪টি এবং ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত ৬ লাখ ৯২ হাজার ৭৩০ জন শিক্ষার্থীর হাতে মোট ৮৭ লাখ ৭৬ হাজার ৬৮৯টি পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় পাঠ্যপুস্তক উৎসবের আয়োজন করে। এর মধ্যে বই উৎসবের প্রথম দিনে কাপাসিয়া উপজেলার ৩১টি স্কুল এবং ৬টি মাদ্রাসার ৬ হাজার শিক্ষার্থীর হাতে নতুন বই তুলে দেওয়া হয়।

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা ঢাকা অঞ্চলের পরিচালক প্রফেসর মনোয়ার হোসেন জানান, বই উৎসবে সারাদেশে ৪ কোটি ৯ লাখ ১৫ হাজার ৩১৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩৩ কোটি ৪৮ লাখ ৭৮ হাজার ৮৩৩টি নতুন বই বিনামূল্যে বিতরণ করা হবে।

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব আবু বকর ছিদ্দীকের সভাপতিত্বে পাঠ্যপুস্তক উৎসবে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন শিক্ষামন্ত্রী ডা: দীপু মনি। তিনি স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। বলেন ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে আমরা স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। স্বপ্ন দেখি স্মার্ট বাংলাদেশের। সেই স্মার্ট বাংলাদেশের নাগরিক হবে স্মার্ট নাগরিক। সেই বাংলাদেশের সরকার হবে স্মার্ট সরকার, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সমাজ। এইসব স্মার্ট গড়ার জন্য যেটি দরকার সেটি হচ্ছে স্মার্ট শিক্ষা। আমরা নতুন শিক্ষাক্রম তৈরির মাধ্যমে সেদিকেই এগিয়ে চলেছি।’

শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, ‘সপ্তম শ্রেণির যে বইগুলো দেওয়া হয়েছে সেগুলো নুতন শিক্ষাক্রমের। সব শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিক্ষাবিদ ও বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে এমন শিক্ষাক্রম তৈরি করেছি যেখানে শিক্ষা হবে আনন্দময়, শিক্ষায় পরীক্ষাভীতিতে আমাদের শিক্ষার্থীরা সারাদিন ভীত থাকবে না। আমাদের শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানমনস্ক হবে। প্রযুক্তিবান্ধব শুধু নয়, প্রযুক্তি ব্যবহারে ও উদ্ভাবনে দক্ষ হবে। তারা মানবিক ও সৃজনশীল মানুষ হবে। আমাদের যে মূল্যবোধ আছে সে মূল্যবোধ নিয়ে বড় হতে হবে। আমরা দক্ষ, যোগ্য, মানবিক ও সৃজনশীল মানুষ হবো। আমরা সত্যিকারের সোনার মানুষ হবো, যেন সোনার বাংলা গড়তে পারি।’

তিনি আরও বলেন, ‘দেশে আজ বই উৎসব হচ্ছে। সারাবিশ্বে বাংলাদেশ একটি অন্যন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, যেখানে বছরের প্রথম দিন একটি বই উৎসব হয়। যেখানে আমাদের কোটি কোটি শিক্ষার্থী এই বই উৎসবে অংশগ্রহণ করে।’

শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘২০১০ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিনামূল্য যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করেছি, তার সংখ্যা ৪৩৪ কোটি ৪৫ লাখ ৮০ হাজার ২১১ কপি। এটি বিশ্বের যেকোনও জায়গার জন্য অচিন্তনীয় ব্যাপার। তার মধ্য দিয়ে আমাদের শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার রোধ করতে পেরেছি। কারণ, মা-বাবার ওপর বই কেনার ভার থাকছে না। এই নতুন বই বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীরা হাতে পায়। আমাদের সময় তিন, চার, ছয় মাসও অপেক্ষা করেছি নতুন বইয়ের জন্য। অনেক সময় পুরনো বই পড়ে পার করতে হয়েছে।’

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব আবু বকর ছিদ্দীকের সভাপতিত্বে পাঠ্য পুস্তক উৎসব অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, আওয়ামী লীগের স্থায়ী কমিটির সদস্য সিমিন হোসেন রিমি এমপি, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব কামাল হোসেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব ইব্রাহিম ভূঁইয়া স্বপন, গাজীপুর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোতাহার হোসেন মোল্লা প্রমুখ।

কালের আলো/জিকে/এমএইচ

Print Friendly, PDF & Email