মেট্রোরেল অর্থনীতির নতুন জাগরণ

প্রকাশিতঃ 9:22 am | December 29, 2022

প্রভাষ আমিন :

ঢাকা শহরের মূল সমস্যা যানজট। আমরা যারা বছরের পর বছর ঢাকায় থাকছি, তাদের কাছে ঢাকার যানজট গা সওয়া হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু ঢাকার যানজট অনেক আগেই সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। তাই ঢাকায় থেকেও ঢাকার যানজট মেনে নেওয়া কঠিন।

আর কোনো উপায় নেই বলে এই যানজটের সঙ্গেই আমাদের মানিয়ে চলতে হয়। ‘চলতে হয়’ বললে ভুল হবে, আসলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় বসে থাকতে হয়। বাইরে থেকে হঠাৎ কেউ এলে ঢাকার যানজটের চিত্র তারা বিশ্বাসই করতে চান না। ভাবেন, কোনো কারণে হঠাৎ একদিন শহর অচল হয়ে গেছে। আসলে ঢাকা বছরের পর বছর এমন অচলই থাকে।

ইদানীং ছুটির দিনেও যানজট থাকে। এবং ঢাকার যানজটের কোনো কারণ লাগে না। আসলে একটি সচল শহরে যতটা রাস্তা থাকা দরকার, ঢাকায় আছে তার অর্ধেক। আর ঢাকা যেভাবে অপরিকল্পিতভাবে বেড়ে উঠেছে, তাতে নতুন করে রাস্তা বানানোর উপায়ও নেই। তাই মাটির নিচে বা ওপরে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। ভবিষ্যতে মাটির নিচেও যাবে মেট্রোরেল। আপাতত মাটির ওপরের মেট্রোরেল আর স্বপ্ন নয়, বাস্তব।

মেট্রোরেল ব্যবস্থা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দারুণ চাঞ্চল্য আনবে। যানজট আমাদের অর্থনীতির গতি অনেকটাই আটকে রেখেছে। রাস্তা যত সচল হবে, অর্থনীতিও তত গতিশীল হবে। যানজটের অর্থনৈতিক ক্ষতি নিয়ে নানা সময়ে নানান গবেষণা হয়েছে।

২০১৮ সালে পরিচালিত বুয়েটের একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, ঢাকায় যানজটের জন্য বার্ষিক ৪.৪ বিলিয়ন ডলার বাড়তি খরচ হয়। ২০১৭ সালের বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকায় যানজটের কারণে প্রতিদিন ৩.৮ মিলিয়ন কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। এই কর্মঘণ্টার অর্থমূল্য ধরলে যানজটের কারণে ক্ষতির পরিমাণ আমাদের কল্পনাও ছাড়িয়ে যাবে।

গবেষকদের মতে, ঢাকার যানজট ৬০ শতাংশ কমাতে পারলে বাংলাদেশ ২.৬ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় হতে পারে। শুধু অর্থমূল্য নয়, ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে বসে থাকা মানুষের মনের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে, উদ্যম কমিয়ে দেয়। পরোক্ষভাবে এই হতোদ্যম জনশক্তিও অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

মেট্রোরেল ব্যবস্থা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দারুণ চাঞ্চল্য আনবে। যানজট আমাদের অর্থনীতির গতি অনেকটাই আটকে রেখেছে। রাস্তা যত সচল হবে, অর্থনীতিও তত গতিশীল হবে।
মেট্রোরেল চালু হলেই ঢাকার যানজট রাতারাতি হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে, এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। তবে যানজট নিরসনে এটি একটি কার্যকর পথের যাত্রা।

মেট্রোরেলের পরিকল্পিত সবগুলো রুট চালু হলে অবশ্যই তা যানজট নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আর যানজট সহনীয় মাত্রায় নামিয়ে আনতে পারলে তা অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে বড় ভূমিকা রাখবে।

আপাতত মেট্রোরেল উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত চালু হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে এই রুটটি ছিল উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত। পরে তা কমলাপুর পর্যন্ত বাড়ানো হয়।

উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ২২ কিলোমিটারেরও বেশি পথ মেট্রোরেলের নির্মাণ যজ্ঞের কারণে বছরের পর বছর প্রায় অবরুদ্ধ ছিল। বিশেষ করে মিরপুর, রোকেয়া সরণি, ফার্মগেট, কারওয়ানবাজার, প্রেসক্লাব, পল্টন, মতিঝিলের ব্যস্ত এলাকার অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান প্রায় অচল ছিল। কোনো কোনো এলাকায় রাস্তা এত সরু হয়ে গিয়েছিল, যে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলারই উপায় ছিল না।

আপাতত মিরপুর, রোকেয়া সরণি এলাকার ব্যবসায়ীরা হাফ ছেড়ে বেঁচেছেন। ডুবতে থাকা ব্যবসা ঘিরে তারা আবার নতুন করে আশার আলো দেখছেন। মেট্রোরেল ঘিরে এই এলাকা যেভাবে জেগে উঠছে, তাতে কয়েক বছরের ক্ষতিও পুষিয়ে নেওয়ার আশা ব্যবসায়ীদের।

শুধু পুরোনো ব্যবসায়ীরাই নয়, মেট্রোরেলের পথ ধরে, মিরপুর এলাকায় আসছে নতুন নতুন উদ্যোক্তা। নামী রেস্টুরেন্ট, শপিং মল, বিভিন্ন ব্র্যান্ডের শোরুম সাজছে নতুন করে। মেট্রোরেলের লাইন যেন আশপাশের এলাকাকেও জাগিয়ে তুলছে।

মেট্রোরেল চালু হওয়ার সাথে সাথেই এর জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় যেন জেগে উঠছে চারপাশ। উত্তরার দিয়াবাড়ি এলাকা একসময় ছিল শহরের মানুষের শ্বাস ফেলার জায়গা। শরতে কাশফুল দেখার সবচেয়ে কাছের গন্তব্য। এখন দিয়াবাড়ি মেট্রোরেলের উৎস ভূমি।

দিয়াবাড়ির আশপাশে গড়ে উঠছে আন্তর্জাতিক মানের শপিং মল, আবাসিক এলাকা। রাজউকের ফ্ল্যাট প্রকল্পেও প্রাণসঞ্চার করছে মেট্রোরেল। উত্তরা ও মিরপুর এলাকার বাসা ভাড়া বেড়ে গেছে এরমধ্যে। এসব এলাকার ফ্ল্যাটের দামও বেড়েছে।

মেট্রোরেলের স্টেশন ঘিরেও গড়ে উঠছে বিজনেস হাব। প্রতিদিন লাখো মানুষের চলাচল ঘিরে গড়ে নানান ব্যবসা, সব মিলিয়ে মেট্রোরেল ঢাকার একটি অংশ পুরোপুরি বদলে দিচ্ছে।

মেট্রোরেলের নির্মাণ যজ্ঞের সময় প্রায় নরকে পরিণত হওয়া মিরপুর এখন সবচেয়ে সুন্দর এলাকাগুলোর একটি। পুরো মেট্রোরেল চালু হলে, শুধু মিরপুর নয়, বদলে যাবে গোটা ঢাকা।

গণমাধ্যমের রিপোর্ট বলছে, মেট্রোরেল প্রকল্পটি প্রতি বছর ২.৪ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করবে, যা জাতীয় জিডিপির ১.৫ শতাংশের সমান। তাছাড়া মেট্রোরেল ঢাকার ১৫ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের জন্য যাতায়াত সহজ করবে এবং দৈনন্দিন জীবনযাত্রা গতিশীল করবে, যা অর্থনীতিতে একটি বড় ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করবে। এই প্রভাব শুধু মেট্রোরেল এলাকায় নয়, পুরো ঢাকা, পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়বে।

ব্র্যাক ইন্সটিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের একটি সমীক্ষা বলছে, ২০০৪ সালে ঢাকার রাস্তায় যানবাহনের গড় গতি ছিল প্রায় ২১ কিমি/ঘণ্টা, কিন্তু ২০১৫ সালে তা ৬ ঘণ্টায় নেমে আসে। এই গতিতে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত বাসে যেতে কখনো কখনো ৩ থেকে ৪ ঘণ্টার লেগে যায়।

এমআরটি-৬ পুরো চালু হলে মেট্রোরেলে উত্তরা থেকে মতিঝিল পৌঁছাতে সময় লাগবে মাত্র ৪০ মিনিট। মেট্রোরেলের ভাড়া নিয়ে সমালোচনা আছে। অন্যান্য মেট্রোর চেয়ে ঢাকা মেট্রোর ভাড়া বেশি। বিদ্যমান বাস ভাড়ার চেয়েও বেশি।

অনেকে ভাড়া কমানোর দাবি করছেন। আমি এই দাবির সঙ্গে আমি শতভাগ একমত। প্রয়োজনে ভর্তুকি দিয়ে হলেও মেট্রোরেলের ভাড়া সাধারণ মানুষের আওতায় রাখতে হবে। তবে এটাও ঠিক, ৪ ঘণ্টার পথ ৪০ মিনিটে পেরুতে পারলে ভাড়াটা অনেকের কাছে বেশি মনে নাও হতে পারে। তবে মেট্রোর ক্ষেত্রে গরিব মানুষই প্রধান বিবেচ্য হওয়া উচিত।

মেট্রোরেলের আর্থিক সম্ভাবনা নিয়ে নিশ্চয়ই অনেক গবেষণা হবে। তবে এখন ঢাকার একটি অংশের আলো ঝলমলে চেহারা, সামনে আরও সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে পারে।

আপাতত উত্তরা-আগারগাঁও অংশের আশপাশের মানুষ সরাসরি মেট্রোরেলের সুবিধা পাচ্ছে। তবে মেট্রোরেলের কারণে অর্থনীতিতে যে ঢেউ আসছে তা আছড়ে পড়বে গোটা বাংলাদেশে। দিনাজপুরের যে মানুষ হয়তো কোনোদিন মেট্রোরেল চোখেও দেখবে না, তিনিও কিন্তু মেট্রোরেলের সুবিধা পেয়ে যাবেন ঘরে বসেই।

উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পথে বাংলাদেশের যে লড়াই; নিঃসন্দেহে মেট্রোরেল তাতে দারুণ গতি আনবে।

লেখক: বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ

Print Friendly, PDF & Email