দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে প্রধানমন্ত্রীর একগুচ্ছ পদক্ষেপ
প্রকাশিতঃ 10:43 am | November 09, 2022

কালের আলো রিপোর্ট:
অতিমারি করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন মধ্যকার যুদ্ধের প্রভাবে একেবারেই বিপর্যস্ত বিশ্ব অর্থনীতি। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী (ডব্লিউএফপি) এরই মধ্যে সতর্ক করে বলেছে ২০২৩ সালে বিশ্বের ৪৫টি দেশে তীব্র খাদ্য ঘাটতি দেখা দিতে পারে। ২০ কোটি মানুষের জন্য জরুরি সহায়তার প্রয়োজন হতে পারে। সম্প্রতি আফ্রিকায় খরার কারণে খাদ্য উৎপাদন কমে গেছে। এতে দুর্ভিক্ষের মত পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও সার সঙ্কটের কারণে বাংলাদেশে ধানের উৎপাদন গত বছরের তুলনায় চলতি বছর চার লাখ টন কম হতে পারে বলে ধারণা করছে বিশ্ব খাদ্য সংস্থা। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে চলতি বছর ধানের উৎপাদন হতে পারে পাঁচ কোটি ৬৪ লাখ টন, যা গত বছর ছিল পাঁচ কোটি ৬৮ লাখ টন। তবে গমের উৎপাদন এক লাখ টন বৃদ্ধি পেয়ে ১২ লাখ টনে উন্নীত হতে পারে।
প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর সূত্র জানায়, এসবের প্রভাবে বিশ্ব আগামী বছর ‘দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতির’ মুখোমুখি হতে পারে বলে সতর্ক করে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলে আসছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই বিষয়ে সতর্ক হওয়ার জন্য বিশ্বনেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বক্তৃতা করেছেন। বাংলাদেশে যাতে এই ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয় সেজন্য এখন থেকে প্রস্তুতি নিতে দেশবাসীকে সব কিছুতেই সাশ্রয়ী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। বলেছেন, বিদ্যুৎ ব্যবহার, পানি ব্যবহার, খাদ্য ব্যবহার প্রত্যেকটা ব্যবহারের ক্ষেত্রে সবাই যেন সাশ্রয়ী হয়।
গত বুধবার (২ নভেম্বর) রাজধানীর শাহবাগে বিসিএস প্রশাসন অ্যাকাডেমিতে একটি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমেরিকা, ইউরোপ, ইংল্যান্ডসহ প্রত্যেকটা দেশ এখন অর্থনৈতিক মন্দার কবলে। বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারছে না, খাদ্যের দাম বেড়ে গেছে, সেখানে সব জায়গায় রেশনিং করা হয়েছে। এমন একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের করণীয় সম্পর্কে তিনি বলেন, আমি বহু আগে থেকেই এটা বলে যাচ্ছি যে এক ইঞ্চি জমিও যেন খালি না থাকে। কারণ, আমাদের নিজের খাদ্য নিজেদেরই উৎপাদন করতে হবে। খাদ্য প্রক্রিয়াজাত করার জন্য শিল্পায়ন দরকার এবং দেশের মানুষের খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক তাদের রিপোর্টে বলেছে, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে সারের ব্যাপক সংকট তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন রিলেশন্স কমিটির সামনে এক বক্তব্যে ডব্লিউএফপি নির্বাহী পরিচালক জানিয়েছেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খাদ্য উৎপাদন কমে যাবে এবং এর একটি বড় কারণ হবে রাশিয়া ইউক্রেনের মধ্যকার যুদ্ধ এবং সারের সঙ্কট।
এটা এমন এক ধরনের সঙ্কট হতে যাচ্ছে যা আমরা জীবদ্দশায় দেখিনি—বলেন বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচীর প্রধান।
এমন পরিস্থিতিতে সারের সঙ্কট যাতে দেশে কোনও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে না পারে সেজন্য বিশ্বের যেখান থেকে হোক সার কিনে আনার জন্য কৃষিমন্ত্রীকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অতিরিক্ত দামেই সার কেনার সকল ব্যবস্থা করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়। ভর্তুকির পরিমাণও বাড়িয়েছে সরকার। যেখানে কৃষিতে ভর্তুকি বাবদ বছরে ৮ থেকে ৯ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হতো, সেখানে খাদ্য সঙ্কট এড়াতে এই বছর কৃষিতে ৪৬ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়ার কথাও ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। বলেছেন, কোনও অবস্থায়ই খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত করা ঠিক হবে না। ভর্তুকির এই টাকা জোগাড় করতেই হবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, দেশে দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে সাশ্রয়ীমূল্যে দেশের এক কোটি পরিবারকে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) পণ্য সরবরাহের উদ্যোগ শতভাগ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। সহনীয় দামে প্রায় ১ কোটি উপকারভোগী কার্ডধারীর হাতে টিসিবি তুলে দিচ্ছে ৫৫ টাকায় এক কেজি চিনি, ৬৫ টাকা কেজিতে ২ কেজি মসুর ডাল, ১১০ টাকা করে ২ লিটার সয়াবিন তেল। এর মধ্য দিয়ে দেশের পাঁচ কোটি মানুষ উপকৃত হচ্ছেন। টিসিবির চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আরিফুল হাসান এই মহাকর্মযজ্ঞের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। দরিদ্র আর নিম্নবিত্ত মানুষের প্রধান ও একমাত্র ভরসার নাম হয়ে উঠেছে টিসিবি। সক্ষম হচ্ছে দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রেও বড় রকমের অবদান রাখতে।
একইসঙ্গে ১৫ টাকা এবং ৩০ টাকা কেজি দরে চাল ও ১৮ টাকা কেজি দরে আটা বিক্রির কার্যক্রমও চলছে। সরকার মনে করে সরকারের এসব কর্মসূচি যে কোনও ধরনের খাদ্য সঙ্কট মোকাবিলায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, দেশে বছরে চালের চাহিদা মোটামুটি তিন কোটি ৫০ লাখ টন। আটার চাহিদা বছরে ৫০ থেকে ৬০ লাখ টন। চালের প্রায় শতভাগ এবং গমের ১০ শতাংশের মত দেশীয় জোগান থেকে আসে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্য কোনও কারণে ধানের উৎপাদন ব্যাহত হলে তখন চাল আমদানি করতে হয়। এমন অবস্থায় সঙ্কট এড়াতে এবছর অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছর সরকার ১২ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছে। এসব চাল আমদানির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। যে কোনও ধরনের খাদ্য সংকট এড়াতে চাল আমদানিতে সরকার প্রথমে শুল্ক ৬২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করেছিল। তবে ভারতের বাজারে দাম বেশি হওয়ায় দেশীয় আমদানিকারকরা আমদানিতে সুবিধা করতে না পারায় শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে আরও কমিয়ে তা ১৫ শতাংশ করা হয়। এসব সুবিধার ফলে আমদানিকৃত চাল দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারেও এসেছে বলেও জানিয়েছে সূত্র।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের বৈদেশিক সংগ্রহ বিভাগের তথ্য বলছে, ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশকে সরকারি ও বেসরকারিভাবে সর্বোচ্চ ৩৬ লাখ টন চাল আমদানি করা হয়েছিল। ২০১৮-১৯ অর্থবছর আমদানির পরিমাণ ছিল ১৪ লাখ টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে চাল আমদানি করা হয়েছিল ৪ হাজার টন। আর গত ২০২০-২০২১ অর্থবছরে আমদানির পরিমাণ ছিল সাড়ে ১৩ লাখ টন। ২০২১-২২ অর্থবছর তা আবার কমে গিয়ে দাঁড়ায় ৯ লাখ টনে।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সর্বশেষ ২ নভেম্বর-২০২২ পর্যন্ত সরকারি গুদামে মোট ১৫ লাখ ৭৩ হাজার ৪৮৫ টন খাদ্যের মজুত আছে। এর মধ্যে চাল ১৩ লাখ ৫৮ হাজার ৭৫ টন, গম দুই লাখ ৫ হাজার ৬৭৫ টন আর ধান ১৪ হাজার ৯৭৯ টন। চলতি আমন মৌসুমে মোট ৫৯ লাখ হেক্টর জমিতে আমনের চাষ হয়েছে। আমন উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে করা হয়েছে ১ কোটি ৬৩ লাখ মেট্রিক টন। ইতিমধ্যেই আমন ফসল কৃষকের গোলায় উঠতে শুরু করেছে। ১০ নভেম্বর থেকে সরকার আমন কেনা শুরু করবে। চলতি আমন মৌসুমে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে প্রতি কেজি আমন চাল ৪২ টাকা ও আমন ধান ২৮ টাকা দরে কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এবছর পাঁচ লাখ টন চাল ও তিন লাখ টন আমন ধান সংগ্রহ করা হবে। এ বছর পাঁচ লাখ টন চাল ও তিন লাখ টন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেছেন, বাংলাদেশে এবার বৃষ্টিপাত কম হয়েছে, এতে আমন ধানের ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে তা কাটিয়ে ওঠা গেছে। আমনের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে। যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ও তা কতটা হবে সেটি এখনই বলা যাচ্ছে না। কারণ মাঠ থেকে সব আমন ফসলে ওঠেনি। অন্যদিকে বিশ্ববাজারেও খাদ্যের সঙ্কট আছে। এই দুই পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য নাজুক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।
তবে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক জানিয়েছেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দেশে চাল-আটাসহ খাদ্যপণ্যের দাম বাড়লেও সেটা খাদ্যাভাবে গড়ানোর মত পরিস্থিতি এখনও হয়নি। খাদ্যের উৎপাদন বাড়াতে আগামী বছর থেকে সারাদেশের কৃষিজমিকে ব্লকে ভাগ করে চাষাবাদ তদারকের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
কালের আলো/এসবি/এমএম