হেপাটাইটিস বি মুক্ত বিশ্ব ও রোটারির ভূমিকা

প্রকাশিতঃ 10:41 am | November 08, 2022

ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল :

পৃথিবীতে প্রায় ৩৫ কোটি মানুষ হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত। এদের মধ্যে বেশিরভাগই বাস করেন এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে, যেখানে আমাদেরও বসবাস। প্রকাশিত বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রায় ৫ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে সংক্রমিত যারা প্রত্যেকেই জীবনের কোনো একটা পর্যায়ে লিভার সিরোসিস বা লিভার ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছেন। কারণ এটি প্রতিষ্ঠিত বাস্তবতা যে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত কোন কোন ব্যক্তি এই দুটি মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হতে পারেন।

বাংলাদেশেও যথারীতি লিভার সিরোসিস এবং লিভার ক্যানসারের প্রধান কারণ হেপাটাইটিস বি ভাইরাস। এদেশে ৬০-৭০ শতাংশ লিভার সিরোসিস এবং লিভার ক্যানসার এই ভাইরাসটির কারণেই হয়। এদেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের মেডিসিন ওয়ার্ডগুলোয় যে মানুষগুলো প্রতি বছর চিকিৎসার জন্য ভর্তি হন তাদের ১০-১২ শতাংশ লিভার রোগে আক্রান্ত, যার বেশিরভাগই আবার হেপাটাইটিস বি ভাইরাসজনিত লিভার রোগ।

একদিন যেমন ফিলিপিন্সের কিছু রোটারিয়ান পোলিও নির্মূলে উদ্যোগী হয়ে আজ বিশ্বকে পোলিওমুক্ত করায় রোটারিকে নেতৃত্বের আসনে বসিয়েছেন, বাংলাদেশের রোটারীয়ানরা প্রত্যাশা করে যে একদিন এই উদ্যোগটি মহিরুহে পরিণত হবে এবং বিশ্ব যেদিন সত্যি সত্যি হেপাটাইটিস বি মুক্ত হবে, সেদিন মানুষ রোটারি ইন্টারন্যাশনাল এবং সেই সাথে বাংলাদেশের রোটারিয়ানদেরও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।

শুধু তাই নয়, আমাদের মেডিকেল কলেজগুলোর মেডিসিন ওয়ার্ডগুলোয় প্রতি বছর যে হতভাগ্য রোগীরা মৃত্যুবরণ করেন, তাদের এক-তৃতীয়াংশের মৃত্যুর কারণ এই লিভার রোগ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, কোভিড-পূর্ববর্তী সময়ে এদেশে প্রতি বছর ২২ হাজারেরও বেশি মানুষ লিভার রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করতেন।

গত দুই বছরে পৃথিবীর অন্যান্য আরও দশটি দেশের মতো বাংলাদেশেও যখন সবগুলো হাসপাতাল কোভিড হাসপাতালে রূপান্তরিত হয়েছিল আর অন্যান্য নন-কোভিড রোগের মতো ব্যাহত হয়েছিল লিভার সিরোসিস লিভার ক্যানসারের রোগীদের চিকিৎসাও, তখন এ কথা নিশ্চিত করেই বলা যায় যে আজ এদেশে প্রতি বছর ২২ হাজারের চেয়ে অনেক বেশি রোগী লিভার রোগের কারণে মৃত্যুবরণ করছেন। বিশেষ করে আমরা যখন জানি যে কোভিডে ফুসফুসের পর সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে লিভার, তখন এ নিয়ে সংশয়ের কোনো অবকাশই থাকতে পারে না।

লিভার রোগে আক্রান্ত হয়ে এদেশে যে প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক মানুষ মৃত্যুবরণ করছেন তাই নয়, এদেশে লিভার রোগের কারণে প্রতি বছর ব্যয় হচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থও। এক গবেষণায় দেখা গেছে, এদেশে ১০ লাখ হেপাটাইটিস বি ভাইরাস আক্রান্ত রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষার পেছনেই ব্যয় হয় প্রায় ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। একইভাবে হেপাটাইটিস বি আক্রান্ত ৫০ শতাংশ বাংলাদেশের নাগরিকের চিকিৎসার ব্যয় গিয়ে দাঁড়াবে ৩ বিলিয়ন ডলারে। এসব হিসাব-নিকাশও প্রায় ৫ বছরের পুরোনো। এখন অঙ্ক কষতে বসলে এই সংখ্যাগুলো বাড়বে বৈ কমবে না।

এমন বাস্তবতায় পৃথিবীর আর সব দেশের মতো বাংলাদেশও ২০৩০ সালের মধ্যে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস নির্মূলের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল ৩.৩ অর্জনে অঙ্গীকারবদ্ধ। আর এজন্য চ্যালেঞ্জটাও পাহাড়সম। শুধু যে কোভিড আমাদের লক্ষ অর্জনের পথে অনেকটা পিছিয়ে দিয়েছে তাই নয়, আমাদের এখনও ঘাটতি রয়েছে লিভার বিশেষজ্ঞ আর বিশেষায়িত লিভার চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানেরও। তার চেয়েও বড় চ্যালেঞ্জ মানুষকে সচেতন করা।

বিশ্বব্যাপী প্রতি ১২ জনে একজন হেপাটাইটিস বি বা সি ভাইরাসে আক্রান্ত হলেও এই আক্রান্ত মানুষগুলোর ১০ শতাংশেরও জানা নেই যে তারা এমন কঠিন রোগে ভুগছেন। এর বড় কারণ এসব রোগীর লিভার অনেকখানি ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়া পর্যন্ত তাদের রোগের তেমন কোনো লক্ষণ থাকে না বললেই চলে। কাজেই হেপাটাইটিস বি নির্মূলের এসডিজি গোলটি অর্জন করতে হলে সবার আগে জোর দিতে হবে জনসেচতনতা তৈরিতে আর ব্যাপকভিত্তিক স্ক্রিনিং কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে রোগী শনাক্ত করায়।

এই উদ্দেশ্য মাথায় রেখেই রোটারি ইন্টারন্যাশনাল ডিস্ট্রিক্ট ৩২৮১ হেপাটাইটিস বি ভাইরাস নির্মূলে ধারাবাহিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। এই কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়েছে। এই ডিস্ট্রিক্টের হাজারও সচেতন রোটারিয়ান এসডিজি গোল ৩.৩ অর্জনে বদ্ধপরিকর। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষকে সচেতন করে তোলা এবং হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের শনাক্ত করার জন্য রোটারির উদ্যোগে ডিস্ট্রিক্টব্যাপী অ্যাওয়ারনেস ও স্ক্রিনিং কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

একদিন যেমন ফিলিপিন্সের কিছু রোটারিয়ান পোলিও নির্মূলে উদ্যোগী হয়ে আজ বিশ্বকে পোলিওমুক্ত করায় রোটারিকে নেতৃত্বের আসনে বসিয়েছেন, বাংলাদেশের রোটারিয়ানরা প্রত্যাশা করে যে একদিন এই উদ্যোগটি মহীরুহে পরিণত হবে এবং বিশ্ব যেদিন সত্যি সত্যি হেপাটাইটিস বি মুক্ত হবে, সেদিন মানুষ রোটারি ইন্টারন্যাশনাল এবং সেই সাথে বাংলাদেশের রোটারিয়ানদেরও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।

লেখক: ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন ও
চেয়ার, হেপাটাইটিস ও থ্যালাসেমিয়া এ্যাওয়ারনেস ও প্রিভেনশন কমিটি
রোটারী ইন্টারন্যাশনাল ডিস্ট্রিক্ট ৩২৮১, বাংলাদেশ।

Print Friendly, PDF & Email