তোপ দেগেছে বিরোধীরা; আক্ষেপভরা কন্ঠে জবাব বাণিজ্যমন্ত্রীর

প্রকাশিতঃ 10:32 am | April 06, 2022

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:

নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে সংসদে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিকে তোপ দেগেছেন বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা। মঙ্গলবার (৫ এপ্রিল ) সংসদে বাণিজ্য সংগঠন বিল পাসের প্রক্রিয়ার সময় বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যরা রীতিমতো ক্ষোভ প্রকাশ করেন। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ হয়েছে এমন দাবিও তাদের। আক্ষেপভরা কন্ঠেই বিরোধীদের সমালোচনার জবাব দিয়েছেন মন্ত্রী টিপু মুনশি।

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার আন্তরিকভাবেই চেষ্টা করছে এবং সরকার কোথাও ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে না বলেও পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন রাজনীতিতে ৫৬ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এই মন্ত্রী। যুক্তিসঙ্গতভাবেই টিসিবির ট্রাক থেকে মানুষের পণ্য কেনার বিষয়টিকে নিয়ে গণমাধ্যমের বাগাড়ম্বরকে মোটা দাগে তুলে এনেছেন। বলেছেন, ‘একটি টিসিবির ট্রাক থেকে আড়াইশ মানুষকে পণ্য দেওয়া হয়। ছবি দেখানো হয় পণ্যের জন্য মানুষ দৌড়াচ্ছে। ৩০০ জন লাইনে দাঁড়ালে ৫০ জন পাবেন না। বাকি ২৫০ জন যে পণ্য পেয়েছেন সেটা দেখানো হয় না।’

বিরোধীরা যেভাবে তোপ দেগেছেন
সংসদে বাণিজ্য সংগঠন বিল পাসের ওপর আলোচনাকালে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, সিন্ডিকেটের স্বার্থে বিলটি আনা হয়েছে। এর মাধ্যমে সিন্ডিকেটকে উৎসাহী করা হচ্ছে।

বিএনপির সংরক্ষিত আসনের রুমিন ফারহানা বলেন, তেলের দাম বৃদ্ধি নিয়ে হইচই হলো। ১৫ দিনে সিন্ডিকেট এক হাজার কোটি টাকা উঠিয়ে নিয়েছে। সিন্ডিকেট হলো সরকার। সরকার আর সিন্ডিকেটের মধ্যে পার্থক্য নেই।

জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মুজিবুল হক বলেন, সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য কঠোরভাবে বাজার নজরদারি করতে হবে। সরকারের সহযোগিতা ছাড়া সিন্ডিকেট মূল্যবৃদ্ধি করতে পারে না। তিনি বলেন, বলা হয় যুদ্ধের কারণে দাম বেড়েছে। যেসব পণ্য আমদানি করা হয় সেগুলোর দাম বাড়তে পারে। যেগুলো যুদ্ধের আগে আমদানি করা হয়েছে এবং যেগুলো দেশি পণ্য সেগুলোর কেন দাম বাড়বে? প্রয়োজনে ভর্তুকি দিয়ে হলেও নিত্য পণ্যের দাম কমানোর দাবি জানান তিনি।

জাতীয় পার্টির শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, সাধারণ মানুষ এখন পুষ্টিমানের সঙ্গে আপস করতে বাধ্য হচ্ছে। শ্রীমঙ্গলে যে লেবু ২ টাকা সেটা ঢাকায় ২২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্যমন্ত্রীকে আবার যুদ্ধ করতে হবে।

বিএনপির হারুনুর রশীদ বলেন, গ্যাসের অভাবে ঢাকায় হাহাকার চলছে। গ্যাসের দাম, তেলের দাম সব বাড়ানো হচ্ছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। এক্ষেত্রে কিছু উদ্যোগ সরকার নিয়েছে। কিন্তু সেখানে স্বচ্ছতার অভাব আছে। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা জনপ্রতিনিধি হয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ছেন কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ক্ষমতার বলয়ে থেকে সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছে।

পীর ফজলুর রহমান বলেন, আজকে সংবাদপত্রে এসেছে তিনি (বাণিজ্যমন্ত্রী) গতকাল বাজারে গিয়েছেন এবং তিনি ২৮ টাকা কেজিতে ৫ কেজি পেঁয়াজ কিনেছেন। এখন মন্ত্রী যদি ঘোষণা দিয়ে একটু কাঁচা বাজার, সবজি বাজারসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে যেতেন মানুষও ওই বাজারে যেতে পারত এবং মন্ত্রীর মত কম দামে জিনিস কিনতে পারত। কারণ উনি যতই ভ্যাট কমিয়ে মূল্য কমানোর চেষ্টা করছেন, প্রকৃতপক্ষে বাজারে পণ্যের দাম অত কমে নাই।

তিনি বলেন, বাণিজ্যমন্ত্রী সজ্জন মানুষ। কিন্তু তিনি সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। যে কারণে প্রায় সময় সিন্ডিকেট দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। মন্ত্রী একজন অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী কিন্তু কেন তিনি সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না।

তিনি বলনে, সত্য স্বীকার করতে হবে। বাণিজ্যমন্ত্রী সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। সিন্ডিকেট করে তেলের দাম বাড়িয়ে হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে। কোনও ব্যবস্থা নিতে পারেননি।

গণফোরামের মোকাব্বির খান বলেন, বাণিজ্যমন্ত্রী দেশের শীর্ষস্থানীয় সফল ব্যবসায়ী। মন্ত্রী হিসাবে হিসাবে তিনি কতটুকু সফল সেটা বলতে না পারলেও, বাজারে গেলে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সেটি ভালোভাবে জানা যাবে।

তিনি বলেন, বর্তমান সরকার দাবি করে তারা ব্যবসাবান্ধব। যে সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী একজন ব্যবসায়ী, সেই সরকার জনবান্ধব নয়, ব্যবসাবান্ধব হওয়ায় স্বাভাবিক।

জাতীয় পার্টির রওশন আরা মান্নান বলেন, সরকার ধরলে দাম কমে আবার যখন সরকার শিথিলতা দেখায় তখন আবার দাম বাড়ে। একটার দাম কমলে আরেকটার দাম বাড়ে এটা একটা লুকোচুরি খেলার মত।

তেড়েফুঁড়ে নয়, ঠান্ডা মাথায় জবাবে আক্ষেপ বাণিজ্যমন্ত্রীর
তেড়েফুঁড়ে কথা বলাটা মোটেও ধাঁচে নেই বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির। নিজের ব্যবসায়ী পরিচয়কে প্রাধান্য দেওয়ার মাধ্যমে বরাবরই সমালোচকরা আড়াল করেছেন তাঁর ৫৬ বছরের বর্ণাঢ্য রাজনীতির ক্যারিয়ারকে। রাজনীতিতে নিজেকে উঠিয়ে এনেছেন ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমেই, একেবারেই তৃণমূল থেকে।

এলাম, দেখলাম স্টাইলে নয়, মাঠ রাজনীতিতে অভিজ্ঞতা থেকেই বাণিজ্যমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। ১৯৬৬ সাল থেকে রাজনীতির কন্টাকাকীর্ণ পথে নিজে যাত্রা করলেও এখনও সমালোচকদের চোখে ‘ব্যবসায়ী মন্ত্রী’ অভিধা স্বভাবতই তাঁর হৃদয়ে তৈরি করে গভীর ক্ষত। আক্ষেপভরা কন্ঠেই বিরোধী এমপিদের বক্তব্যের জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ধীর-স্থিরভাবেই তুলে আনেন নিজের পোড় খাওয়া রাজনীতির আদ্যোপান্ত।

বলতে থাকেন, ‘আমি বরাবরই লক্ষ্য করি একটা ব্যাপার কোনও কোনও সদস্য আমার মন্ত্রণালয়ের কোনও কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলেন যে বাণিজ্যমন্ত্রী নিজে ব্যবসায়ী সেহেতু সেই দিকটাকেই বেশি করে দেখানো হয়।

অথচ আমি ব্যবসা করি আজকে ৪০ বছর। রাজনীতি করি ৫৬ বছর। ৬৬ সাল থেকে রাজনীতি শুরু করেছি কিন্তু রাজনীতিবিদ হতে পারি নাই। এই ঢাকা শহরে অর্ধেকের সময় ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলাম ৭৩ সালে। ৬৯ সালে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার, উকিল যখন পার্লামেন্ট মেম্বার হয়, ডাক্তার যখন হয় তাকে কেউ বলে না যে উকিল কেন আসছে? কিন্তু আমি ব্যবসায়ী বলে আমার অপরাধ!’

বিশ্ব বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে বলেই বাংলাদেশেও দামে উর্ধ্বগতি সেই কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘যুদ্ধের কারণে ভোজ্য তেলের দাম বেড়েছে, এটা তিনি কখনও বলেননি। প্রতি মাসে তেলের দাম নির্ধারণ করা হয়। এখন বিশ্ব বাজারে ভোজ্য তেলের দাম বেড়েছে।’

মন্ত্রী বলেন, সরকার কোথাও ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে না। ব্যবসায়ীদের সহায়তা করে। যে কেউ চাইলে তেল আমদানি করতে পারে। সরকার সিন্ডিকেট এটা ভাবার কারণ নেই। সিন্ডিকেট বলে যাদের কথা বলা হচ্ছে তারা কেউ রাজনীতি করেন না, তারা কেউ এমপি নন। সরকার চেষ্টা করে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী প্রতিনিয়ত ফলোআপ করছেন।’

কালের আলো/ডিএসবি/এমএম

Print Friendly, PDF & Email