করোনা ভাইরাসের ধাক্কা সামলে টিকায় ‘স্বাভাবিক’ দেশ

প্রকাশিতঃ 10:47 am | March 28, 2022

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস হানা দেওয়ার পর থেকেই লকডাউন, শাটডাউন আর বিধিনিষেধের মধ্যে দিয়েই পরিচালিত হয়েছে যাপিত জীবন। কিন্তু ৭৫ ভাগ মানুষ করোনার টিকার আওতায় চলে আসায় সব ধকল কাটিয়ে আবারও পুরোদমেই যেন স্বাভাবিক হয়ে উঠতে শুরু করেছে দেশ। খুলে গেছে প্রাক-প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব শ্রেণিকক্ষ। অফিস-আদালতও চলছে স্বাভাবিক গতিতেই।

মানুষের সরব উপস্থিতিতে মুখর হয়ে উঠেছে পর্যটন কেন্দ্রগুলোও। সড়ক, রেল, নৌ, আকাশ পথে যাতায়াতেও নেই কোনো শর্ত বা বিধিনিষেধ। বাজার, দোকানপাট, শপিংমলগুলোতেও ক্রেতাদের ভিড়। মহান স্বাধীনতা দিবসের আনন্দে মাতোয়া হয়ে উঠে গোটা দেশ। মহামারির কারণে গত দু’বছর যে স্মৃতিসৌধে যাওয়া হয়নি শনিবার (২৬ মার্চ) ছিল পুরোপুরি ভিন্ন চিত্র।

প্রাণের টানে হাজার হাজার মানুষ ছুটে গেছেন সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে। আলো-আঁধারির ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাঙালি জাতির সূর্যসন্তানদের তাঁরা শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। ফুলে ফুলে ছেয়ে গিয়েছিল শ্রদ্ধাবেদী। করোনাভাইরাসের লাগামা টেনে ধরা সম্ভব হওয়ায়, এখন শুধু সংক্রমণ ঠেকাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পাশাপাশি মাস্ক পরার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার।

নতুন করে কেউ মারা না যাওয়ায় মৃত্যুহীন টানা চার দিন পার করেছে বাংলাদেশ। রোববার (২৭ মার্চ) এমন তথ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, করোনাভাইরাস সংক্রমণে মৃত্যুহীন আরেকটি দিন পার করেছে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে শনাক্ত কমে দাঁড়িয়েছে ৪৩ জনে। গত এক দিনে দেশে করোনার নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার দাঁড়িয়েছে শূন্য দশমিক ৫৪ শতাংশে। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৫৩টিতে কারও করোনা শনাক্ত হয়নি। আগের দিন ৫২ জেলা ছিল রোগীশূন্য। শনাক্ত হওয়া ৪৩ জনের মধ্যে ২৬ জনই ঢাকা বিভাগের।

একটু পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যায়, ২০২০ সালের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম থাবা বসায় প্রাণঘাতী করোনা। শনাক্ত হয় রোগী। প্রবলভাবেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে গোটা দেশ। এরপর আর ঠেকিয়ে রাখা যায়নি ভাইরাসটিকে। সংক্রমণ ছড়াতে ছড়াতে ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেশেই।

শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তায় ২০২০ সালের ১৭ মার্চ বন্ধ করা হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ২৬ মার্চ থেকে শুরু হয় লকডাউন। সড়কে মানুষের অযাচিত উপস্থিতির ওপর চলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি। মাঠে নামে দেশপ্রেমিক বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। লকডাউন পরিস্থিতি ও সাধারণ মানুষের সুরক্ষায় জীবন-মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করে সরকারপ্রধানের নির্দেশে জেলায় জেলায় কাজ করে সেনাবাহিনী।

সেনাবাহিনীর টহল কার্যক্রম ও মাঠ পর্যায়ের টহল দেখতে টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলা সফর করেন সেনাপ্রধান জেনারেল ড.এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ। সম্মুখ যোদ্ধা হিসেবে বুক চিতিয়ে লড়াই করে আইজিপি ড.বেনজীর আহমেদ’র নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ পুলিশ রচনা করে এক মহাকাব্য।

জানা যায়, প্রথম দফায় দেশে করোনা সংক্রমণ শুরুর প্রায় ১০ মাস পর ২০২১ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি নিয়ন্ত্রণে আসে। শুরুর কয়েক মাসে পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে ছিল। কিন্তু মে-জুনে এসে বদলে যায় দৃশ্যপট।

২০২১ সালের মার্চের শেষে আবার দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হানে। সেটি নিয়ন্ত্রণে আসে গত ৪ অক্টোবর। দেশে দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ন্ত্রণে আসতে সময় লাগে ৬ মাস। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স রুনু ভেরোনিকা কস্তাকে টিকা দেয়ার মধ্য দিয়ে দেশে করোনার টিকা প্রদান কর্মসূচি শুরু হয়।

বিপুল অর্থের দিকে না তাকিয়ে ৪০ হাজার কোটি টাকা খরচে সরকার দেশের ৭৫ ভাগ মানুষকে টিকার আওতায় আনতে সক্ষম হয়েছে। ভ্যাকসিনেশন প্রোগ্রামে বিশ্বের ২০০ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। সাধারণ মানুষকে টিকা প্রদান ও গ্রহণে উৎসাহিত করতে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করে সফল হয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব লোকমান হোসেন মিয়ার নির্দেশে পরিকল্পিত কর্মযজ্ঞে সফলতার স্বাক্ষর রাখেন মহাপরিচালক (ডিজি) আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলমের নেতৃত্বে গোটা স্বাস্থ্য বিভাগ।

প্রথম ডোজ, দ্বিতীয় ডোজ শেষে এখন বুস্টার ডোজ দেওয়া হচ্ছে। ১৮ ঊর্ধ্ব নাগরিকদের সবাইকে টিকার আওতায় আনার ঘোষণা পর মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদেরও টিকা দিচ্ছে সরকার। করোনাভাইরাসের প্রথম দুই ঢেউ যেভাবে আতঙ্ক ছড়িয়েছে, সে রকম হয়নি তৃতীয় ঢেউ। তুলনামূলক কম প্রাণঘাতী বলে এ নিয়ে ভীতিও ছিল বেশ কম।

করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রন তুলনামূলক দুর্বল। বিষয়টি জানা গিয়েছিল শুরুতেই। ধরনটি ব্যাপক সংক্রামক হলেও আক্রান্তদের মধ্যে শারীরিক জটিলতা কম থাকায় মৃত্যু কম। একইভাবে এটি তুলনামূলক দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আসার ইঙ্গিতও মিলছে। গত ২০ জানুয়ারি তৃতীয় ঢেউ নিশ্চিত হওয়ার পর আরও আট দিন সংক্রমণ ঊর্ধ্বগামী থাকার পর তা কমতে থাকে। এখন সেই তৃতীয় ঢেউ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শনাক্তের হার সর্বোচ্চ বা পিকে ওঠার পর দুই সপ্তাহ সেখানে অবস্থান করে ধীরে ধীরে তা নিম্নগামী হয়, কিন্তু এবার তা আরও আগেই নিম্নগামী হচ্ছে, যা বিশেষজ্ঞদের আশা দেখাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গত বৃহস্পতিবারের হিসাব মতে, নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার শূন্য দশমিক ৭৬ শতাংশে নেমে এসেছে, যা গত দুই বছরে সর্বনিম্ন।

করোনা মহমারিতে বিশ্ব অর্থনীতি বিপর্যস্ত হলেও বাংলাদেশ তা সামলে নিতে পেরেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার পাশাপাশি বেড়েছে মাথাপিছু আয়। ক’দিন আগেও স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, অন্যান্য দেশের তুলনায় করোনায় বাংলাদেশে করোনায় মৃত্যুর হার অনেক কম। ৩২ হাজার লোক মারা গেছেন। ভারতে ৫ লাখ ও শক্তিধর আমেরিকাতে ১০ লাখ মানুষ করোনায় মারা যায়। সেই তুলনায় বাংলাদেশ অনেক ভালো আছে। এখন ব্যবসা বাণিজ্য, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলছে।’

জানা যায়, প্রথম দফায় প্রায় দেড় বছর বন্ধ থাকার পর গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর থেকে ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করে শিক্ষাঙ্গনের দুয়ার। করোনার তৃতীয় ঢেউ আঘাত হানলে আবারও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সশরীরে ক্লাস বন্ধ করা হয় চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি। এ দফায় শিক্ষাঙ্গনে সশরীরে ক্লাস বন্ধ থাকে এক মাস। ২২ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষাঙ্গনগুলো আবার প্রাণচঞ্চল হয়ে ওঠে। ২ মার্চ শুরু হয় প্রাথমিকে সশরীরে ক্লাস। টানা দুই বছর বন্ধের পর গত ১৫ মার্চ প্রাক-প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের সশরীরে ক্লাস শুরু হয়। ১২ বছর ঊর্ধ্বে স্কুল পড়ুয়াদেরও আনা হচ্ছে করোনাপ্রতিরোধী টিকার আওতায়।

করোনাভাইরাস মহামারি শুরুর পর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে, গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় সশরীরে গিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর ঢাকার বাইরে গত সোমবার (২১ মার্চ) পটুয়াখালীতে কলাপাড়ার ধানখালীতে নির্মিত ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র সশরীরে গিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

দেশের বাইরে যুক্তরাষ্ট্র, স্কটল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, মালদ্বীপ ও আরব আমিরাতে রাষ্ট্রীয় সফর করেছেন। গত বৃহস্পতিবার (২৪ মার্চ) প্রথম নিজ কার্যালয়ে সশরীরে কোনো অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। স্বাধীনতা পুরস্কার বিজয়ীদের হাতে নিজে হাত পুরস্কার তুলে দিতেই ছুটে আসেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বহুদিন পরে মুক্তি পেলাম তো! আসলে করোনাভাইরাসের সময় তো একেবারে বন্দিখানায় ছিলাম। আজকে আমার একটা ইচ্ছা ছিল যে, এখানে এসে নিজের হাতে স্বাধীনতা পুরস্কার এটা তো একবার দিতে পারিনি। বারবার তো এভাবে নিজেকে বঞ্চিত করতে পারি না।’

বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দিতে পারাটাও সম্মানের জানিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘আমি মনে করি, বহুদিন পর অফিসে আসার সুযোগ পেলাম। এত দিন ডিজিটাল পদ্ধতিতে অনলাইনে চালাচ্ছিলাম। সে জন্য বোধহয় একটু বেশি কথা বলে ফেললাম। আপনারা কিছু মনে করবেন না।’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুসারে সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের বেশি থেকে এর নিচে নেমে গেলে সেটা যদি দুই সপ্তাহ নিচেই থাকে তাহলে সেই অবস্থাকে বলা হয় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে। উল্টো পথে যাত্রা অর্থাৎ সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের ওপরে দুই সপ্তাহ থাকলে সেটাকে পরবর্তী ঢেউ আঘাত হেনেছে বলে ধরা হয়। করোনার বিরুদ্ধে শক্তিধর অর্থনীতির দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের এই সন্তোষজনক অবস্থানের জন্য সরকারের নেয়া সিদ্ধান্তগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ মানছেন বিশেষজ্ঞরা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজরি কমিটির সদস্য ও জ্যেষ্ঠ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আবু জামিল ফয়সাল মনে করেন, এই সাফল্যের বেশ কিছু কারণ রয়েছে। তিনি বলেন, ‘কারণ একটি নয়, অনেকগুলো কারণ আছে। আমাদের দেশে দেখছি মানুষ মাস্ক কম পড়েছে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনেছে। মানুষ সচেতন ছিল। মানুষ যতোটা পেরেছে এই রোগ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেছে।’

চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ঝিনাইদহ, নাটোরে সংক্রমণে ঠেকাতে সরকারের নেয়া পদক্ষেপ, টিকার সংস্থান করা, গণটিকা কর্মসূচিরও এই সাফল্যের অন্যতম কারণ বলেও মনে করেন এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, ‘টিকা দেয়া হয়েছে, এটা ভালো দিক। এটাও একটা কারণ হতে পারে যে আমরা টিকা দিতে পেরেছি। যদিও সময় লেগেছে। কিন্তু টিকার তো একটা প্রভাব আছেই।’

কালের আলো/এসবি/এমএম

Print Friendly, PDF & Email