শেখ হাসিনাকে কদমবুচি করার শাস্তি কি তাঁকে এ আমলেও পেতে হবে?

প্রকাশিতঃ 12:38 am | October 05, 2017

একরামুল হক : ছাত্রজীবনে তিনি ছিলেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ডাকসাইটে নেতা। ময়মনসিংহস্থ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সোহরাওয়ার্দী হল ছাত্র সংসদের ছাত্রলীগ থেকে নির্বাচিত ভিপি। এছাড়া তিনি বাকৃবি শাখা বাংলাদেশ ছাত্রলীগেরও ভিপি ছিলেন। পড়াশোনা শেষ করে চাকরিজীবনেও একই রাজনৈতিক আদর্শ প্রবলভাবে বুকে ধারণ করে এসেছেন। সরকারি কর্মকর্তা হয়েও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে সবার সামনে কদমবুচি করে প্রমাণ করেছেন যে, তিনি কতটা আওয়ামী লীগ আদর্শে বিশ্বাসী। খোদ বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলেই সবার সামনে এমন দূরন্ত সাহস দেখালেন তিনি। কিন্তু এর জন্য তাকে কম খেশারতও দিতে হয়নি। তৎকালীন সরকার তার উপর প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়। বদলিসহ নানাভাবে হয়রানি ছাড়াও চরম শাস্তিস্বরূপ নিচের পদে নামিয়ে দেয়া হয়েছিল তাকে। অবাক হতে হচ্ছে, এই আওয়ামী লীগ আমলেও পদোন্নতি বঞ্চিতের তালিকায় তার নাম দেখে। বস্তুত, অবাক হওয়ার মতো ঘটনাই বটে!
প্রশাসনের ১১তম ব্যাচের এই কর্মকর্তার নাম ড. আবুল কালাম আজাদ। বর্তমানে তিনি ধর্মমন্ত্রীর একান্ত সচিব পদে আছেন। পদোন্নতির জন্য পর্যাপ্ত বেঞ্চ মার্ক বা যোগ্যতা সবই তার আছে। ক্রাইটেরিয়া অনুযায়ী কোন কিছুতেই ঘাটতি নেই। চাকরি সংক্রান্ত অন্য কোন সমস্যাও নেই। তারপরও কেন তিনি পদোন্নতি পেলেন না, এর জবাব নেই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কাছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আমল এখন। বর্তমান আওয়ামী লীগ আমলে ‘দলীয়করণ’ বহুল আলোচিত একটা ইস্যু। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাদেশে ‘দলীয়করণ’ ইতিহাসের সকল রেকর্ড ভঙ্গ হয়েছে এই আমলে। পদায়ন, পদোন্নতিসহ সকল বিষয়ে দল বা নিজেদের লোক কিনা সেটা পরখ করে দেখা হয়েছে এবং হচ্ছে। সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মাধ্যমে দফায় দফায় তদন্ত করে দেখা হচ্ছে- দলীয় পরিচয় কী? এমনও ঘটনা ঘটেছে, বিসিএস-এ নতুন নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদেরও যোগদানের সুযোগ দেয়া হয়নি দলীয় পরিচয় সন্দেহজনক বলে বিবেচিত হওয়ায়, যা জনপ্রশাসনের ইতিহাসে নজিরবিহীন বলা যায়। আর সেই চরম দলীয়করণের মধ্যেও ড. আবুল কালাম আজাদ পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছেন!
২০০৩ সালে ড. আবুল কালাম আজাদ ছিলেন গাইবান্ধার আরডিসি (সিনিয়র সহকারী সচিব পদমর্যাদায়)। শেখ হাসিনা বিরোধীদলীয় নেত্রী থাকাকালে ২০০৩ সালের ৩০ এপ্রিল গাইবান্ধা জেলা সফর করেন। শেখ হাসিনা সফরের সময় গাইবান্ধা শহরে বখাটের উৎপাতে পুকুরের পানিতে ডুবে মারা যাওয়া স্কুল ছাত্রী তৃষাকে দেখতে তাদের বাড়িতে যান এবং গাইবান্ধার জনসভায় ভাষণ দেন। তৃষাদের বাড়িতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে শেখ হাসিনা সার্কিট হাউসের সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় তার পায়ে হাত দিয়ে কদমবুচি ও কুশল বিনিময় করেন গাইবান্ধা জেলার তৎকালীন আরডিসি আবুল কালাম আজাদ। এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়া হয়। এরপর বিভাগীয় মামলায় তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং শাস্তিস্বরূপ সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে দুই বছরের জন্য নিম্নপদে নামিয়ে দেয়া হয়। এই কর্মকর্তার মূল পদ সিনিয়র সহকারী সচিব হলেও শাস্তির কারণে তাকে তখন সহকারী সচিব হিসেবে কাজ করতে হয়। শুধু পদাবনতি নয়, তার বেতনও ১০ হাজার টাকা কমে গিয়েছিল। এমনকি তার স্ত্রীকেও চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল। ফলে দীর্ঘদিন তাকে সংসার চালাতে গিয়েও হিমশিম খেতে হয়েছিল।
ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি তখন গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পূর্ব পরিচিত। ছাত্রজীবনে তিনি ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের ভিপি ছিলেন। সেই সুবাদে তিনি শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা হলে পায়ে হাত দিয়ে কদমবুচি করতেন। ঘটনার দিনও তিনি তা করেন। সরকারি কর্মকর্তা হয়ে তিনি এমনটি পারেন কিনা- এ প্রশ্নের জবাবে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, “সেই বিবেচনা তখন মাথায় আসেনি। শুধু মনে হয়েছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কন্যা সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।”
২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজরে আনা হলে তিনি ড. আবুল কালাম আজাদকে সেই শাস্তি থেকে অব্যাহতি দেয়ার নিদেশ দেন। কিন্তু, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশও বাস্তবায়ন করতে দীর্ঘদিন গড়িমসি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। অবশেষে সেই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটে। ২০১২ সালে ড. আবুল কালাম আজাদ পদোন্নতি পেয়ে উপসচিবও হন। সরকারের আস্থাভাজন কর্মকর্তা হওয়ায় বর্তমানে ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমানের একান্ত সচিব (পিএস) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে তিনি নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
কিন্তু দুর্ভাগ্য, ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের নেতৃত্বদানকারী বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের এই কর্মকর্তা বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছেন। গত বছরের ২৭ নভেম্বর প্রশাসনের তিন স্তরের ৫৭০ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়। ওই পদোন্নতির তালিকায় তার নাম না থাকায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বরাবর উল্লেখিত তথ্য জানিয়ে পদোন্নতি চেয়ে আবেদন করেন উপসচিব ড. আবুল কালাম আজাদ।
আবেদনে বলা হয়, ধর্মমন্ত্রী, ভূমিমন্ত্রী এবং একজন সংসদ সদস্য তার পদোন্নতির জন্য উপ-আনুষ্ঠানিক পত্র দিলেও কাজ হয়নি। একাদশ ব্যাচের মেধাক্রমে সর্বশেষ কর্মকর্তাসহ ১৮৬ জনকে যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি দেয়া হলেও তালিকায় তার নাম নেই। একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও প্রশাসনের দক্ষ কর্মকর্তা হিসেবে তিনি নিজেকে দাবি করেন।
তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কোন সদুত্তর পাননি ড. আবুল কালাম আজাদ। কেন তাকে পদোন্নতি বঞ্চিত করা হল, কী তার অপরাধ-অযোগ্যতা সেটি তিনি জানেন না। সমগ্র চাকরিজীবন বিবেচনায় আনলে দেখা যাবে, বিরোধীদলীয় নেত্রী থাকাকালে শেখ হাসিনার কদমবুচি করাটাই তার উল্লেখ করার মত অপরাধ। তাই প্রশ্ন হলো, এই অপরাধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলেও কী ড. আবুল কালাম আজাদকে শাস্তি ভোগ করতে হবে?।
(সাপ্তাহিক শীর্ষ কাগজে ২০১৭ সালের ১৪ আগস্ট প্রকাশিত)