অবসর ভাতা পেতে দ্বারে দ্বারে পৌনে এক লক্ষ শিক্ষক-কর্মচারী

প্রকাশিতঃ 10:42 am | May 12, 2025

কালের আলো রিপোর্ট:

অবসর সুবিধার ভাতার জন্য আবেদন করেও পাচ্ছেন না প্রায় পৌনে এক লক্ষ শিক্ষক-কর্মচারী। তাঁরা ঘুরছেন দ্বারে দ্বারে। ন্যায্য টাকার অভাবে জীবন সায়াহ্নে দিন কাটছে নিদারুণ কষ্টে। শিক্ষার আলো ছড়িয়ে তাঁরা জীবনের পুরো সময় ব্যয় করলেও প্রাপ্য অবসরকালীন সুবিধা বুঝে নিতে পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। টাকা না পেয়ে অনেকেই দারিদ্র্যের জালে আটকা পড়ছেন। মিলছে না সুচিকিৎসাও। কাটছে দুর্বিষহ দিন। অনাহারে-অর্ধাহারে থাকতে হচ্ছে পরিবারের সদস্যদের। কিন্তু আদৌ তাদের ভাগ্যে অবসর ভাতা জুটবে কীনা সেটিও অনিশ্চিত। অনেকেই অবসর ভাতা না পেয়েই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করছেন।

এরই মধ্যে গত ৩ মার্চ একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভা শেষে রাজধানীর এনইসি সম্মেলনকক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পেনশনের ৭-৮ হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। এটা সমাধানে অর্থ মন্ত্রণালয়ে ডিও লেটার দেওয়া হয়েছে। তবে কারা এবং কীভাবে এই অর্থ লুটপাট করেছে সেই ব্যাপারে স্পষ্ট কিছু বলেননি তিনি। এর আগে রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য জমানো ৬ হাজার কোটি টাকা যে ব্যাংকে রাখা হয়েছিল, সেটি দেউলিয়া হওয়ায় শিক্ষকদের সঞ্চয়ের কোনো টাকা এখন আর নেই।’

জানা যায়, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারী তাদের অবসর ভাতা পেতে অসহনীয় ভোগান্তির মুখে পড়েছেন। এদের মধ্যে সাড়ে ৩৯ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী ঘুরছেন বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের অর্থের জন্য। সবমিলিয়ে প্রায় ৮৩ হাজার শিক্ষক-কর্মচারীর আবেদন একসঙ্গে নিষ্পত্তি করতে অন্তত ৯ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন। অবসর ও কল্যাণ সুবিধার টাকার বড় একটি অংশ নেওয়া হয় শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছ থেকেই। অবসর সুবিধার জন্য চাকরিকালীন তাদের মূল বেতনের ৬ শতাংশ টাকা মাসে কেটে রাখা হয়। কল্যাণ সুবিধার জন্য কাটা হয় মূল বেতনের ৪ শতাংশ। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে বছরে ১০০ টাকা (৭০ টাকা অবসরের জন্য ও ৩০ টাকা কল্যাণের জন্য) নেওয়া হচ্ছে। বাকি টাকা সরকারি তহবিল ও চাঁদা জমার সুদ থেকে সমন্বয় করে দেওয়া হয়।

  • জীবন সায়াহ্নে দিন কাটছে নিদারুণ কষ্টে
  • পদে পদে শিকার হতে হচ্ছে হয়রানির
  • অনেকেই অবসর ভাতা না পেয়েই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করছেন
  • এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পেনশনের ৭-৮ হাজার কোটি টাকা লোপাট
  • সমস্যার কার্যকর সমাধান হচ্ছে না

জানা যায়, নিয়মিতভাবে এই তহবিলে কোনো বাজেট দেয়নি সরকার। মাঝেমধ্যে থোক বরাদ্দ হিসেবে সহায়তা দেওয়া হয়। অবসর সুবিধা হিসেবে এক জন শিক্ষক গড়ে ১২ লাখ টাকা এবং এক জন কর্মচারী ৬ লাখ টাকা করে পেয়ে থাকেন। কলেজের অধ্যক্ষ সর্বোচ্চ ৩৫ লাখ টাকা পর্যন্ত পান। এতে অবসর বোর্ডে বছরে প্রয়োজন হয় ১ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা; কিন্তু আয় হয় ৮৭৬ কোটি টাকা। এতে বছরে ঘাটতি থাকে ৫০৪ কোটি টাকা। অন্যদিকে কল্যাণ ট্রাস্টে শিক্ষকরা গড়ে ৮ থেকে ৯ লাখ টাকা পেয়ে থাকেন। এ সংস্থায় প্রতি মাসে গড়ে আবেদন জমা পড়ে ১ হাজার থেকে দেড় হাজার। প্রতি মাসে আবেদন নিষ্পত্তি করতে প্রয়োজন ৬৫ কোটি টাকা। এমপিওর ৪ শতাংশ হারে শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছ থেকে আয় আসে ৫০ কোটি টাকা। এফডিআরের লভ্যাংশ থেকে আয় হয় ২ কোটি টাকা। প্রতি মাসে ঘাটতি থাকে ১৩ কোটি টাকা।

অন্যদিকে, প্রায় ৮৩ হাজার শিক্ষক-কর্মচারীর আবেদন একসঙ্গে নিষ্পত্তি করতে অন্তত ৯ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন। কিন্তু লোপাট হয়ে গেছে পেনশনের ৭ থেকে ৮ হাজার কোটি টাকা। এর কি হবে? শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের প্রাপ্য টাকা পাবেন না? বা কত বছর পরে পাবেন? কেন তারা চাকরি শেষ হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে এটা পাবেন না? শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড এবং শিক্ষকরা হচ্ছে শিক্ষার মেরুদণ্ড। তাহলে সেই শিক্ষকদের এই যে ভোগান্তি, এই ভোগান্তি কি চলতেই থাকবে? এর-কি কোনো সুরহা হবে না? এমন প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই।

শিক্ষক নেতারা বলছেন, কারো টাকাই লোপাট হলো না, বেসরকারি শিক্ষকদের টাকা লোপাট হলো কেন? এর দায়িত্বে থাকা সকলকে আইনের আওতায় আনার পাশাপাশি দ্রুত অবসরে যাওয়া শিক্ষকদের পাওনা পরিশোধের দাবি জানিয়ে তারা বলেন, এই সংকটের সমাধান নির্ভর করছে এককালীন জরুরি বরাদ্দের ওপর, যা সরকারের পক্ষ থেকে এখনো নিশ্চিত করা হয়নি। অবসর ও কল্যাণ-সুবিধা বোর্ডের কর্মকর্তারা বলেন, শিক্ষকদের এই অসহায়ত্ব দেখে তারাও কিছু করতে পারছেন না। তারাও চান, সরকার দ্রুত এই সমস্যার সমাধান করুক।

রাজধানীর পলাশী-নীলক্ষেত এলাকায় বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) ভবনে কল্যাণ ট্রাস্ট ও বোর্ডের কার্যালয়। সম্প্রতি এই ভবনে গিয়ে দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক শিক্ষক-কর্মচারী এবং তাদের স্বজনেরা এসেছেন অবসর সুবিধার টাকা পাওয়ার খবর নিতে। কর্মকর্তারা তাদের বোঝাচ্ছিলেন। কিন্তু বাস্তবে সবাইকে নিরাশ হয়ে ফিরতে হয়েছে। সমস্যার কার্যকর সমাধান মিলছে না।

চন্দ্রা শখা হাই স্কুলের সরকারি কর্মচারী ছিলেন হুমায়ুন কবির। ২০১৮ সালে মারা যান তিনি। মৃত্যুর পরের বছর অবসর সুবিধা ভাতার আবেদন করে তার পরিবার। কিন্তু গত ছয় বছরেও সুবিধার টাকা এখনো পায়নি তারা। গত ছয় বছরে প্রায় ১৫ বারের মতো ঢাকায় এসেছেন প্রয়াত হুমায়ুন কবিরের ছেলে জসিম উদ্দিন। কয়েক বার কাগজ সংকটের কথা বলে অফিস এবং পরবর্তী সময়ে কিছু দিনের মধ্যে টাকা পেয়ে যাবে বলে আশ্বাস দেন অবসর সুবিধা বোর্ডের সদস্যরা। কিন্তু সেই আশ্বাসের বাস্তবায়ন আর হয়নি। জসিম উদ্দিন অভিযোগ করেন, আসলে ২০১৯ সালে আবেদনের পর আমাদের তদবির করার মতো লোক ছিল না, তাই টাকা পাইনি। এছাড়া আবেদনপত্রের কোনো সমস্যা থাকলে ফোন করে জানানো নিয়ম। কিন্তু আমাদের ফোন করে কিছু জানানো হয়নি বরং অফিসে এলে বিভিন্ন কাগজপত্র চাওয়া হতো।

একই রকম অভিযোগ করেন ২০২০ সালের এপ্রিলে অবসরে যাওয়া কুড়িগ্রাম টেপারকুটি দারুল উলুম দাখিল মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক গাজীউর রহমান। এরই মধ্যে অবসর জীবন পাঁচ বছর পার হতে চলেছে তার। কিন্তু অবসরভাতা ও প্রাপ্য আর্থিক সুবিধা কবে পাবেন জানেন না তিনি। অবসরে যাওয়ার পর আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কষ্টের জীবন পার করছেন তিনি। একই বছরের অক্টোবরে অবসরে গেছেন শরীয়তপুর ডামুড্যা পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে কর্মচারী রাশিদা বেগম। তাঁরও জীবন কাটছে অর্ধাহারে-অনাহারে।

এসব বিষয়ে অবসর বোর্ডের বর্তমান সচিব (রুটিন দায়িত্ব) অধ্যাপক জাফর আহমদ অর্থ বরাদ্দ না থাকার কারণে টাকা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘বিশাল একটা ঘাটতির মধ্যে রয়েছে বোর্ড। তাই টাকা থাকাসাপেক্ষে আমরা আবেদনের ক্রমিক নম্বর অনুসারে টাকা দিচ্ছি। আবেদনের ক্রমিক নম্বর ছাড়া আগে টাকা পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ সিরিয়াল মেইনটেইন করে একটা বোর্ডের মাধ্যমে টাকার অনুমোদন করা হয়। ফলে এখানে জালিয়াতির সুযোগ নেই।’

বোর্ডের অর্থ সংকট মেটানোর ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘মূল বেতন স্কেল বৃদ্ধিসহ নানা কারণে বিগত অনেক বছরের ঘাটতি পড়েছে বোর্ডে। ফলে আমরা নিয়মিতভাবে টাকা দিতে পারছি না। বর্তমানে সরকার যদি কোনো অনুদান দেয় তাহলেই কেবল সম্ভব দ্রুত সব আবেদন নিষ্পত্তি করা।’

কালের আলো/আরআই/এমকে