বিদেশগামীদের সঙ্গে করোনা টেস্ট নিয়ে প্রতারণা, হাতিয়েছেন কোটি টাকা

প্রকাশিতঃ 3:52 pm | February 24, 2022

নিজস্ব সংবাদদাতা, কালের আলো:

বিদেশগামী যাত্রীদের করোনা নেগেটিভ সনদ বাধ্যতামূলক হওয়ায় এদের ঘিরে প্রতারণার ফাঁদ পেতেছে একটি চক্র। স্যাম্পল দেওয়া বিদেশগামীদের টেস্টের আগেই পজিটিভ এসেছে বলে ফোন দেওয়া হতো। নেগেটিভ করে দেওয়ার আশ্বাসেই জনপ্রতি হাতিয়ে নিতো ৫-২০ হাজার টাকা!

এসব অভিযোগে প্রতারক চক্রের ১৪ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। বুধবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) রাতে কুমিল্লা, বাহ্মণবাড়িয়া ও রাজধানী ঢাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার ব্যক্তিদের কাছ থেকে প্রতাণার মাধ্যমে আত্মসাৎ করা প্রায় সাত লাখ টাকা ও প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত ১২০টি অবৈধ মোবাইল সিম, সিম এক্টিভেট করার ফিঙ্গারপ্রিন্ট মেশিন ও ৩২টি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার (২৪ ফেব্রুয়ারি)দুপুরে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন সংবাদ সম্মেলন এ প্রতারক চক্রের গ্রেফতারের বিস্তারিত তথ্য জানান।

গ্রেফতার ব্যক্তিরা হলো—মো. জসিম উদ্দিন (২২), মো. সুলতান মিয়া (১৯), মো. বেলাল হোসেন (৩১), মো. আবুল হোসেন (২৪), মো. আবদুল নূর (২১), মো. আলফাজ মিয়া (১৯), মো. শামিম (৩২), মো. আহাম্মদ হোসেন (১৯), মো. ইমরান উদ্দিন মিলন (১৯), মো. সবুজ মিয়া (২৭), মো. আব্দুর রশিদ (২৮), আব্দুল করিম চৌধুরী (৩২), মো. আঙ্গুর মিয়া (২৫) ও মো. আলমগীর হোসেন (২০)।

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, বিদেশগামী যাত্রীদের করোনা টেস্টের ফলাফল বদলে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া প্রতারক চক্রের ১৪ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। চক্রটি প্রায় এক বছর ধরে প্রতারণা করে আসছিল। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানী ঢাকা, কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন এলাকায় র‌্যাব-১১ অভিযান চালিয়ে তাদেরকে গ্রেফতার করে।

এ সময় তাদের কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে আয় করা সাত লাখ টাকা, প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত ১২০টি সিমকার্ড, ফিঙ্গার প্রিন্ট মেশিন, ট্যাব, ৩২টি মোবাইল ফোনসেট, একটি পাসপোর্ট, নোটবুক এবং চক্রের সদস্যদের বেতনের হিসাব বিবরণী জব্দ করা হয়।

গ্রেফতার প্রতারক চক্রের সদস্যদের বরাত দিয়ে খন্দকার আল মঈন বলেন, আবুল হোসেন নারায়ণগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়, আব্দুর নূর নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকা জেলায়, আহাম্মেদ হোসেন চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জ জেলায়, আব্দুর রশিদ ঢাকা ও নারায়নগঞ্জ জেলায়, আব্দুল করিম কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকা জেলায়, আলমগীর সিলেট, মৌলভীবাজার এবং হবিগঞ্জ জেলায়, আঙ্গুর মিয়া কুমিল্লা, মৌলভীবাজার এবং হবিগঞ্জ জেলায় করোনা টেস্টের জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে সকাল সাতটা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত অবস্থান করতেন। এ সময় তারা বিদেশগামী যাত্রী ছদ্মবেশে অবস্থান নিয়ে সাধারণ যাত্রীদের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করতেন।

নম্বর সংগ্রহ করে বেলাল ও সবুজকে পাঠাতেন তারা। বিদেশগামী যাত্রীরা তাদের প্রকৃত করোনা টেস্টের ফলাফল হাতে পাওয়ার আগেই বেলাল ও সবুজ সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের করোনা টেস্ট বিভাগের ডাক্তার অথবা হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ পরিচয় দিয়ে টেস্টের ফলাফল পজিটিভ এসেছে বলে জানাতেন। পরে পজিটিভ থেকে নেগেটিভ করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিতেন।

চক্রের অন্য সদস্য আলফাজ, জসিম, শামিম ও সুলতান একই সময়ে বেলাল ও সবুজকে বিভিন্ন জায়গার মোবাইল ব্যাংকিংয়ের নাম্বার সরবরাহ করতেন। ভুক্তভোগীরা বেলাল ও সবুজের কথা অনুযায়ী টাকা পাঠালে আলফাজ, জসিম, শামিম ও সুলতান তা সংগ্রহ করতেন। টাকা সংগ্রহের অবস্থান সব সময় ভিন্ন ভিন্ন জেলায় নির্ধারণ করা হতো, যাতে কেউ প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে না পারেন। একটি সিম একদিন ব্যবহার করে তা কিছুদিন বন্ধ রেখে পুনরায় ব্যবহার করা হতো। তবে কোনো ফোন নম্বর নিয়ে সন্দেহ হলে তা ফেলে দিতেন তারা। প্রতারণার পুরো কাজটি করতে যেসব সিম ব্যবহার করা হতো সেগুলো সরবরাহ করতেন মিলন। ১২০ টাকায় কেনা সিম চক্রের কাছে এক হাজার টাকায় বিক্রি করা হতো।

চক্রের কাছে শতাধিক সিম সরবরাহ করে আসছিলেন ইমরান উদ্দিন মিলন। তিনি ফুটপাতে সিম বিক্রির আড়ালে সাধারণ মানুষের ফিঙ্গার প্রিন্ট ব্যবহার করে সু-কৌশলে শত শত মোবাইল সিম তুলে নিতেন। ১২০ টাকায় কেনা প্রতিটি সিম ওই চক্রের কাছে এক হাজার টাকা করে বিক্রি করতেন মিলন।

র‌্যাবের লিগ্যাল আ্যন্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক জানান, প্রতারণার মাধ্যমে চক্রটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার কথা স্বীকার করেছে। চক্রের সদস্য সবুজ এক বছরে হাজারের অধিক বিদেশগামী যাত্রীর সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। চক্রটি প্রত্যেকের কাছ থেকে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিতো। সবুজ এই টাকা দিয়ে গ্রামের বাড়িতে একটি ভবন তৈরি করেছেন। অন্যদিকে বেলাল হোসেন প্রতারণার পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে যাতায়াত করেছেন। বেলালও ছয় শতাধিক বিদেশগামী যাত্রীদের সঙ্গে একই কায়দায় প্রতারণা করেছেন। এভাবে ৫০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার তথ্য জানিয়েছেন তিনি। চক্রের অন্য সদস্যরা প্রতিদিন হাজিরা ভিত্তিতে ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা করে পেতেন।

সাংবাদিককদের এক প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, এই চক্রের সদস্যরা দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন। তাদের টার্গেট ছিল বিদেশগামী যাত্রীরা। এসব মানুষের যারা তথ্য সংগ্রহ করতেন তাদেরকে দৈনিক ভিত্তিতে এক হাজার টাকা দেওয়া হতো। যারা মোবাইল ব্যাংকিং নিয়ে কাজ করতেন তাদেরকে দৈনিক ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা দেওয়া হতো।

এছাড়াও চক্রের সদস্যদের বিভিন্নভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে আলাদা আলাদা সেক্টরে কাজ করতে বলা হতো। কেউ মোবাইল ব্যাংকিং, হাসপাতাল থেকে তথ্য সংগ্রহ, মোবাইলে কথা বলা, পজিটিভ থেকে নেগেটিভ রিপোর্ট করাসহ নানা সেক্টরে কাজ করতেন তারা।

গ্রেফতার মিলনের বিষয়ে খন্দকার আল মঈন বলেন, এই চক্রের মিলন সিম সরবরাহের কাজ করতেন। তিনি রাস্তার পাশে মোবাইল সিম বিক্রির নামে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষদের কাছ থেকে বারবার ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে একাধিক সিম নিজে রেখে দিতেন।

কালের আলো/ডিএস/এমএইচএ