নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের খোঁজে

প্রকাশিতঃ 10:49 am | February 15, 2022

প্রভাষ আমিন:

স্বাধীনতার ৫০ বছর পর প্রথমবারের মতো আইনের আলোকে একটি নির্বাচন কমিশন গঠিত হতে যাচ্ছে। এটা স্বস্তির খবর হতে পারতো। কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়ায় অংশ নিচ্ছে না।

তাই স্বস্তিটা উবে গেছে নিমেষেই। নির্বাচন কমিশন নয়, বিএনপির মূল আগ্রহ নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে। তবে বিএনপি অংশ না নিলেও নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়া তো আর বসে থাকবে না। আইনের আলোকেই নির্ধারিত সময়েই নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে। তার মানে রাজনৈতিক জটিলতা নিয়েই আমাদের আগামী জাতীয় নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।

বিএনপির নির্বাচনকালীন সরকারের দাবি অনেক পুরোনো। এই দাবি সামনে রেখেই তারা কখনো নির্বাচন বর্জন করেছে, কখনো অংশ নিয়েছে। বিএনপির দাবি, যৌক্তিক হলেও তো নির্বাচন কমিশন গঠন থেমে থাকবে না। নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা যাই হোক, নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তো একটি নির্বাচন কমিশন লাগবে। আর সেটি গঠন নিয়েও বসে থাকার সুযোগ নেই।

তাই যে কোনোভাবে বিএনপিকে প্রক্রিয়ার মধ্যে রেখে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে পারলে সবচেয়ে ভালো হতো। তবে ভালো না হলেও বসে থাকার সুযোগ নেই। তাই আইনের আলোকে গড়া অনুসন্ধান কমিটি এখন সম্ভাব্য প্রধান নির্বাচন কমিশন এবং নির্বাচন কমিশনারের খোঁজে চিরুনি অভিযান চালাচ্ছে।

কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ আজই শেষ হচ্ছে। তবে রাষ্ট্রপতির কাছে ১০ জনের নাম পাঠানোর জন্য অনুসন্ধান কমিটির হাতে ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় আছে। তাই অন্তত ১০ দিন আগের নির্বাচন কমিশনকেই কাজ চালিয়ে যেতে হবে।

সংবিধানে আইনের আলোকে নির্বাচন কমিশন গঠনের কথা বলা হলেও, যেহেতু আইন ছিল না, তাই এতদিন রাষ্ট্রপতি তার ইচ্ছামতো কমিশন গঠন করতে পারতেন। তবে সর্বশেষ দুটি নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে। আগের দুটি সার্চ কমিটির সাথে এবারের কমিটির গুণগত কোনো পার্থক্য নেই। তবে এবারেরটি হয়েছে আইনের আলোকে।

মাত্র ১৫ কার্যদিবসের জন্য গঠিত হওয়া এ অনুসন্ধান কমিটির কাঁধে এখন গুরুদায়িত্ব। সাহসের সাথে, সততার সাথে সবাইকে নিয়ে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে পারবেন; এমন ১০ জন মানুষ খুঁজে বের করার দায়িত্ব তাদের। গোটা জাতি উন্মুখ হয়ে চেয়ে আছে তাদের দিকে।

১৮ কোটি মানুষের দেশে ১০ জন তেমন মানুষ খুঁজে বের করা সত্যি কঠিন। অবস্থাটা আসলে খড়ের গাদায় সুই খোঁজার মতো। অনুসন্ধান কমিটি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তির কাছ থেকে নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য সম্ভাব্য নাম চেয়েছিল।

সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী মোট ৩২৯ জনের নাম পেয়েছে কমিটি। এছাড়া দুদিনে তিন দফায় অনুসন্ধান কমিটি বিশিষ্ট নাগরিকদের সাথে বৈঠক করেছে। এই বৈঠকে নাম তেমন আসেনি, তবে অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু সুপারিশ এসেছে।

এটা ঠিক প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা নির্বাচন কমিশনার হওয়ার মতো যোগ্য লোকের সংখ্যা বাংলাদেশে ৩২৯ জন নয়, কয়েক হাজার আছে। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা বলে, যোগ্যতা যাই থাকুক, আইনের আওতায় একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করার মতো লোকের সত্যি অভাব দেশে।

সম্ভাব্য নতুন নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব অনেক বেশি। নানা কারণে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচন দুটি ভালো হয়নি। এ কারণে নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা দারুণভাবে কমে গেছে। মানুষ এখন আর ভোট দিতে যায় না। নতুন নির্বাচন কমিশনের প্রথম কাজ হলো নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা। কাজের মাধ্যমে তাদের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা তৈরি হয়। বিশিষ্টজনরা অনুসন্ধান কমিটিকে তেমন লোকই খুজেঁ বের করতে বলেছেন। শুরুর দিকে বিচারপতিরাই নির্বাচন কমিশনে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

আবু হেনার মাধ্যমে শুরু হয় আমলা আধিপত্য। এছাড়া নির্বাচন কমিশনার হিসেবেও বিচারপতি বা সামরিক-বেসামরিক আমলাদেরই বেছে নেয়া হতো। তবে বিশিষ্টজনরা নারী, সংখ্যালঘু এবং গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বদেরও কমিশনে অন্তর্ভুক্তির দাবি করেছেন। তবে একটা খুবই যৌক্তিক দাবি উঠে এসেছে, স্বাধীনতাবিরোধী কারও নাম যেন সুপারিশ করা না হয়।

স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও এমন একটি দাবি করতে হয়, এটি খুবই বেদনার। কিন্তু বেদনার হলেও এটাই বাস্তবতা। এখনও বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ আছে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধী কারও রাজনীতি করার অধিকার থাকা উচিত নয়। বাংলাদেশের সরকারি দল হবে স্বাধীনতার পক্ষে, বিরোধী দলও হবে স্বাধীনতার পক্ষে- এমন একটা বাংলাদেশের স্বপ্ন আমাদের। কিন্তু সমাজের নানান স্বাধীনতাবিরোধীরা সক্রিয়। তাই অনুসন্ধান কমিটিকে বিষয়টি মাথায় রাখতেই হবে।

সৎ, যোগ্য, সাহসী মানুষদের নাম সুপারিশ করার প্রস্তাবও স্বাভাবিক। তবে বিশিষ্টজনদের মূল কথা ছিল, কোনো দলীয় সরকারের সময়, সেটা বর্তমান সরকার হোক বা আগের দলীয় সরকার হোক; বিশেষভাবে সুবিধাভোগী কোনো ব্যক্তি যাতে নির্বাচন কমিশনে স্থান না পায়।

কোনো দলীয় সরকারের অধীনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া বা জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের মাধ্যমে সুবিধা পাওয়া বা অবসরে যাওয়ার পর কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া বা সরকারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সম্পর্ক আছে; এমন কেউ যাতে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ না পান; তার সুপারিশ করেছেন বিশিষ্টজনরা।

দফায় দফায় বৈঠকে বিশিষ্টজনরা যে সুপারিশ করেছেন, তা যথার্থ। একটি সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে তাদের আকাঙ্ক্ষাই পরিস্ফুট হয়েছে। বর্তমানে রাজনীতিতে যে অচলাবস্থা বিরাজ করছে, তা থেকে উত্তরণে একটি আস্থাশীল নির্বাচন কমিশন গঠন অতি জরুরি। তবে সমস্যাটা হলো, গত কয়েক দশকে গোটা দেশকে আমরা রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত করে ফেলেছি। হয় আপনি আওয়ামী লীগ, নয় আপনি বিএনপি। মাঝামাঝি কোনো জায়গা নেই।

এই যে অনুসন্ধান কমিটির ডাকে বিশিষ্টজনরা যাচ্ছেন; সেই বিশিষ্টজনরা কে কোন দলের সমর্থক তাও সবাই জানে। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে বেগম খালেদা জিয়া একবার বলেছিলেন, পাগল আর শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নেই। তার এই মন্তব্য নিয়ে অনেক হাসাহাসি হয়েছে। তবে কথাটি কিন্তু মিথা নয়।

বিচারপতি বলেন, আইনজীবী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক বলেন, সাংবাদিক বলেন, ডাক্তার বলেন, ইঞ্জিনিয়ার বলেন- সবাই রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত। সবাইকে চেনা যায়। তাই দলীয় সরকারের সুবিধাভোগী নন, কোনো দলের সাথে স্বার্থসংশ্লিষ্টতা নেই; এমন লোক খুঁজে বের করা আর সোনা দিয়ে একটা পাথরবাটি বানানোর চেষ্টা করা সমান কথা।

যতই নিরপেক্ষ হোন, গোপন ব্যালটে সবাই কাউকে না কাউকে ভোট দিয়েছেন। তাই শেষ বিচারে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ মানুষ পাওয়া হয়তো সম্ভব নয়। তবে চাইলে কোনো সরকারের সুবিধাভোগী নন, এমন লোক হয়তো পাওয়া যাবে। মনে মনে কোনো দলের পক্ষে সমর্থন থাকলেও, একজন মানুষ যদি সৎ হন, সাহসী হন, নৈতিকভাবে দৃঢ় হন; সরকারে যেই থাকুক, আইনের আওতায় একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করা তার পক্ষে অসম্ভব নয়। কিন্তু অতীতে বেশিরভাগ প্রধান নির্বাচন কমিশনারই এই ক্ষমতার প্রয়োগ করেননি, নিজেদের সারাজীবনের অর্জন বিসর্জন দিয়েছেন কমিশনে এসে। এবার যেন তার ব্যতিক্রম হয়। অনুসন্ধান কমিটি যেন সত্যিকারের সাহসী, সৎ, দৃঢ় নৈতিক চরিত্রের ১০ জন মানুষ খুঁজে কের করতে পারে।

১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২

লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।