রাজধানীতে হঠাৎ বেড়েছে অজ্ঞান পার্টির তৎপরতা
প্রকাশিতঃ 5:00 pm | February 14, 2022

নিজস্ব সংবাদদাতা, কালের আলো:
অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে এখন রাজধানীতে অজ্ঞান পার্টির তৎপরতা বেড়েছে। অসহায় হয়ে পড়ছেন সাধারণ মানুষ। র্যাব-পুলিশ সদস্যরাও অজ্ঞান পার্টির হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। প্রায় প্রতিদিনই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়ে নগদ টাকা পয়সাসহ মূল্যবান কাজপত্র হারাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এদের খাওয়ানো নেশা জাতীয় দ্রব্যের বিষক্রিয়ায় আবার কেউ কেউ প্রাণও হারাচ্ছেন। অজ্ঞান হয়ে গুরুতর আহত অনেকেই দীর্ঘ দিন চিকিৎসা নেয়ার পরও পুরোপুরি সুস্থ হচ্ছেন না। শুধু যে নেশা জাতীয় দ্রব্য খাইয়ে অজ্ঞান করে তাই নয়, এ চক্রটি নানা কৌশলে যানবাহনের ভিতরেই চোখ-মুখে বিষাক্ত মলম লাগিয়ে দিচ্ছে। এতে করে অনেকেই স্থায়ীভাবে অন্ধ হযে যাচ্ছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, রাজধানীর গুলিস্তান, গাবতলী, সায়েদাবাদ ও মহাখালী বাস টার্মিনাল, রেলওয়ে স্টেশন, লঞ্চ টার্মিনালসহ জনাকীর্ণ এলাকায় অজ্ঞান পার্টির আনাগোনা বেড়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, অজ্ঞান পার্টি চক্রের বিরুদ্ধে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা তেমন দৃশ্যমান নেই। তবে পুলিশের দাবি, ভুক্তভোগীদের অনেকেই থানায় অভিযোগ করেন না। অভিযোগ না করায় এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ারও তেমন সুযোগ থাকে না। বিশেষজ্ঞরা বলছে, সচেতনতার বিকল্প নেই। সচেতন থাকলে অজ্ঞান পার্টির খপ্পর থেকে রেহাই পাওয়া যাবে।
গত কিছুদিনের তথ্যে দেখা গেছে, গত শনিবার রাজধানীর মতিঝিলের এজিবি কলোনি এলাকায় অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে মো. বাবুল মিয়া (৫০) নামে এক রিকশাচালক। তাকে অচেতন করে রিকশাসহ টাকা-পয়সা নিয়ে যায়। ৯ ফেব্রুয়ারি গুলিস্তান গোলাপ শাহ মাজারের সামনে গ্যালাক্সি পরিবহন বাসে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা হালুয়া খাইয়ে অচেতন করে বাবা-ছেলের কাছ থেকে এক লাখ টাকা নিয়ে যায়। ৮ ফেব্রুয়ারি গুলিস্তানে রমজান আহমেদ (৫০) নামে এক ব্যক্তির টাকা ও মোবাইল ফোন খোয়া যায়। ৭ ফেব্রুয়ারি গুলিস্তানে মো. স্বপন (৩৩) নামে এক ফ্যাক্টরি মেকানিক এবং ৫ ফেব্রুয়ারি ধানমন্ডির ১৫ নম্বর এলাকায় মো. জাকির হোসেন (৩৭) নামে এক সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালক অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পরে। এ ছাড়া চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি রাজধানীতে অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়ে এক পুলিশ সদস্যের মৃত্যু হয়েছে। মারা যাওয়া পুলিশ সদস্য মীর আবদুল হান্নান আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) এএসআই ছিলেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল সূত্র জানায়, প্রতি মাসে ১৫ থেকে ২০ জন মানুষ অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে সেখানে চিকিৎসার জন্য যায়। চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারির ১০ তারিখ পর্যন্ত প্রায় অর্ধশতাধিক মানুষ অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে। এদের অনেকেই দীর্ঘমেয়াদে শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে।
রাজধানীর একাধিক পরিবহনের হেলপারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যাত্রী এক জায়গা থেকে উঠলে আমরা তাদের নির্দিষ্ট স্থানে নামিয়ে দিই। দেখা যায়, কেউ গাড়িতে উঠে ঘুমিয়ে যায়, কেউ মাথা নিচের দিক দিয়ে মোবাইল চাপে। সেক্ষেত্রে কে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পরে তা বোঝা যায় না। তবে গাড়িতে সচেতনতামূলক কথা লেখা থাকলেও তা কেউ দেখে না।
ডিএমপির জনসংযোগ ও গণমাধ্যম শাখার অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) হাফিজ আল আসাদ বলেন, অজ্ঞান পার্টি আগেও ছিল এখনও আছে। তবে ইদানীং অজ্ঞান পার্টির দৌরাত্ম্য বেড়েছে। এদের দৌরাত্ম্য থামাতে পুলিশের একটি বিশেষ দল মাঠে কাজ করছে। অনেককে ধরে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। তবে তাদের কোনোভাবেই নির্মূল করা যাচ্ছে না। এজন্য পথচারী বা যাত্রী সবাইকে সতর্ক হতে হবে। তিনি আরও বলেন, যে সচেতন থাকে সেই অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে না। সচেতনতার বিকল্প নেই। তাই কারও দেওয়া কিছু না খাওয়া ও কেউ কিছু দিতে চাইলেও না নেওয়া উচিত। সন্দেহ হলে পুলিশ বা জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ কল করা উচিত।
ডিএমপির গোয়েন্দা সংস্থার এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ‘অজ্ঞান পার্টির বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত আছে। ঢাকা মহানগরীতে আগের চেয়ে অজ্ঞান পার্টির তৎপরতা কম বা বেশি হয়েছে। তবে অনেক সদস্যকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। তারা কিছুদিন জেল খেটে আবার একই অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে আইন কঠিন হলে এ ধরনের প্রতারণা কমে যেত।’ তিনি আরও জানান, ‘অজ্ঞান ও মলম পার্টির সদস্যরা বেশিরভাগই গণপরিবহন ও ভাসমান অবস্থায় অপরাধ করে। তাই এসব চক্র থেকে রক্ষায় জনসাধারণকেই বেশি সতর্ক হতে হবে। বিশেষ করে চলার পথে কোনো অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্ক ও খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। এ ছাড়া কোনো ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে জানাতে হবে।’
এ বিষয়ে ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘শীতে ছিনতাই ও অজ্ঞান পার্টির দৌরাত্ম্য বেড়ে যায়। তাই আমাদের আরও সতর্ক থাকতে হবে। তাদের সম্পর্কে আরও বেশি তথ্য সংগ্রহ করে ব্যবস্থা নিতে হবে।’
ঢামেক হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের ডা. ফিরোজ আহমেদ জানান, ‘অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা মূলত রোরাজিপাম গ্রুপের ওষুধ ও রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে। খালি পেটে খেলে এর প্রতিক্রিয়া বেশি হয়ে থাকে। তবে এ ধরনের ওষুধ যাদের খাওয়ানো হয় তাদের যদি আগে থেকে হার্ট অ্যাটাক, উচ্চমাত্রার ডায়াবেটিস, রক্তচাপ ও লিভারের রোগ থাকে তাহলে মৃত্যুর ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। এ ছাড়া অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ার পর আক্রান্ত ব্যক্তিকে হাসপাতালে আনতে দেরি হলে মৃত্যুর ঝুঁকিও বেড়ে যায়।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক জানান, ‘অজ্ঞান পার্টি বেপরোয়াভাবে বেড়েছে। তাদের প্রধান টার্গেট থাকে সাধারণ যাত্রীরা। তারা বিভিন্ন স্থানে ছদ্মবেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। এদের হাত থেকে বাঁচতে সচেতনতার বিকল্প নেই। তবে যারা অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে, ঝামেলা এড়াতে তাদের অনেকে মামলা করে না। আবার মামলা বা গ্রেফতার হলেও স্বল্প সাজা ও জামিনে বের হয়ে যায়। এসব প্রতারণায় আইন কঠোর হওয়া উচিত। তাহলে এ ধরনের অপরাধ অনেকটা কমে যেত। আবার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ঝিমিয়ে যাওয়ায় অজ্ঞান পার্টির তৎপরতা বেড়ে গেছে। তাই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সজাগ থাকা দরকার।’
কালের আলো/ডিএসবি/এমএম