প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে সীমান্ত পরিস্থিতি কীভাবে উন্নতি করেছেন, জানালেন জেনারেল আজিজ

প্রকাশিতঃ 11:10 am | September 12, 2019

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো :

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক (ডিজি) হিসেবে সীমান্তে হত্যা বন্ধে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) সঙ্গে বৈঠকসহ বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন ওই সময়কার মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ।

নিজের চার বছরের মেয়াদে মাদকদ্রব্য ও চোরাই পণ্য আটক, চোরাচালানকারী গ্রেপ্তার, বিজিবির সদস্য ও কর্মকর্তাদের জীবনমান উন্নয়নে গ্রহণ করেন ইতিবাচক পদক্ষেপ।

আরও পড়ুন: ইন্দো-প্রশান্ত সেনাপ্রধানদের রোহিঙ্গা সমস্যা ও ভবিষ্যত পরিণতি সম্পর্কে বললেন জেনারেল আজিজ

বিজিবি’র ডিজি থাকাকালীন সীমান্তবর্তী দেশগুলোর স্থলবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নেও নজর কাড়েন বর্তমান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এ প্রধান। রয়েল থাই আর্মির কমান্ডার ইন চিফের আমন্ত্রণে থাইল্যান্ডের ব্যাংককে গত সোমবার (০৯ সেপ্টেম্বর) ১৯ টি দেশের সেনাপ্রধানের অংশগ্রহণে ইন্দো-প্রশান্ত সেনাপ্রধান সম্মেলনে নিজের সেই অভিজ্ঞতার চিত্রই বিশ্বমঞ্চে উপস্থাপন করেন জেনারেল আজিজ আহমেদ।

আরও পড়ুন: সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির কথা জানালেন সেনাপ্রধান

প্রায় চার বছর বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক (ডিজি) হিসেবে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান বলেন, স্থলবাহিনী, বিশেষভাবে সীমান্তসংলগ্ন দেশগুলোর বাহিনীর মধ্যে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলার কথা বলা সহজ; কিন্তু সীমান্তবিরোধ, রাষ্ট্রবহির্ভূত সন্ত্রাসীদের কর্মকাণ্ড, আন্তদেশীয় অপতৎপরতা, ফৌজদারি অপরাধসহ নানা বাস্তব কারণে তা অত্যন্ত কঠিন।

তিনি বলেন, সহযোগিতা বা তথ্য বিনিময়ের ঘাটতির কারণে সৃষ্ট সামাজিক নৈরাজ্য, সহিংসতা ও সন্ত্রাসের প্রভাব এক দেশের সীমানা পেরিয়ে সন্নিহিত পুরো অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে পারে।’

আরও পড়ুন: বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’

রাজনৈতিক, সামরিক, পরিবেশগত ও মানবিক নিরাপত্তার সবকিছুই সম্পর্কিত ও পরস্পর নির্ভরশীল বলেও মনে করেন সেনাপ্রধান। তিনি বলেন, ‘প্রথাগত বা অপ্রথাগত যা-ই হোক না কেন, একবিংশ শতাব্দীর প্রধান নিরাপত্তা হুমকিকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার সুযোগ নেই। এর রাষ্ট্রীয় সীমানা নেই।

এ সমস্যার সমাধান কেউ একা করতেও পারবে না। আগে কখনো এ-জাতীয় সংকট নিরসনে বৃহত্তর সহযোগিতার প্রয়োজন পড়েনি। সামরিক বাহিনী জাতীয় ক্ষমতার অন্যতম মৌলিক উপাদান বলে আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় সামরিক বাহিনীর ভূমিকাই প্রধান। একে অন্যের বিরুদ্ধে সমরশক্তি প্রয়োগ করে তা অর্জন করা যাবে না; বরং প্রয়োজন হবে পারস্পরিক সহায়তা, জ্ঞানের ও দক্ষতা বিনিময় এবং সমঝোতা’ যোগ করেন তিনি।

ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশের চমৎকার যোগাযোগের সম্পর্ক থাকলেও মিয়ানমারের সঙ্গে তা ছিল না বলেও জানান সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ। তিনি বলেন, ‘বিজিবির দায়িত্ব নেওয়ার পর অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে আমি অবিলম্বে মিয়ানমার সফর করি এবং একাত্তরে স্বাধীনতা লাভের পর প্রথমবারের মতো মিয়ানমার বিজিপির প্রধানকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানাই।

আমার মিয়ানমার সফর দুই দেশের সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। দুই দেশের সীমান্তরক্ষী প্রধানদ্বয়ের সভার পর উভয় দেশের বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দ্বিবার্ষিক বৈঠক এখনো অব্যাহত আছে। সেক্টর ও ব্যাটালিয়ন পর্যায়ে ত্রৈমাসিক বৈঠক ছাড়াও প্রয়োজন পড়লেই বৈঠক হচ্ছে।’

বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে তথ্য বিনিময়ের প্রায়োগিক ক্ষেত্রে সুফল বয়ে এনেছে বলেও মনে করেন সেনাপ্রধান। তিনি বলেন, ‘সীমান্তরক্ষীদের বিভিন্ন কমান্ড পর্যায়ে তথ্য বিনিময়, চোরাচালান রোধ, মানব পাচার, বিদ্রোহী, জঙ্গি ও অপরাধী দমনে সাফল্য নিশ্চিত করেছে; সীমান্ত উত্তেজনা হ্রাস, ভুল-বোঝাবুঝির অবসান এবং আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন করেছে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমরা ভারতের অভ্যন্তরে চোরাচালান ও মানব পাচারের কোনো তথ্য পেলে তা বিএসএফকে জানাই। এতে তারা যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। আমরা মানব পাচারের শিকার ব্যক্তিদের বিএসএফের সহায়তায় ভারতের অভ্যন্তর থেকে উদ্ধারও করে থাকি। এটা দুই দেশের সীমান্তরক্ষীদের পারস্পরিক আস্থা বাড়িয়েছে। মিয়ানমারের সঙ্গেও আমরা এ ধরনের তথ্য বিনিময় করার চেষ্টা করে চলেছি।’

বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যে স্টাফ টকের কথা জানিয়ে এ সেনাবাহিনী প্রধান বলেন, ‘পারস্পরিক বিশ্বাস, সহযোগিতা, প্রশিক্ষণ কার্যক্রম এবং ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্দেশ্যে ২০১৭ সালের জুন মাসে প্রথম স্টাফ টক অনুষ্ঠিত হয়। আমরা এখন মিয়ানমারে দ্বিতীয় স্টাফ টকের জন্য আলোচনা করছি।’

ডিসেম্বরে মিয়ানমার সফরের আমন্ত্রণ
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর প্রধান আমাকে আগামী ডিসেম্বরে মিয়ানমার সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, বলেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আমিও মিয়ানমার কমান্ডার ইন চিফ ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর প্রধানকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছি।’

প্রতিবেশী দেশের সীমান্তরক্ষীদের সঙ্গে পুনঃপুন বৈঠক অনুষ্ঠানের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘প্রতিবেশী দেশগুলোর সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে তৃণমূল পর্যায়ে নিয়মিত বা প্রয়োজনীয় সীমান্ত সম্মেলন অথবা পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এ ধরনের বৈঠক সীমান্ত সমস্যা নিরসনের জন্য সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে কার্যকর পর্যায়ে সমঝোতা ও আস্থা তৈরি করছে।’

চার বছর আগে রচিত হয়েছিল যে ইতিহাস
কোনো ইস্যু ছাড়াই ব্যাটালিয়ন ও কোম্পানি পর্যায়ে পুনঃপুন সৌজন্য সভা ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে কাঙ্খিত মাত্রার আস্থা সৃষ্টি করছে বলে মনে করেন সেনাপ্রধান। জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেন, ‘পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, প্রশিক্ষণ বিনিময়, শুটিং প্রতিযোগিতা, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা-সম্পর্কিত সেমিনার এবং পরিবারকল্যাণ সমিতি, স্কুলের ছাত্রছাত্রীসহ বিভিন্ন প্রতিনিধিদলের সফরের আয়োজন করা হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে বিজিবির জটিল রোগী ভারতে বিএসএফের হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসাসেবা নিচ্ছে। বিজিবির মহাপরিচালক থাকাকালে প্রধান অতিথি হিসেবে আমি বিএসএফের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ২০১৫ সালের ৮ আগস্ট ভারতের মধ্যপ্রদেশের টেকানপুর বিএসএফ একাডেমিতে প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করি। ভারত-বাংলাদেশ মডেল অনুসরণ করে আস্থা সৃষ্টির পদক্ষেপ হিসেবে আমরা মিয়ানমারের বিজিপির সঙ্গেও সফর বিনিময় ও খেলাধুলার আয়োজন করছি।’

কালের আলো/এএ/এমএএএমকে

Print Friendly, PDF & Email