শ্রম আইন ও তার বাস্তবায়ন

প্রকাশিতঃ 11:46 am | May 01, 2021

ড. উত্তম কুমার দাস :

বাংলাদেশ স্বল্প উন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হচ্ছে। ফলে শ্রমবাজার, শ্রমিকের অধিকার ও শ্রম আইনের প্রয়োগ আলোচনায় আসছে। বিশেষত, ইউরোপের বাজারে রফতানির ক্ষেত্রে যে জিএসপির আওতায় বিদ্যমান শুল্কমুক্ত সুবিধা মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হলে তা বজায় থাকবে না। তখন ‘জিএসপি প্লাস’ প্রযোজ্য হবে; আর তা পেতে হলে মানবাধিকার, শ্রম অধিকার এবং পরিবেশ ও টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখাতে হবে। আমরা তার জন্য সময় পাবো ২০২৭ সাল পর্যন্ত।

দেশে বেসরকারি পর্যায়ে শ্রমিক নিয়োগ ও তার শর্তাবলী দেখভাল করার জন্য প্রযোজ্য আইন হলো- বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬। যা মূলত পূর্বেকার ২৫ টি প্রাসঙ্গিক আইনকে রদ ও রহিত করে রচিত হয়েছে। তবে উক্ত শ্রম আইনের প্রধানতম দুর্বলতা হলো– এর সীমিত প্রয়োগ।

দেশের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে অধিকাংশ শ্রমিক নিয়োজিত; অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত শ্রমিক, কৃষিখামার (যেখানে পাঁচ জনের কম শ্রমিক নিয়োজিত) এবং গৃহকর্মীরা (শ্রমিক) শ্রম আইনের আওতার বাইরে।

শ্রমিক অধিকার নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের মতে, দেশের মোট শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ছয় কোটি; তার মধ্যে শতকরা মাত্র ১০ থেকে ১৫ ভাগ শ্রম আইনের আওতায়। দেশে যে রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা (ইপিজেড) রয়েছে তার জন্য রয়েছে আলাদা আইন (যাতে নানান সীমাবদ্ধতা রয়েছে); একই আইন বিশেষ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকায়ও প্রযোজ্য হচ্ছে।

তাই শ্রম আইনের প্রয়োগের ব্যাপ্তি বাড়ানো সময়ের দাবি। তা না হলে যারা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কিংবা গৃহকর্মে নিয়োজিত তাদের জন্য আলাদা আইন করা দরকার।

একই সঙ্গে বিদ্যমান শ্রম আইনে নানান অসঙ্গতি ও অস্পষ্টতা রয়েছে। আর যা আছে তারও প্রয়োগ না হওয়া বড় বিষয়।

শ্রম আইন বাস্তবায়ন ও তার প্রয়োগের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা সংশ্লিষ্ট মালিকপক্ষ বা নিয়োগকারীর। যেমন, সংশ্লিষ্ট শ্রমিক নিয়োগ ও তার চাকরির শর্তাবলী নির্ধারণ ও পালন; এর মধ্যে রয়েছে- নিয়োগপত্র প্রদান, আইন নির্ধারিত কর্ম-ঘণ্টা পালন, ছুটি মঞ্জুর, মজুরী পরিশোধ, পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতিপূরণ, চাকরি অবসানে আইন নির্ধারিত ক্ষতিপূরণ তথা সার্ভিস বেনিফিট প্রদান প্রভৃতি। আর নারী শ্রমিক হলে তার জন্য কর্মক্ষেত্রে হয়রানি প্রতিরোধ এবং প্রসূতিকালীন ছুটি ও সুবিধাদি প্রদান।

উল্লেখিত বিষয়সমূহ বাস্তবায়িত না হওয়ার পেছন প্রধানতম কারণ হলো সংশ্লিষ্ট বাস্তবায়নকারীর (নিয়োগকারী) অনীহা এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি তদারককারী সংস্থার দুর্বলতা। শ্রম আইনের ক্ষেত্রে তদারককারী সংস্থা হলো- সরকারের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতর। আর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন থাকলে এবং অংশগ্রহণকারী কমিটি ও ভবিষ্যৎ তহবিল ব্যবস্থাপনা প্রভৃতির ক্ষেত্রে শ্রম অধিদফতরেরও ভূমিকা রয়েছে।

বিদ্যমান শ্রম আইনের সীমাবদ্ধতার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- শ্রমিক ও মজুরীর সংজ্ঞা, প্রসূতিকালীন ছুটি ও সুবিধাদির ক্ষেত্রে পরস্পর বিরোধী বিধান [২(৩৪) ও ৪৮ ধারা], প্রসূতিকালীন সুবিধা ও চা বাগানে নিয়োজিত শ্রমিকসহ কতিপয় ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক বিধান, একই বিষয়ে আইনের বিভিন্ন ধারা ও অধ্যায়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতা প্রভৃতি।

শ্রম আইনে শ্রমিকের যে সংজ্ঞা তা খুবই ব্যাপক ও বিস্তৃত, আবার একই সঙ্গে শর্তারোপ করে তাকে সীমিত করা হয়েছে; যেমন, বলা হয়েছে- কোনও ব্যক্তি প্রধানত প্রশাসনিক, তদারকিমূলক কিংবা ব্যবস্থাপনামূলক কাজে নিয়োজিত থাকলে শ্রমিক সংজ্ঞার আওতায় পড়বেন না। তবে এইক্ষেত্রে কোন মানদণ্ড না দেওয়ায় উক্ত সংজ্ঞাকে (মূলতঃ নিয়োগকারীর পক্ষে) অপব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে। একই সঙ্গে যিনি শ্রমিক সংজ্ঞার আওতায় পড়বেন না তার নিয়োগ ও চাকরির শর্তাবলী কোন আইনবলে নির্ধারিত হবে সেই বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনও বিধান শ্রম আইন বা বিধিমালায় উল্লেখ নেই। প্রতিষ্ঠান ও কারখানায় কর্মকর্তারাও কাজ করেন; তাদের ক্ষেত্রে কোনও বিধান বা নির্দেশনা আইন দেয়নি। যেমন, শ্রম আইনে এটা বলা যৌক্তিক ছিল যে প্রতিষ্ঠান বা কারখানায় কর্মরত যারা শ্রম আইনের আওতায় পড়বেন না তাদের বিষয় দেখভাল হবে সংশ্লিষ্ট সার্ভিস রুলস দ্বারা, যা প্রণয়ন বাধ্যতামূলক।

এখানে মালয়েশিয়ার উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। তাদের আইনের বিধান হলো- মজুরীর বিনিময়ে কর্মে নিয়োজিত সকলেই কর্মচারী (এমপ্লয়ী) এবং তারা সার্ভিস বেনিফিটসহ চাকরিজনিত সকল সুবিধা পাবেন। তবে যে সকল কর্মচারীর মাসিক মজুরী ১,৫০০ (পনের শ’) রিঙ্গিত বা তার বেশি তারা কর্মচারী বটে, তবে শ্রমিক বলে গণ্য হবেন না, বা কোনও ট্রেড ইউনিয়নে যুক্ত হতে পারবেন না। অর্থাৎ ট্রেড ইউনিয়ন করতে গেলে মাসিক মজুরী ১,৫০০ (পনের শ’) রিঙ্গিতের কম হতে হবে।

আমাদের শ্রম আইনের ২(৪৫) ও ১২০ ধারায় মজুরীর যে সংজ্ঞা রয়েছে তাকে বাস্তবতার নিরিখে পরিমার্জনের সুযোগ রয়েছে। বিদ্যমান সংজ্ঞায় প্রসূতিকালীন সুবিধা নির্ধারণে জটিলতা হচ্ছে; বিশেষত করোনাজনিত কিংবা কোনও অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে।

নারী শ্রমিকের ক্ষেত্রে প্রসূতিকালীন মজুরীসহ ছুটি এবং সুবিধা কীভাবে নির্ণীত হবে তার জন্য আরও সুস্পষ্ট বিধান দরকার [২(৩৪) ও ৪৮ ধারা]। এইক্ষেত্রে একটি বৈষম্যের বিষয় হলো- ২০১৮ সনের সংশোধনীর মাধ্যমে যুক্ত করা হয়েছে যে, কোন নারী শ্রমিক নির্ধারিত প্রসূতিকালীন ছুটিতে যাওয়ার নির্ধারিত তারিখের পূর্বে গর্ভপাত হলে তিনি প্রসূতি কল্যাণ সুবিধা পাবেন না। সংশোধিত ধারায় বলা হয়েছে, ‘তবে তিনি স্বাস্থ্যগত কারণে ছুটির প্রয়োজন হইলে তিনি তাহা ভোগ করিতে পারিবেন।’ (৪৭ ধারা)।

কিন্তু উক্ত বিধানে এটি বলা হয়নি যে এই ‘স্বাস্থ্যগত কারণে ছুটি’ কি মজুরীসহ হবে না-কি বিনা মজুরীতে হবে।

বাস্তবতা হলো উক্ত ছুটিকে নৈমিত্তিক ছুটি (১১৫ ধারা), পীড়া-ছুটি (১১৬ ধারা) এবং মজুরীসহ বাৎসরিক ছুটির (১১৭ ধারা) সঙ্গে সমন্বয় করা হচ্ছে। যা আইনের ৪৭ ধারার উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এবং সংশ্লিষ্ট নারী শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

আরেকটি বিষয়, বেসরকারি ক্ষেত্রে (শ্রম আইনের বিধান মতে) প্রসূতিকালীন ছুটি হলো ১৬ (ষোল) সপ্তাহ। যা সরকারি কর্মচারীদের ক্ষেত্রে ছয় মাস (২৪ সপ্তাহ)। একই দেশে দুই বিধান বৈষম্যমূলক এবং সংবিধানের ২৭ ও ২৮ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। প্রসূতিকালীন ছুটির ক্ষেত্রে হাসপাতালের ও চিকিৎসা ব্যয়সহ (জটিলতাভেদে) আরও কিছু সুবিধাদি যুক্ত করা দরকার।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শ্রম আইনে নারী শ্রমিকের নিয়োগ ও চাকরির শর্তাবলী নিয়ে আলাদা কোনও বিধান নেই। যা থাকা দরকার। এছাড়া আইনের উদ্দেশ্য লিঙ্গসমতা (জেন্ডার) ও তার প্রসার বিষয়ে সুস্পষ্ট বিধান যুক্ত করা দরকার। আইনে ব্যবহৃত ‘মহিলা শ্রমিকের’ বদলে ‘নারী শ্রমিক’ বলে পরিবর্তিত হওয়া দরকার।

কর্মক্ষেত্রে নারীর যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও প্রতিকারের সুস্পষ্ট বিধান দিয়ে মাননীয় হাইকোর্ট বিভাগ ২০০৯ সনে যে নির্দেশনা (এক রীট পিটিশনের রায়ে) দিয়েছেন তার দৃশ্যমান বাস্তবায়ন দীর্ঘ এক যুগেও হয়নি। করা হয়নি কোনও আলাদা আইন কিংবা বিদ্যমান শ্রম আইনে কোনও পৃথক অধ্যায় বা ধারা। যা করা এখন সময়ের দাবি।

কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি যৌন হয়রানিকে একেক দেশ একেকভাবে মোকাবিলা করেছে; যেমন- শ্রীলংকা তাদের দণ্ডবিধিতে পৃথক ধারা যুক্ত করেছে; এতে সংজ্ঞা ও শাস্তির বিধান রয়েছে। আবার ভারত ২০১৩ সনে পৃথক আইন করেছে।

শ্রম বিধিমালা প্রণয়ন করা হলেও তা কতিপয় ক্ষেত্রে উপকারের চেয়ে বেশি জটিলতা সৃষ্টি করেছে। আর এইক্ষেত্রে লক্ষ্য হওয়া উচিত একটি বিশাল বিধিমালা নয়। বরং বিভিন্ন বিষয়ে ছোট ছোট বিধিমালা তৈরি এবং সময়ের প্রয়োজনে তার সংশোধন-পরিমার্জন। শ্রম আইনের বিধানমতে যা করা সম্ভব; বিধিমালা করার ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় বা দফতরের।

শোভন কাজের (ডিসেন্ট ওয়ার্ক) মানদণ্ড হলো- যোগ্যতা অনুযায়ী কাজের সুযোগ, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও তার পরিবার-পরিজন নিয়ে চলার মতো উপযুক্ত মজুরী বা আয়, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও পেশাগত স্বাস্থ্য, নিয়োগ ও চাকরির শর্তাবলী নিয়ে কথা বলা ও দর-কষাকষির সুযোগ, এবং সামাজিক সুরক্ষা (চাকরির অবসানজনিত সুবিধাদিসহ)।

বেসরকারি খাতের চাকরিজীবীদের জন্য সার্বজনীন পেনশন চালু করা সময়ের দাবি। বিশেষ করে সামাজিক সুরক্ষার জন্য তা দরকার। দেখা যাচ্ছে কোনও একজন ব্যক্তি ২০/২২ বছর কিংবা আরও বেশি সময় চাকরি করছেন। কিন্তু অবসরসহ যে কোনও কারণে চাকরির অবসান হলে তিনি শ্রমিক নন, কিংবা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে ‘সার্ভিস রুলস’ না থাকা- এমন নানান অজুহাতে চাকরিজনিত কোনও সুবিধা দেওয়া হচ্ছে না। লোকজনও এইসকল বিষয়ে আইনগত প্রতিকার পেতে সচেতন নয়।

এই জন্য পেনশন-পদ্ধতি চালু করা প্রয়োজন। যা পরিচালিত হবে সরকারি ব্যবস্থাপনায়। মালিক-শ্রমিক আইন নির্ধারিত হারে মাসিক হিসাবে (টাকা) জমা দেবেন। একজন শ্রমিক বা কর্মচারীর নির্দিষ্ট পেনশন নম্বর থাকবে; তিনি তাঁর কর্মস্থল (প্রতিষ্ঠান) পরিবর্তন করলেও চাকরি থেকে অবসর বা তার অবসান না হওয়া পর্যন্ত জমা প্রদান বহাল থাকবে। পরে সুদসহ এককালীন কিংবা কিস্তিতে তা ফেরৎ পাবেন। এই পেনশন নিয়ে নানান কিছু শোনা গেলেও দৃশ্যমান অগ্রগতির দেখা নেই। এইক্ষেত্রে শ্রীলংকার উদাহরণ প্রণিধান যোগ্য।

আইনকে প্রয়োজনমতো অবশ্যই সংশোধন করতে হবে। তবে তা অবশ্যই নিজেদের বাস্তবতায় ও প্রয়োজনে। কোনও সুপারিশ কিংবা চাপে নয়।

দৃশ্যমান প্রবণতা হলো আইনের বাস্তবায়ন কৌশল নির্ধারণ ও প্রয়োগের চেয়ে তার সংশোধন নিয়ে ব্যস্ততা। অথচ প্রাধান্য হওয়া উচিত প্রথমটি। শ্রম বিষয়ক একজন আইনজীবী হিসেবে আমার মত হলো আইনের দৃশ্যমান অস্পষ্টতা, বিভিন্ন অধ্যায়ের স্ব-বিরোধিতা, আইনে বিদ্যমান বৈষম্যমূলক বিধান প্রভৃতি সংশোধনপূর্বক এর পূর্ণ বাস্তবায়নে সরকার ও সংশ্লিষ্টদের মনোযোগ, সময় ও সম্পদ নিয়োজিত করা দরকার। শ্রম আইনের যথাযথ পঠনপাঠন, কার্যকর গবেষণা এবং আইনি ও বিচারিক কার্যক্রম প্রভৃতির দিকে মনোযোগ দরকার। এইক্ষেত্রে দরকার জাতীয় কর্ম-পরিকল্পনা। আমাদের জাতীয় মানদণ্ড সুগঠিত হলে তবেই আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের বাস্তবায়ন সহজ ও বিন্যস্ত হবে।

লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এবং শ্রম ও চাকরি সংক্রান্ত আইনে বিশেষজ্ঞ আইনজীবী।

Print Friendly, PDF & Email