করোনার চেয়েও দুশ্চিন্তার অথচ আমরা নির্বিকার!

প্রকাশিতঃ 11:20 am | January 16, 2021

ডা. পলাশ বসু :

বিশ্বব্যাপী এখনও এক আতঙ্কের নাম করোনাভাইরাস। কারণ বিশ্বের নানা প্রান্তে এর আক্রমণে প্রতিনিয়ত মানুষ মারা যাচ্ছে। অনেকে করোনাপরবর্তী জটিলতায় ভুগছেন। স্বাভাবিক কাজকর্ম তারা করতে পারছেন না। অনেকে কর্মঘন্টা কমিয়ে দিয়ে কোনোমতে রুটি-রুজির দিকটা ধরে রেখেছেন। অনেকের শারীরিক জটিলতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে তাদেরকে এখন নিয়মিত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হচ্ছে।

এ অবধি জন হপকিন্সের তথ্য মতে বিশ্বে মোট ৯ কোটির উপরে মানুষ করোনা সংক্রমিত হয়েছেন। মারা গেছেন সাড়ে ১৯ লাখের মতো। আর পরিসংখ্যান বলছে এ সময়ে আমাদের দেশে সংক্রমিত হয়েছেন পাঁচ লাখ চব্বিশ হাজারের মতো মানুষ। তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তুলনায় আমাদের এখানে মৃত্যুহার তুলনামূলকভাবে কম বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ এ অবধি মারা গেছেন ৭ হাজার আটশ এর কিছু বেশি সংখ্যক মানুষ। যদিও মৃত্যুর সংখ্যা আগামীতে আরো বাড়বে। কারণ প্রতিনিয়ত কিছু না কিছু মানুষ যেহেতু মারা যাচ্ছেন সেহেতু এ সংখ্যা শেষ অবধি কোথায় গিয়ে থামবে তা অগ্রিম বলাটা মুশকিলই বটে।

পরিশেষে প্রশ্ন একটাই- বছর বছর ঘটে চলা মানুষের মৃত্যু ও স্বাস্থ্যঝু্ঁকি বিবেচনায় নিয়ে বায়ুদূষণ রোধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কি পরিকল্পিত ও স্থায়ীভাবে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে না? কাজটা কি খুবই কঠিন? নাকি অসম্ভব? নাকি এটাই আমাদের ভাগ্যলিখন?

অথচ বছর বছর ধরে আমাদের দেশে বায়ুদূষণে মানুষ মরছে বর্তমানের আতঙ্ক করোনা ভাইরাসের চেয়ে কয়েক গুণ। সেদিকে আমরা কিন্তু নজর দিচ্ছি না ঠিকঠাকভাবে। বরং অদৃশ্য এই মৃত্যুকূপকে আমরা সাদরে বাড়তে দিচ্ছি। কোথায় আমরা সচেতন হব, বায়ুদূষণ বন্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেব সেটা না করে বরং উল্টো কাজটিই করছি। এর ফলে বর্তমান সময়ে বায়ুদূষণের মাত্রা বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। আর এর পরিণতিতে যে কত মানুষের অকাল মৃত্যু হচ্ছে তার খবর আমরা পরিসংখ্যানগতভাবে রাখলেও সেদিকে কি কার্যকর দৃষ্টি দিচ্ছি নাকি দিতে পারছি?

বরং মাঝেমধ্যে তো আমাদের হাবভাবে মনে হয় আমরা ইচ্ছাকৃতভাবেই এটাকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনছি না। কারণ বায়ুদূষণ রোধের জন্য আমাদের কর্তাব্যক্তিদের জন্য হাইকোর্টের নির্দেশনা লাগে। তখন তারা নড়েচড়ে বসেন কয়েকদিনের জন্য। রাস্তায় অপর্যাপ্ত ও অপরিকল্পিত পানি ছিটিয়ে তাদের দায় শোধ করে থাকেন। আর ভাবেন তারা বায়ুদূষণের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে কাজ সেরে ফেলেছেন।

জাগো নিউজের একটি রিপোর্টে চোখ রাখলে আমরা দেখতে পাচ্ছি সেখানে লেখা হয়েছে “টেলিগ্রাফের তথ্যমতে, ২০১৯ সালে ধূলিকণা দূষণে বাংলাদেশের অবস্থা ছিল বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ। আর রাজধানী ঢাকা বর্তমানে বিশ্বের ২১তম দূষিত শহর।” সেই রিপোর্টেই এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্সের বয়ানে বলা হয়েছে যে, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে বায়ুদূষণের কারণে ১ লাখ ৭০ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেছেন।

অন্য একটি পত্রিকার ২০১৭ সালে প্রকাশিত একই প্রতিবেদন বলছে সে বছর মারা গেছে ১ লাখ ২২ হাজারের মতো মানুষ। কী ভয়ংকর অবস্থা! করোনার চেয়ে এই যে বছর বছর আমাদের দেশে বায়ুদূষণে লাখের উপরে মানুষ মরছে, দিনে দিনে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছেই এর দায় তাহলে কার? বস্তুত করোনার মতো বায়ুদূষণে মৃত্যু তাৎক্ষণিক চোখে দেখা যায় না বলেই হয়ত এই ধরনের নীরব অপঘাতে মৃত্যুকে আমরা অন্ধ ও বধিরের মতো মেনে নিচ্ছি। স্বাভাবিক বুদ্ধি ও বিচার বিবেচনায় এটা কিন্তু মেনে নেয়ার মতো বিষয় না।

কিন্তু এ অবস্থা আর কত দুর্ভোগ পোহানো করা যায় বলুন তো? কারণ এ বছরও আমরা বায়ুদূষণে বিশ্বকে টেক্কা দিয়েছি। ২০২০ সালের নভেম্বর, ডিসেম্বর এবং এ বছরের জানুয়ারি মাসের এ কয়দিনের মধ্যে আমরা সময়ে সময়ে বায়ুদূষণে প্রথম হয়েছি। দিল্লী, লাহোর, করাচি, কাঠমন্ডুসহ অন্যান্য দূষণপ্রবণ শহরকে আমরা বেশ পেছনে ফেলে দিয়েছি। এমনিতেই শ্বাসকষ্ট, ক্যান্সার, হৃদরোগের রোগীরা করোনার এ সময়ে চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছেন। তার উপরে যদি বায়ুদূষণ এভাবে বাড়তে থাকে তাহলে স্বাস্থ্যঝুঁকি যে চরমমাত্রায় পৌঁছবে তাতে কি কোন সন্দেহ থাকে বলুন তো?

পরিশেষে প্রশ্ন একটাই- বছর বছর ঘটে চলা মানুষের মৃত্যু ও স্বাস্থ্যঝু্ঁকি বিবেচনায় নিয়ে বায়ুদূষণ রোধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কি পরিকল্পিত ও স্থায়ীভাবে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে না? কাজটা কি খুবই কঠিন? নাকি অসম্ভব? নাকি এটাই আমাদের ভাগ্যলিখন?

লেখক : চিকিৎসক ও শিক্ষক। সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, এনাম মেডিকেল কলেজ।