করোনা পরবর্তী মানসিক পুনর্বাসন জরুরি
প্রকাশিতঃ 8:32 am | August 05, 2020

ডা. পলাশ বসু :
করোনাকে আমরা এখনও মূলত শারীরিক সমস্যা হিসেবেই দেখছি। সেভাবেই আমরা এর চিকিৎসাও দিয়ে যাচ্ছি। আমরা শারীরিক দূরত্ব মেনে স্বাস্থ্যবিধি পালনের কথা বলছি। সম্প্রতি মাস্ক পরার বাধ্যবাধকতা নিয়ে সরকারি আদেশও জারি হয়েছে। এসবের প্রয়োজন কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। কারণ রোগের বিস্তার ঠেকানো এবং তার চিকিৎসা অবশ্যই সবার আগে গুরুত্ব পাবে। তবে যেকোনো দুর্যোগে, দুর্বিপাকে, মহামারিতে এটাই একমাত্র কথা নয়।
কারণ এ ধরনের কঠিন সময়ের ভেতরে যারা পড়েন বা মহামারিতে আক্রান্ত হন তারা চরমতম মানসিক চাপের মধ্যে পড়ে যান। পরিবারবিচ্ছিন্নতা থেকে শুরু করে সমাজবিচ্ছিন্নতা, একাকিত্ব, মৃত্যুঝুঁকি এসবের কারণে একটা পাথরসময় বুকের উপর চেপে বসে যায়। অনেকে এ চাপ সহ্য করতে না পেরে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। ফলে তাদের মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যায়। সেই সাথে আগে থেকেই যদি শারীরিক জটিলতা থেকে থাকে তাহলে তা ভয়াবহ রকম খারাপ হয়ে যেতে পারে। পরিণতিতে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোকের মতো ঘটনার শিকার হয়ে মানুষটি মহামারিতে হয়তো আক্রান্ত না হয়েও আচমকা মারা যেতে পারেন।
অথবা মহামারিতে যেন আক্রান্ত না হই বা আক্রান্ত হয়েই গেলাম কিনা- অবচেতন মনে এই যে ভাবনা মহামারিকেন্দ্রিক চলতে থাকে এটাও মানসিক অবসাদগ্রস্ততার একটা বড় কারণ হয়ে ওঠে। সেই সাথে চাকরি না থাকা, বেতন কমে যাওয়ার মতোও ঘটনা ঘটলে তো বিষয়টা ভয়াবহ উঠতে পারে। এতে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যেতে পারে। ঘুম কম হতে পারে। বিষন্নতা, উদ্বিগ্নতা এসব মনের ভেতরে বাসা বাঁধতে পারে। ফলে পারিবারিক অশান্তি তৈরি হতে পারে। আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটতে পারে।
করোনাকালে আমরা কিন্তু মানসিক এমন সকল সমস্যারই মুখোমুখি হচ্ছি। বা অন্যকে হতে দেখছি। তবে আমাদের সমাজব্যবস্থা মানসিক বিষয়কে কখনই পাত্তা দেয় না বা দিতে চাই না ফলে এটা সমস্যাকে তো কমায়ই না; বরং আরও জটিল করে তোলে। এমন বৈরি সময়ে তাই মানসিক স্বাস্থ্যকে আমরা কোনোভাবেই হেলা করতে পারি না।
মানসিক স্বাস্থ্যের এই যে ভগ্নদশা এটা কিন্তু শুধু আমাদের এখানে নয়; সারাবিশ্বেই ঘটছে। সম্প্রতি জাপানে বছরের প্রথম চার মাসে অর্থনীতির অবস্থা খারাপ হয়েছে ২২%। আর এতে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে যে এমনিতেই আত্মহত্যা প্রবণ জাপানিদের মাঝে অর্থনীতির এমন মন্দাভাব সেখানে আত্মহত্যা প্রবণতা ব্যাপক বাড়িয়ে দিতে পারে । মে মাসেই টোকিওর সুইসাইড হটলাইনে আসা ফোনগুলো তেমনই ইঙ্গিত দিচ্ছিল।
জাপানের অতীত ইতিহাস বলছে, ১৯৯৯ সাল যখন বিক্রয় কর বৃদ্ধি এবং এশীয় অর্থনৈতিক সংকট শুরু হয়েছিল তখন প্রথমে বার্ষিক আত্মহত্যার সংখ্যা ছিল ৩০ হাজার। পরে ২০০৩ সালে তা বেড়ে প্রায় সাড়ে ৩৪ হাজারে পৌঁছেছিল। অবশ্য ধীরে ধীরে তা কমতেও শুরু করে। তবে এখন আশঙ্কা করা হচ্ছে, করোনা মহামারি এবং সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট আত্মহত্যার সেই নিম্নমুখী প্রবণতাটিকে পাল্টে দিতে পারে।
এদিকে ইতালির জেনোয়া পেরেসারোতে কর্মরত কোভিড-পরবর্তী পুনর্বাসন ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. পিয়েরো ক্লাভারিও বলেছেন, তার টিম কোভিড থেকে সেরে ওঠা যে ৫৫ জনকে দেখেছেন তাদের ৫০% মনস্তাত্ত্বিক সমস্যায় ভুগছেন। এর মধ্যে ১৫% পিটিএসডি (পোস্ট ট্রমামেটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার) তে ভুগছেন ।
ইতালি, ইংল্যান্ডে তাই কোভিড পরবর্তী জটিলতা এড়ানোর জন্য পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে যাচ্ছে। কারণ কোভিড থেকে সেরে উঠলেও অনেকেরই এখনও শারীরিক ও মানসিক জটিলতা দেখা দিচ্ছে।
আমাদেরও মনে হয় এখন কোভিড থেকে যারা সেরে উঠেছেন তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে চাঙ্গা করে তোলার জন্য পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু করা উচিত। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট নীতি নির্ধারকরা সুদৃষ্টি দেবেন কি?
লেখক : চিকিৎসক।