এনসিটির হাল ধরেছে চট্টগ্রাম ড্রাইডক, সমৃদ্ধির স্বর্ণদ্বারের কর্মকাণ্ডে শৃঙ্খলা বৃদ্ধির আশা নৌবাহিনী প্রধানের
প্রকাশিতঃ 10:14 pm | July 09, 2025

কালের আলো রিপোর্ট:
দেশের অর্থনীতির হৃদপিণ্ড হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রাম বন্দর। দেশের সমৃদ্ধির স্বর্ণদ্বার। এই বন্দরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি)। জাহাজ থেকে কনটেইনার ওঠানো-নামানো, স্থানান্তরসহ নানা কাজ হয় এই টার্মিনালে। জাহাজ থেকে গ্যান্ট্রি ক্রেন দিয়ে আমদানি করা কনটেইনার নামানো আবার রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার ক্রেনের সাহায্যে জাহাজে তোলা হয় এখানেই। টার্মিনালের চত্বরে কনটেইনার সংরক্ষণ, স্থানান্তর ও কনটেইনার খুলে পণ্য খালাসও দেওয়া হয়। দেশের সবচেয়ে আধুনিক ও কৌশলগত এই টার্মিনাল নিয়ে নানাবিধ আলোচনার পর অবশেষে এটি পরিচালনায় আগামী ছয়মাসের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী পরিচালিত প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম ড্রাইডক লিমিটেডকে। গত সোমবার (০৭ জুলাই) থেকে তারা (ড্রাইডক) নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনার ভার বুঝে নিয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আহরণকারী ও বৃহৎ নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালটির (এনসিটি) আনুষ্ঠানিকভাবে হাল ধরার পর বুধবার (০৯ জুলাই) বাংলাদেশ নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল এম নাজমুল হাসান সরেজমিনে চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনালের কার্যক্রম পরিদর্শন করেছেন। পরিদর্শনকালে তিনি এনসিটি-২ জেটি এলাকায় কন্টেইনার হ্যান্ডলিং কার্যক্রম, এপ্রেইস পয়েন্টে কন্টেইনার এক্সামিন কার্যক্রম এবং সিটিএমএস ভবনে টার্মিনাল অপারেশন সিস্টেম কার্যক্রম ঘুরে দেখেন। একই সঙ্গে তিনি এনসিটিতে কর্মরত চট্টগ্রাম ড্রাই ডক লিমিটেড এর কর্মকর্তা ও সদস্যদের এবং বন্দরের কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলকে বন্দরের কার্যক্রম পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদান করেন বলে জানিয়েছে আন্ত:বাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)।
এ সময় চট্টগ্রাম নৌ অঞ্চলের কমান্ডার রিয়ার এডমিরাল মীর এরশাদ আলী, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান, চট্টগ্রাম ড্রাইডক লিমিটেডের এমডি কমডোর মো. বেনজীর মাহমুদসহ সামরিক ও অসামরিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বন্দরে যত কন্টেইনার ওঠা-নামা করে, তার বেশিরভাগই এনসিটিতে
চট্টগ্রাম বন্দরের চারটি কন্টেইনার টার্মিনালের মধ্যে সবচেয়ে বড় এনসিটি। এই টার্মিনালের পাঁচটি জেটির মধ্যে চারটিতে কন্টেইনারবাহী বড় জাহাজ এবং অন্য জেটিতে অভ্যন্তরীণ নৌপথে চলাচলকারী ছোট জাহাজ ভেড়ানো হয়। বন্দরে যত কন্টেইনার ওঠা-নামা করে, তার বেশিরভাগই হয় এনসিটিতে। ২০২৪ সালে মোট কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের ৪৪ শতাংশ হয়েছে এই টার্মিনালে। বন্দরের নিজস্ব অর্থায়নে ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয়ে ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে এনসিটির পাঁচটি জেটি নির্মাণ কাজ শেষ হয়। নির্মাণ কাজে বন্দরের খরচ হয়েছিল ৪৬৯ কোটি টাকা।
এর দুই বছর পর এনসিটির জন্য যন্ত্রপাতি কিনতে বিনিয়োগ করার শর্তে পরিচালনার জন্য বিদেশি অপারেটর নিয়োগে দরপত্রও আহ্বান করা হয়েছিল। তখন বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আগ্রহী ছিল। পরে সেই দরপত্র বাতিল করেছিল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। তারপর টার্মিনালটি পরিচালনার জন্য ২০১২ সালে দরপত্র আহ্বান করা হয়। এরপর দরপত্র সংশোধনের নামে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে পরবর্তীতে মামলা হলে টার্মিনাল পরিচালনা ঝুলে যায়। নানা আইনি প্রক্রিয়া শেষে ২০১৫ সালের ২৫ জুন এনসিটির ৪ ও ৫ নম্বর জেটি পরিচালনায় বন্দরের সঙ্গে চুক্তি করে সাইফ পাওয়ার টেক এবং এর দুই অংশীদার প্রতিষ্ঠান।
একই বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর এনসিটির ২ ও ৩ নম্বর জেটি পরিচালনায় বন্দরের সঙ্গে চুক্তি করে সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড। দরপত্রের মাধ্যমে দুই বছরের জন্য প্রতিষ্ঠানটি এনসিটি পরিচালনার ওই দায়িত্ব পেয়েছিল। ২০১৫ সালের ১৭ অক্টোবর এনসিটিতে কন্টেইনার ওঠানামার কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। পরবর্তীতে এনসিটি পরিচালনায় আর দরপত্র ডাকা হয়নি। সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে (ডিপিএম) প্রতিবার ছয় মাসের জন্য এনসিটির টার্মিনালগুলো পরিচালনা করে আসছিল সাইফ পাওয়ার টেক লিমিটেড। টানা একাদশবার সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত এনসিটি পরিচালনা করে সাইফ পাওয়ার টেক লিমিটেড। এরপর দ্বাদশতম বারের মত আরও ছয় মাসের জন্য তাদের এনসিটি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
শুরু থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এনসিটি পরিচালনায় কী-গ্যান্ট্রি ক্রেইন ও রাবার টায়ারড গ্যান্ট্রি ক্রেইনসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কিনতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ খরচ করেছে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। এনসিটিতে বছরে ১০ লাখ একক কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা আছে। ২০২৪ সালে দেশি বেসরকারি অপারেটর এনসিটিতে ১২ লাখ ৮১ হাজার একক কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এনসিটি পরিচালনার ভার বিদেশি অপারেটরের কাছে দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তখনই এনসিটি পরিচালনায় সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক ডিপি ওয়ার্ল্ডের নাম আলোচনায় আসে। গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর অর্ন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়।
বন্দরের কার্যক্রমকে আরও বেগবান করার আশা নৌবাহিনী প্রধানের
আওয়ামী লীগ সরকারের মত অর্ন্তবর্তী সরকারও এনসিটি পরিচালনায় বিদেশি অপারেটর নিয়োগে আগ্রহের কথা জানায়। এবারও আলোচনায় ডিপি ওয়ার্ল্ডের নাম রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে এ নিয়ে অবস্থান জানানোর পর বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনা শুরু হয়। বিভিন্ন সংগঠন এনসিটি বিদেশিদের দেওয়ার বিরোধিতা করে আন্দোলনও শুরু করে। এমন পরিস্থিতিতে গত মঙ্গলবার (০১ জুলাই) চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল বা এনসিটি পরিচালনার দায়িত্ব আগামী ছয় মাসের জন্য নৌবাহিনীকে দেওয়ার বিষয়ে অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠকে নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। পরদিন বুধবার (০২ জুলাই) রাজধানীর সচিবালয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এক বৈঠকের পর আনুষ্ঠানিকভাবে সাংবাদিকদের এ কথা জানান নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড.এম সাখাওয়াত হোসেন। পরে সরকারের সিদ্ধান্ত মোতাবেক এনসিটি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় নৌবাহিনী পরিচালিত একটি সামরিক জাহাজ মেরামতকারী প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম ড্রাইডক লিমিটেড। সোমবার (৭ জুলাই) থেকে প্রতিষ্ঠানটি টার্মিনাল পরিচালনা শুরু করে। চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মকর্তারা জানান, সরাসরি ক্রয় পদ্ধতি বা ডাইরেক্ট প্রকিউরমেন্ট মেথডে (ডিপিএম) এই কাজ পেয়েছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানটি।
বুধবার (০৯ জুলাই) বাংলাদেশ নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল এম নাজমুল হাসান চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনালের কার্যক্রম সরেজমিনে পরিদর্শনকালে বলেন, ‘চট্টগ্রাম ড্রাই ডক লিমিটেড এনসিটির দায়িত্ব গ্রহণের ফলে বন্দরের কর্মকাণ্ডে শৃঙ্খলা, সময়ানুবর্তিতা ও কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি পাবে। এর মাধ্যমে বন্দরের কার্যক্রমকে আরও বেগবান হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। এ প্রসঙ্গে নৌবাহিনী প্রধান আরও বলেন, ‘সঠিকভাবে বন্দর পরিচালনার মাধ্যমে দ্রুত পণ্য ওঠানামা ও পরিবহন নিশ্চিত করা হলে দেশের আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়া গতিশীল হবে, যা দেশের অর্থনীতিতে সরাসরি ভুমিকা রাখবে। এছাড়াও দক্ষ ব্যবস্থাপনার বন্দরের সামগ্রিক কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে তা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি করবে। ফলে জাতীয় অর্থনীতির অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।’
কালের আলো/এমএএএমকে