করোনাভাইরাস ও বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প

প্রকাশিতঃ 10:30 am | March 05, 2020

সালাউদ্দিন আলমগীর, সিআইপি :

বর্তমান বিশ্বে নভেল করোনাভাইরাস এক বড় আতঙ্কের নাম। এর ভয়ে কাঁপছে গোটা বিশ্ব। প্রথম দিকে এর আবির্ভাব চীন থেকে হলেও দিন দিন এ মরণব্যাধি ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। ইতোমধ্যে এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও আফ্রিকার প্রায় ৮০টি দেশ ও অঞ্চলে এর প্রাদুর্ভাব ঘটেছে।

বর্তমানে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় ৮৮ হাজার। মৃতের সংখ্যা তিন হাজার ছাড়িয়েছে। প্রতিদিনই সংক্রমণ ও আক্রান্তের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে।

মানবিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া এ ভাইরাস বড় ধরনের আঘাত হানছে অর্থনীতিতেও। ফলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পৃথিবীব্যাপী জরুরি অবস্থা জারি করেছে। অর্থনীতির বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, করোনাভাইরাসের মহামারি ২০০৮ সালে শুরু হওয়া বিশ্বমন্দাকেও হার মানাতে পারে। ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী শেয়ারবাজারে ব্যাপক দরপতন হয়েছে।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, কেবল গত সপ্তাহেই বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন প্রায় ছয় ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। কমে গেছে জ্বালানি তেলের দাম (৪৬.১৯ ইউএসডি/ব্যারেল) যা গত চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।

করোনাভাইরাসের প্রভাব ধীরে ধীরে হ্রাস পাবে বলে ধারণা করা হলেও বাস্তবে ঘটছে এর উল্টো। বিশ্বব্যাপী মহামারি রূপ নিয়েছে অপ্রতিরোধ্য এ ভাইরাস। ফলে এর ভয়াবহ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে সারাবিশ্বে, যার প্রভাবে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে বিশ্ববাজার ও অর্থনীতিতে।

উদ্বেগ বাড়ছে বাংলাদেশেও। চীন থেকে পণ্য আমদানি ব্যাহত হওয়ায় এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ছে আমাদের দেশে। বিশেষ করে তৈরি পোশাকশিল্পে এর প্রভাব পড়ছে খুব বেশি। প্রয়োজনীয় কাঁচামাল, ফিনিশড গুডস ও এক্সেসরিজের সংকটজনিত কারণে ইতোমধ্যে এগুলোর দাম অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে।

দেশের উদ্যোক্তাদের মধ্যে উদ্বেগ দিন দিন বাড়ছে। এককভাবে চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল এক হাজার ৪৭৯ কোটি মার্কিন ডলার। বর্তমানে চীন থেকে পণ্য আমদানি ব্যাহত থাকায় সমূহ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন উদ্যোক্তারা। দেশের বিভিন্ন ব্যবসা ও বাণিজ্যিক সংগঠন তাদের আসন্ন ক্ষয়ক্ষতির তীব্র আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।

যদিও বাংলাদেশের ডাইং সেক্টরে এর প্রভাব কিছুটা কম, কারণ ডাইং ফ্যাক্টরিগুলোর কাঁচামাল আমদানি একটি চলমান প্রক্রিয়া। চায়না হলিডের বিষয়টি মাথায় রেখে চাহিদা অনুযায়ী তারা কিছু কাঁচামাল ও অন্যান্য পণ্যসামগ্রী চায়না হলিডের পূর্বেই আমদানি করতে সামর্থ্য হয়েছে এবং কিছু মালামাল প্রস্তুত রয়েছে, যা তাদের ফ্যাক্টরি খোলার সঙ্গে সঙ্গেই জাহাজীকরণ সম্ভব হবে। এছাড়া করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এবং এর আপদকালীন সংকটের বিকল্প হিসেবে তারা তাদের কাঁচামাল আমদানির বিকল্প উৎসও খুঁজে পাবে এবং ইতোমধ্যেই সকল কাঁচামাল আমদানির বিকল্প উৎস হিসেবে ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ইন্ডিয়া ও নেপালকে বিবেচনায় নিয়েছে। ফলে ডাইড ইয়ার্নের মূল্য পাউন্ডপ্রতি ১০ থেকে ১৫ টাকা বাড়লেও মূল প্রভাবটা পড়বে তৈরি পোশাকশিল্পে।

সত্যিই যদি ইউরোপ ও আমেরিকায় করোনাভাইরাস মহামারি আকারে শুরু হয় এবং তাড়াতাড়ি যদি এর প্রতিরোধ সম্ভব না হয়, সে কারণে যদি ইতালির মতো অন্যরাও তাদের রিটেইল শপগুলো ধীরে ধীরে বন্ধ করে দেয়, তবে বাংলাদেশে ব্যাপকহারে তাদের কাজের অর্ডার কমে যাবে এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হবে।

বাংলাদেশ চীন থেকে বছরে গার্মেন্টসের কাঁচামাল আমদানি করে ৫০২ কোটি মার্কিন ডলারের; যার মধ্যে টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস এক্সেসরিজের সরবরাহ থাকে ৪০ শতাংশ। কিন্তু বর্তমানে তাদের এ সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায় বেশকিছু কাঁচামাল ও এক্সেসরিজের দাম ইতোমধ্যে বেড়ে গেছে। ফলে অনেক উদ্যোক্তা তাদের এলসিকৃত পণ্য উৎপাদনে হিমসিম খাচ্ছেন এবং যথাসময়ে তারা তাদের উৎপাদিত পণ্য ডেলিভারি দিতেও ব্যর্থ হচ্ছেন।

আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে চীনের পণ্য সরবরাহ প্রক্রিয়া স্বাভাবিক না হলে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বের ব্যবসায়ীরা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবেন।

লেখক : প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ ডাইড ইয়ার্ন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন; ডিরেক্টর, এফবিসিসিআই; চেয়ারম্যান, লাবিব গ্রুপ।