সতর্ক থাকুন ভাইরাসের গুজব ও গুজবের ভাইরাস থেকে
প্রকাশিতঃ 9:58 am | February 28, 2020

এরশাদুল আলম প্রিন্স :
ভাইরাসজনিত রোগ পৃথিবীতে নতুন কিছু নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাইরাস আক্রমণ করে। স্বল্প সময়ের ব্যাবধানে এ ভাইরাসজনিত রোগ নিরাময়ও সম্ভব হয়। ফলে, সাম্প্রতিক বিশ্বে ভাইরাসজনিত রোগে মৃত্যুর হার খুব বেশি নয়।
যদিও কিছু কিছু ভাইরাসের আক্রমণে অনেক সময় প্রাণহানিও হয়ে থাকে। কিন্তু রোগের মাত্রা ও প্রকোপ নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই থাকে। চীনে সংক্রামিত করোনাভাইরাসে এ পর্যন্ত প্রায় আড়াই হাজার মানুষ মারা গেছে। মৃত্যুর হার কম-বেশি বড় কথা নয়। এই ভাইরাসটির সুষ্পষ্ট কারণ ও প্রতিকার এখনও বের করা সম্ভব হয়নি। গতকাল চীনের একটি পত্রিকায় দেখলাম এ ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কারের চেষ্টা চলছে। একদল প্রাণীর মধ্যে প্রতিষেধক টিকা প্রয়োগ করা হয়েছে। গবেষকরা বলছেন, এটি সফল কিনা সেটি জানতে আরও সময় লাগবে। এদিকে মৃত্যুর হার প্রতিদিনই বাড়ছে। চীনের স্বাস্থ্য কর্তৃপকক্ষের হিসাব অনুযায়ী আরও ৪০৯ জন নতুন করে আক্রান্ত হয়েছে ও মারা গেছে ১৫০ জন। এখানেই করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা। এখনও কারণ, প্রতিরোধ ও প্রতিকারের উপায় জানা যায়নি। এদিকে প্রতিদিনই দীর্ঘ হচ্ছে আক্রান্ত ও মৃতদের তালিকা।
করোনাভাইরাসের চেয়েও ভয়াবহ ছিল মার্চ, সার্চ, ও সোয়াইনফ্লু। করোনার চেয়েও সোয়াইনফ্লুর আক্রমণে বেশি লোক মারা গেছে। সোয়াইনফ্লুতে আক্রান্তদের মধ্যে ১০ ভাগ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু সে তুলনায় করোনায় মৃত্যুর হার দুই/তিন শতাংশের বেশি হবে না। কিন্তু তারপরও এর ভয়াবহতা যেন বেশি। কারণ এটি ছড়িয়ে গেছে পুরো চীনে এমনকি বর্তমানে পৃথিবীর ২৫টি দেশে। নতুন করে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কায় আছে অনেক দেশ।
আক্রান্তরা প্রতিকারহীনভাবেই মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। প্রায় এক মাসের বেশি সময় অতিবাহিত হয়েছে, কিন্তু করোনাভাইরাস এখনও নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা গেলে অন্যান্য দেশে এই রোগ ছড়িয়ে পড়তো না। চীন থেকে ইতালির দূরত্ব সাড়ে ৭ হাজার কিলোমিটার। কিন্তু চীন থেকে সৃষ্ট এ ভাইরাস বর্তমানে ইতালিতেও ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে মারা গেছে ১ জন। ফলে এই রোগের প্রকোপ থেকে বাংলাদেশও মুক্ত নয়।
পৃথিবীতে আরও অনেক ভাইরাস সুপ্তাবস্থায় আছে। এ ভাইরাসগুলোকে বলা হয় লার্জ বা জায়ান্ট ভাইরাস। কারণ এগুলোর আকৃতি বিশাল এবং জীবনকালও দীর্ঘ এবং এগুলোর ভয়াবহতাও ব্যাপক। আবার অনেক ভাইরাস অতীতে আক্রমণ করেছে, কিন্তু এখন আর সেভাবে সক্রিয় নেই। এদেশে একসময় জলবসন্ত ও গুটিবসন্তের আক্রমণে অনেক মানুষ মারা গেছে। আজ এর প্রকোপ নেই বললেই চলে। পোলিও রোগও ভাইরাসের আক্রমণেই হয়। বর্তমানে এসব রোগ হলেও তা প্রতিকারযোগ্য। অনেকক্ষেত্রে প্রতিরোধযোগ্যও।
এ পর্যন্ত করোনায় প্রায় আড়াই হাজার মানুষ মারা গেছে। আমাদের দেশে করোনার মতো মারাত্মক ভাইরাস আক্রমণ করলে তা প্রতিরোধের সক্ষমতা কতটুকু আছে তা ভেবে দেখার বিষয়। চীন ১০ দিনে বিশেষ হাসপাতাল করেছে। আইসোলেশন হাসপাতাল করেছে। চীনের মতো সম্পদ ও সক্ষমতা আমাদের নেই। কাজেই এরকম কোনো ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে তা থেকে সহজ পরিত্রাণের সম্ভাবনা কম।
তবে আমাদের সর্তকতার বিকল্প নেই। সে কাজটি করতে হবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে। আমাদের ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে ও সীমান্তে বহির্গমন ও বহিরাগমকারীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার ওপর জোর দিতে হবে। বিশেষ করে চীন ও ইতোমধ্যে আক্রান্ত দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগের ক্ষেত্রে সতর্কতার বিকল্প নেই। পরীক্ষা ছাড়া বহিরাগমন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহজনক রোগীদের পর্যবেক্ষণ ক্যাম্পে রাখতে হবে। এ ক্যাম্পের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। আমাদের মনে রাখতে যে সাধারণ মানুষের মাঝে একবার এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে তা নিয়ন্ত্রণ খুব কঠিন হয়ে পড়বে। কার্যকর প্রতিষেধক আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে প্রতিরোধই একমাত্র উপায়।
কিন্তু এ বিষয়ে আগে থেকে ভয় পেলে চলবে না। ভয় ও গুজব সমস্যাকে আরও জটিল করবে। কোনোভাবেই যাতে গুজব না ছড়ায় সেদিকে সরকারকে নজরদারী করতে হবে। সাধারণ মানুষকে গুজবের বিরুদ্ধে সজাগ থাকতে হবে। গুজব ভিত্তিহীন বিষয়কেও নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যেতে পারে। এক সময় আমাদের দেশে নানা গুজবের কারণে মানুষ ঘর থেকেও বের হতে ভয় করতো। নিকট অতীতে গুজবের কারণে অনেক দু:খজনক ঘটনাও ঘটেছে।
রোগ ব্যাধি নিয়ে আগেও গুজব ছড়ানো হয়েছে। তখন কুসংস্কার ছিল। কিন্তু এখন সংস্কারমুক্ত সমাজেও গুজব হানা দেয়। এখন ডিজিটাল গুজব ছড়ানো হয়। এক সময় এদেশে ওলাওঠা রোগের গুজব ছড়ানো হয়েছে। ওলাবিবি নামক এক ডাইনি বুড়ি গ্রামে এলে ওই গ্রামে ওলা রোগ ছড়ায়। এই গুজবের ভয়ে মানুষ ঘরের দরজার জানালা বন্ধ করে রাখতো। বলা হতো, আজ ওই গ্রামে ও কাল ওই গ্রামে ওলা রোগ উঠেছে। ওলাবিবি বলে কিছু ছিল না। আসলে সবই ছিল গুজব।
শুধু আমাদের দেশেই নয়। শিক্ষায় অগ্রগামী দেশগুলোতেও গুজব হানা দিয়েছে। গুজবের ভাইরাস ছড়ায় সবার আগে এবং এর প্রতিরোধও কঠিন। কাজেই আগে থেকেই সতর্ক থাকতে হবে। ইউরোপে ত্রয়োদশ শতকে হঠাৎ করেই অনেক কালো বিড়াল নিধন করা হয়েছে। কালো বিড়াল নাকি সমাজে অনিষ্ট করে। তখন মানুষ এতো ভয় পেলো যে কালো আর সাদা নেই, ইউরোপবাসী সবাই বিড়াল মারা শুরু করলো। সবাই কুলক্ষুণে বিড়াল মেরে ইউরোপকে বিড়ালমুক্ত করলো। যা হবার তাই হলো। প্রকৃতির প্রতিশোধ বলতেতো একটা কথা আছে। বিড়ালমুক্ত ইউরোপ ইঁদুরের দখলে চলে গেলো। ইউরোপে ইঁদুর রাজত্ব কায়েম হলো। হতে পারে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার ইদুরের গল্প সেই বিড়াল মারার গল্প থেকেই উদ্ভুত। ইঁদুর থেকে উদ্ভুত ভাইরাসের কারণে প্লেগ রোগ ছড়িয়ে পড়লো পুরো ইউরোপে। ফলে অনেক মানুষ মারা গেলো। ইউরোপের অন্যান্য উপনিবেশগুলোতেও ছড়িয়ে পড়লো প্লেগ। কাজেই গুজবের ভাইরাসের বিরুদ্ধে আগে থেকেই সজাগ থাকতে হবে।
লেখক : কলামিস্ট।