চীনের করোনা সঙ্কট বিশ্বকে মহামন্দার সম্মুখীন করবে

প্রকাশিতঃ 10:15 am | February 27, 2020

আনিস আলমগীর :

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কোভিড-১৯ রোগের বিস্তার এত ব্যাপক যে তা বিশ্বকে গতিহীন করে তুলেছে। চীন লৌহ যবনিকার দেশ। সব কথা বের হতে পারছে না। ওয়ার্ল্ড মিডিয়া বলছে, আক্রান্তের সংখ্যা আর মৃত্যুর সংখ্যা নাকি চীনাদের বয়ান থেকে অনেক অনেক বেশি। চীনের নেতারা নির্বাক হয়ে থাকার থেকে বুঝা যায় যে, করোনার আক্রমণে তারা সত্যিই কাহিল হয়ে পড়েছেন।

এই পর্যন্ত প্রায় ৪৩টি দেশে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে। চীনের পরেই সংখ্যানুসারে বেশি আক্রান্ত দেশগুলো হচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়া, ইটালি, জাপান, ইরান, সিঙ্গাপুর, হংকং, যুক্তরাষ্ট্র, থাইল্যান্ড, তাইওয়ান। যখন এ লেখা লিখছি তখন আক্রান্তের সর্বমোট সংখ্যা ৮১ হাজার ১৩৪ এবং মৃতের সংখ্যা ২ হাজার ৭৬৫। চীনের সীমান্তবর্তী সব দেশ চীনের সঙ্গে তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে। উত্তর কোরিয়ার রপ্তানি বাণিজ্য শতাংশ চীনের ওপর নির্ভরশীল। তারা পর্যন্ত সীমান্ত সিল করে দিয়েছে। সমগ্র বিশ্ব থেকে চীনারা এক ঘরে হওয়ার অবস্থা।

চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। তার অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হলে বাংলাদেশের মত দেশ, যারা চীনের থেকে অর্থ সাহায্যের প্রত্যাশা করে তারাও প্রত্যাশিত সাহায্য থেকে বঞ্চিত হবে। উহান প্রদেশ থেকে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে। উহান চীনের তৃতীয় বৃহত্তম শিল্প সমৃদ্ধ নগরী আর সেই নগরীটিই এখন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। নিয়ন্ত্রণ আরোপ করায় এক এলাকার লোক অন্য এলাকায় যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আন্ত প্রদেশ চলাচল নিয়ন্ত্রিত।

জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে চাইনিজ নববর্ষের ছুটি শেষে শিল্প-কলকারখানা খুলেছে, কিন্তু আতঙ্ক নিয়ে। করোনাভাইরাসের কারণে চীনের আমদানি-রপ্তানি দুটিই নৈরাজ্যের শিকার। নিজস্ব নতুন নববর্ষ উৎসব পর্যন্ত পালন করা সম্ভব হয়নি। পশ্চিমাদের বড়দিনের উৎসবের মতো জানুয়ারি মাসে উৎসব পালন করতো তারা। মিডিয়া বলছে, করোনা ভাইরাসের কারণে এযাবৎ ৭৩ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে ব্যবসায়ীদের। বার্ষিক উৎসবে যে ব্যবসা হতো, এবছর বার্ষিক উৎসব হয়নি বলে কোনো ব্যবসা হয়নি।

যেখান থেকে শুরু সেই উহান শহরে ৮৩টি বড় বড় কারিগরি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সবই অচল। শহরটি মৃত্যুপুরীতে রূপ নিয়েছে আগেই বলেছি। নিষেধাজ্ঞার কারণে পার্শ্ববর্তী শহর থেকেও কেউ কোনো দিকে যায় না। লন্ডনের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, উহানে আক্রান্তের সংখ্যা পাঁচ লাখ ছাড়াবে। চীনের পর্যটনখাত সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে। ২০১৯ সালে প্রথম তিন মাসে চীন থেকে ভ্রমণে বেরিয়েছিল ১৭ কোটি মানুষ, এখন তা শূন্যের কোটায় পৌঁছেছে। কোনোখানে চীনাদেরকে সাদরে গ্রহণ করছে না বিশ্ববাসী। সুতরাং বিশ্ব পর্যটনেও সংকট তৈরি হয়েছে।

বিশ্বের বড় বড় ব্র্যান্ডের বিক্রয় কেন্দ্র রয়েছে চীনে। শুধু আমেরিকার কফি হাউস-স্টারবাক-এর চীনে রয়েছে ৪ হাজার শাখা। করোনার প্রথম ধাক্কাতে ২ হাজার বন্ধ হয়ে গেছে। অ্যাপেলের ব্যবসা চীনেইতো বেশি ছিল। তাদেরও মেরুদণ্ড ভেঙ্গে গেছে করোনার কারণে। খুচরা যন্ত্রাংশের রমরমা ব্যবসা ছিল চীনের। এই খাতে চীন ৩৫ বিলিয়ন ডলারের খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহ করতো। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই খুচরা মোটর গাড়ির যন্ত্রাংশ যেত ২০ বিলিয়ন ডলারের। গাড়ি নির্মাণ শিল্পের ক্ষতি হয়েছে প্রচুর। যন্ত্রাংশের সরবরাহ যদি অনিয়মিত হয়ে যায় তবে পুরো বিশ্ব এই খাতে সংকটে পড়বে। খুচরা যন্ত্রাংশের উৎপাদন এবং সরবরাহ এত বিপুল ছিল যে কেউ বিকল্পের সন্ধানও কখনো করেনি।

বিশ্বব্যাপী সস্তায় ব্যাগ, কোমরের বেল্ট, ব্রিফকেস তৈরির অ্যাক্সেসরিজ তৈরি ও সরবরাহ করত চীন। এখন তাও সঙ্কটে পড়েছে। বিশ্বব্যাপী এই খাতের খুচরা ব্যবসাটা প্রচণ্ড মার খাবে। অনেকের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। ঢাকার বংশাল, মালিটোলা, মাউথ টুলিতে এই ব্যবসার প্রচুর সরবরাহ কেন্দ্র ও ছোট ছোট কারখানা রয়েছে। অনেকগুলো ব্যবসায় বিশ্বের ভোক্তা গোষ্ঠী চীনের উৎপাদিত দ্রব্য সামগ্রীর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। বিকল্প ব্যবস্থার সন্ধান না পেলে অনেকের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

বাংলাদেশে চীনের দ্রব্য সামগ্রী মূল্য বিবেচনায় প্রচুর আমদানি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আসে জাপান, কোরিয়া, চীন থেকে। তার মধ্যে ৪০/৪৫ শতাংশ মেশিনারিজ আসে চীন থেকে। এখনতো মোবাইলফোন একচেটিয়া বাজার দখল করে রেখেছে চীন। বাংলাদেশের পোশাক শিল্প আর বস্ত্র শিল্পের ব্যাপক বিনিয়োগ রয়েছে চীনের। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত হচ্ছে এটি।

সরকার ও ব্যবসায়ীরা বৈঠক করে আত্মরক্ষার বিকল্প ব্যবস্থা কী হতে পারে তা নির্ধারণ করা দরকার। ভারত, নেপালে করোনা প্রবেশ করেছে কিন্তু বাংলাদেশকে বিধাতা এখনো রক্ষা করে রেখেছে। প্রবেশ করলে বাংলাদেশের দুর্বল এবং দুর্নীতিগ্রস্ত স্বাস্থ্য বিভাগ কীভাবে এর সামাল দিবে ভাবতেও পারি না। সে কারণে মানসিকভাবে সবাই আতঙ্কে আছে।

চীনে এই যাবত তিনজন মহানায়কের আবির্ভাব হয়েছে। মাও সেতুং বিপ্লব করে চীনে কোটি কোটি মানুষের মধ্যে আত্ম সচেতনতা সৃষ্টি করেছেন এবং তৃণমূলে জাতীয় জাগরণ সৃষ্টি করে জাতিকে নতুন পথে চলার পথ দেখিয়েছে। দেং জিয়াও পিং তার চিন্তা চেতনার জন্য নিন্দিত হয়েছেন কিন্তু কুচক্রী আখ্যায়িত হয়ে কখনো পরিত্যক্ত হন নি। মাও এর পরে তিনি চীনের আর্থিক গতির দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। তারই নির্দেশিত পথে চীনের উত্থান।

তৃতীয় মহানায়ক হচ্ছেন আজকের চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। চীন কমিউনিস্ট পার্টি তাকে তৃতীয় মহানায়ক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। চীনের উদীয়মান বাণিজ্যের সুরক্ষার জন্য তিনি ৬১টি দেশব্যাপী ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ বলে যে পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছিলেন তা ছিল খুবই চমৎকার পরিকল্পনা। কিন্তু করোনা চীনকে মহা বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলেছে।

মাও এর বিপ্লবের পর দুর্ভিক্ষ লেগেছিল। কোটি কোটি মানুষের প্রাণসংহার হয়েছে। মাও তার সামাল দিয়েছেন। দেং জিয়াও পিং তার সময়ের তিয়েনআনমেন স্কয়ার ঘটনার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা খাটিয়ে নিস্তব্দ করেছেন। কিন্তু করোনাভাইরাস অর্থ-বিত্ত-ক্ষমতা কোনোটিতে কাবু হচ্ছে না। এটা প্রকৃতির খেলা। এখানে সব শক্তি অসহায়। করোনা দীর্ঘস্থায়ী হলে চীনের পক্ষে বিপর্যয় সামাল দেওয়া হবে কঠিন। এমনিতে বিশ্বে এখন মন্দা চলছে। চীনের বিপর্যয় বিশ্বমন্দার দিকে ঠেলে দিলে সমগ্র বিশ্বই আর্থিক সংকটে পড়বে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।