বঙ্গবন্ধু থেকে ‘বিশ্ববন্ধু’
প্রকাশিতঃ 8:00 pm | September 05, 2019

প্রফেসর ড. সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদ ::
বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘বিশ্ববন্ধু’। মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ ৪৯ বছর পর এই প্রথম জাতিসংঘ সদর দপ্তরে জাতীয় শোক দিবস পালন করতে গিয়ে বৈশ্বিক ক’টনীতিকরা বলেছেন, শেখ মুজিব শুধু বঙ্গবন্ধু নন তিনি বিশ্ববন্ধু।
বাঙালি জাতিকে যিনি স্বাধীনভাবে বাঁচতে শিখিয়েছেন, বিশ্বপরিমন্ডলে লাল সবুজের একটি পতাকা উড্ডীন করেছেন এবং বিশ্ব মানচিত্রে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের ঠিকানা নিশ্চিত করেছেন। তিনি তো বিশ্ববন্ধু হবেনই। মাত্র সাড়ে তিন বছর রাষ্ট্রপরিচালনায় নিজের দেশের গ-ি পেরিয়ে বিশ্ব রাজনীতি ও বিশ্ব শান্তিতে বঙ্গবন্ধু সমগ্র বিশ্বে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছিলেন।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সেনাবাহিনী আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে তাদের সহযোগিতার কথা আমরা চিরদিন মনে রাখব। কিন্তু স্বাধীন একটি দেশে অন্য দেশের সেনাবাহিনীর অবস্থানকে বঙ্গবন্ধু মেনে নিতে পারেনি। ফলে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশে ফিরে মাত্র ৩৫ দিনের মাথায় তার জন্মদিনে ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ ভারতের সেনাবাহিনীকে নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৯ মার্চ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ২৫ বছর মেয়াদী মুজিব-ইন্দিরা মৈত্রী চুক্তি সম্পাদন করতে সক্ষম হন।
আর্ন্তজাতিক কূটনীতি এবং রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব ও বলিষ্ঠতা ছিল অনন্য সাধারণ। যুদ্ধ বিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন একটি দেশ মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় ১৯৭২ সালের ১০ মে আর্ন্তজাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সদস্য পদ লাভ করতে সক্ষম হয়।
বিশ্ব রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর সমসাময়িক যেসব নেতৃবৃন্দ দ্বিপাক্ষিক ও আর্ন্তজাতিক রাজনীতিতে ভ’মিকা রাখতেন কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ট্রো, ঘানার প্রেসিডেন্ট নক্রুমা, মিশরের নাসের, যোগস্লোভিয়ার মার্শাল টিটো এদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর গ্রহণযোগ্যতা ও নেতৃত্বছিল অগ্রগণ্য।
কারন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন বিশ্ব আজ দুইভাগে বিভক্ত শোষক আর শোষিত…আমি শোষিতের পক্ষে। বিশ্বের যেখানেই ভূ-রাজনীতি ও অর্থনৈতিক আগ্রাসন, সাম্প্রদায়িক ষড়যন্ত্র দেখা দিয়েছে সেখানেই বঙ্গবন্ধু অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। পারষ্পরিক সাহায্য ও সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে রাখতেন। ১৯৭৩ সালে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু তীব্র নিন্দা জানান। মিসর ও সিরিয়ায় এক লক্ষ পাউন্ড চা পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। আরব সমস্যা সমাধানে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের নেতা মার্শাল টিটো ও বুমেদিনের উদ্যোগের ভ’য়সী প্রশংসা করেন। আরব ইসরাইল যুদ্ধে আহতদের চিকিৎসাসেবা প্রদানে বাংলাদেশ থেকে দক্ষ চিকিৎসক দল প্রেরণ করেছিলেন।
১৯৭৩ সালে বিশ্বের শোষিত বঞ্চিত মানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদকে ভ’ষিত হয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু তার প্রিয় বাংলাদেশকে বিশ্ব সংগঠন জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ করাতে সক্ষম হন। এছাড়াও কমনওয়েলথ সদস্য, জোট নিরেপেক্ষ আন্দোলনের সদস্য ও ১৪টি আর্ন্তজাতিক সংগঠনের সদস্যপদ লাভ করেছিল।
বাংলা বাঙালি আর বাংলাদেশ সম্পর্কে জাতির পিতার হৃদয় উৎসারিত বৈশ্বিক ভাবনার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছে ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সামনে বাংলা ভাষায় ভাষণ দান। বাংলা ভাষার প্রতি বঙ্গবন্ধুর এই সম্মান বিশ্বের সর্বত্র আলোচিত হয়েছে। একটি জাতির মাতৃভাষার প্রতি কতোটা শ্রদ্ধা আর সম্মান থাকলে বিশ্ব সভায় নিজের ভাষায় বক্তব্য রাখা যায় বঙ্গবন্ধু তার দৃষ্টান্ত। জাতির পিতার এই কৃতিত্বপূর্ণ ভুমিকার জন্যই বিশ্ব নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুকে নানাভাবে মূল্যায়ন করেছেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ‘আর্ন্তজাতিক নিউজ উইক ম্যাগাজিন’ তাদের কভার পেইজ করেছিল বঙ্গবন্ধুকে ‘পয়েট অব পলিটিক্স’ আখ্যা দিয়ে। স্কটিশ দার্শনিক থমাস কার্লাইলের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। কারন বঙ্গবন্ধু হচ্ছে সেই নেতা যিনি অসম্ভব একটি কাজ সম্ভব করেছিলেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধকরে বাঙালিকে স্বাধীনকরে। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক Jacob F Field তার ‘We Shall Fight on the Beaches: The Speeches That Inspired History’ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে হাজার বছরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ বলে উল্লেখ করেছেন।
বঙ্গবন্ধু স্মৃতি যাদুঘর দেখতে এসে ফেডারেল জার্মানির সাবেক প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিয়ান উলফ দর্শনার্থীর বই এ লিখেছিলেন ‘বঙ্গবন্ধু হচ্ছে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারকারী নেতা যিনি তার জনগণের সম্মানের জন্য এবং জাতির মুক্তির জন্য বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র নির্মাণ করেছেন।’ শুধু তাই নয় ব্রিটিশ মানবতাবাদী আন্দোলনের সাবেক নেতা লর্ড ফেনার ব্রুকওয়ে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন ‘শেখ মুজিব হচ্ছে আমেরিকার জর্জ ওয়াশিংটন, ভারতের মহতœাগান্ধী আর আয়ারল্যান্ডের ডি ভ্যাল্যারার মত মহান নেতা।’ ব্রিটিশ প্রখ্যাত সাংবাদিক স্যার মার্ক ট্রুলি যিনি বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য পেয়েছিলে এবং বিভিন্ন জনসভায় উপস্থিত থাকতেন তিনি বলেছিলেন ‘বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দেয়ার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ এবং জনগণকে বিমোহিত করতে পারতেন তার ভাষণের মধ্যদিয়ে।’
কিউবার প্রেসিডেন্ট প্রয়াত বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো বঙ্গবন্ধুকে হিমালয় সমতুল্য মনেকরতেন। ১৯৭৩ সালে জোট নিরেপেক্ষ সম্মেলনে ফিদেল ক্যাস্ত্রো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলিঙ্গন করে বলেছিলেন ‘আমি হিমালয় দেখিনি তবে শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসে শেখ মুজিব ছিলেন হিমালয়ের সমান। তাই আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা লাভকরেছি।’
একইভাবে বঙ্গবন্ধুকে বিশ্বনেতৃত্বের আসনে স্থান দিতে শ্রীলংকার সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী লক্ষণ কাদির গামা বাঙালি জাতির পিতা সম্পর্কে বলেছিলেন ‘দক্ষিণ এশিয়া গত কয়েক শতকে বিশ্বকে অনেক শিক্ষক দার্শনিক দক্ষ রাষ্ট্রনায়ক রাজনৈতিক নেতা ও যোদ্ধা উপহার দিয়েছে কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান সবকিছুকে ছাঁপিয়ে তাঁর স্থান নির্ধারিত হয়ে আছে সর্বকালের সর্বোচ্চ আসনে।’
বাংলা ও বাঙালির একমাত্র নেতা শেখ মুজিব যিনি একটি অস্প্রদায়িক জাতি রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেকারনেই দীর্ঘ সংগ্রাম আর আন্দোলনকরে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ও রাজনীতিবীদদের বিরুদ্ধে একটি অসাম্প্রদায়িক ও সর্বজনিন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তুলেছিলেন। এবং নিজেও হয়েছিলন বিশ্বরাজনীতির প্রতিভ’। বিশ্বের সকল ধর্ম সকল রাষ্ট্র আর সকল জাতির বিশ্বাস আর ভাবাবেগকে সম্মান করতেন। আর তার প্রিয় বাংলাদেশের সংবিধান রচনা করেছিলেন তারই বিশ্বাসের চার মূল নীতির ওপর ভিত্তিকরে (বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্ম নিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র)। জাতির পিতা যা বিশ্বাসকরতেন তাই করতেন। এজন্য ব্রিটিশ সাংবাদিক সিরিল ডন তার একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন ‘হাজার বছরের ইতিহাসে শেখ মুজিব হচ্ছে একমাত্র নেতা যিনি ভাষা, সংস্কৃতি জাতি-গোষ্ঠী এবং রক্তে আপাদমস্তক একজন বাঙালি।’
কিংবদন্তি এই বাঙালি জবিনের শেষদিন পর্যন্ত বাংলাদেশ আর তার জনগণকে নিজের জীবনেরচেয়ে বেশি ভালবেসে গেছেন। ভালবেসেছেন বিশ্বের নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষকে। সংগ্রাম করেছেন অসম্প্রদায়িক এক সম্প্রীতি ও শান্তির বিশ্ব গড়তে। সেকারনেই আজ পৃথিবীর যেখানেই দ্বিপাক্ষিক-আর্ন্তজাতিক সমস্যায় মানবতা লংঘিত হয়, জাতিগত দাঙ্গা, ধর্মীয় উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে সেখানেই বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক নীতি ও ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়’ পররাষ্ট্র নীতির কথা মনে পড়ে। বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে আজ শুধু বঙ্গবন্ধু নয় তিনি আজ সত্যিই ‘বিশ্ববন্ধু’।
লেখক, উপাচার্য, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর।