সন্তান বেড়ে উঠুক উত্তম আদর্শে
প্রকাশিতঃ 1:58 pm | August 01, 2025

মাহমুদ আহমদ:
বর্তমান সময়ে একজন পিতামাতা তাদের আদরের সন্তানকে সুশিক্ষা ও উত্তম আদর্শে গড়ে তোলা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। পরিবার শিশুর আনুষ্ঠানিক এবং নৈতিক শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষালয়। শিশুর নৈতিক শিক্ষার জন্য পিতামাতাকেই অধিক সচেতন হতে হয়। নৈতিকতার বীজ পারিবারিক মূল্যবোধ থেকেই শিশুর আচরণে বিকশিত হয়।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেছেন ‘তোমরা জেনে রাখ নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের অভিভাবক। তিনি কতই উত্তম অভিভাবক ও কতই উত্তম সাহায্যকারী’ (সুরা আনফাল, আয়াত : ৪০)। অন্যত্রে তিনি ইরশাদ করেছেন ‘তুমি বল, আকাশসমূহের ও পৃথিবীর আদিদ্রষ্টা আল্লাহ ছাড়া আমি কি অন্য কোনো অভিভাবক গ্রহণ করতে পারি? অথচ তিনি সবার আহার জোগান এবং তাকে আহার জোগানো হয় না’ (সুরা আন আম, আয়াত: ১৪)।
হজরত রাসুল (সা.) বলেন, ‘যখন মানুষ মৃত্যুবরণ করে, তখন তার সব আমল বন্ধ হয়ে যায়; তবে তিনটি কাজের প্রতিদান পেতে থাকে। এমন দান, যার কল্যাণ চলমান থাকে; এমন জ্ঞান, যা দ্বারা মানুষ উপকৃত হতে থাকে; এমন সৎকর্মশীল সন্তান, যে তার (পিতামাতার) জন্য দোয়া করে।’
পবিত্র কুরআনের এই দু’টি আয়াত থেকে স্পষ্ট বুঝা যায়, আমাদের সবার প্রকৃত অভিভাবক হচ্ছেন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। যদিও আমাদের সবার প্রকৃত অভিভাবক হলেন মহান আল্লাহ তথাপি তিনিই একজন সন্তানের সুশিক্ষা এবং দেখভালের দায়িত্ব দিয়েছেন পিতামাতার ওপর। তাই পিতামাতাকে সন্তান লালন পালনের ক্ষেত্রে অনেক বেশি দায়িত্বশীল হতে হয়। আল্লাহতায়ালা পিতামাতার ওপর সন্তানের দায়িত্বভার ন্যস্ত করেছেন। প্রত্যেক পিতামাতা যেন তাদের সন্তানকে সুশিক্ষা দিয়ে মানুষের মত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেন।
শৈশব থেকে সন্তানকে যদি উত্তম আদর্শে গড়ে তুলা না যায় তাহলে সেই সন্তানই একদিন পিতামাতার জন্য ভয়াবহ কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মহানবি (সা.) বলেছেন, প্রতিটি শিশু ফিতরত (সত্য স্বভাব)-এর উপর জন্মগ্রহণ করে। পরে তার পিতামাতা তাকে ইহুদি বানায় কিংবা খ্রিষ্টান বানায় কিংবা অগ্নিপূজক বানায় (সহিহ বুখারি)।
তাই শৈশব থেকেই শিশুর চরিত্রকে ইসলামের আলোয় আলোকিত করতে হবে। শিশুরা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয় পরিবেশ দ্বারা। বর্তমান সময়ে প্রতিনিয়ত এমন সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশ হয় যে, সন্তানের হাতে পিতা বা মাতা খুন। অথচ পিতামাতা যদি শৈশব থেকেই সন্তানের দিকে ভালো করে দৃষ্টি রাখতো তাহলে হয়ত সন্তানের কারণে কোনো পিতামাতার কষ্টের কারণ হতো না। তবে এক্ষেত্রে একজন পিতামাতাকে অবশ্যই উন্নত আদর্শের হতে হবে। পিতা-মাতা যদি নিজেই আদর্শ না হোন তাহলে তারা কীভাবে আশা করতে পারেন তাদের সন্তান সমাজ ও দেশের মঙ্গলের কারণ হবে?
মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পিতামাতাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন,‘কোনো পিতা তার পুত্রকে উত্তম শিষ্টাচার অপেক্ষা অধিক শ্রেয় আর কোনো বস্তু দান করতে পারে না’ (তিরমিজি)। তাই পিতামাতার উচিত হবে সন্তানদের উত্তম শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলা। আবার পিতামাতার প্রতিও সন্তানের অনেক দায়িত্ব রয়েছে। পিতামাতার প্রতি আমাদের যা করণীয় এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক ইরশাদ করেছেন, ‘আর তোমার প্রভু-প্রতিপালক একমাত্র তারই ইবাদত করার এবং পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার তাকিদপূর্ণ আদেশ দিয়েছেন। তোমার জীবদ্দশায় তাদের একজন বা উভয়েই বার্ধক্যে উপনীত হলে তুমি তাদের উদ্দেশ্যে বিরক্তিসূচক উহ্-ও বলো না এবং তাদেরকে বকাঝকা করো না, বরং তাদের সাথে সদা বিনম্র ও সম্মানসূচক কথা বলো। আর তুমি মমতাভরে তাদের উভয়ের ওপর বিনয়ের ডানা মেলে ধর। আর দোয়ার সময় বলবে, হে আমার প্রভু-প্রতিপালক! তুমি তাদের প্রতি সেভাবে দয়া কর যেভাবে শৈশবে তারা আমায় লালনপালন করেছিল’ (সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত: ২৩-২৪)।
হাদিসে উল্লেখ আছে, এক সাহাবি হজরত রাসুল করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বলেন ‘হে আল্লাহর রাসুল! সন্তানের ওপর পিতামাতার কি হক বা দাবি আছে? তিনি (সা.) বললেন, তারা উভয়েই তোমার বেহেশতও এবং দোযখও’ (ইবনে মাজাহ)।
সন্তান ভালো হবে না খারাপ হবে তা নির্ভর করে পিতামাতার কাছে। সন্তান যে পরিবেশে বড় হবে তাই সে শিখবে। পিতামাতা যদি আদর্শবান হোন এবং ধর্মীয় নিয়মকানুন অনুযায়ী চলেন এবং সন্তানকে সুশিক্ষা দিয়ে গড়ে তুলেন তাহলে সন্তান অবশ্যই ভালো হবে।
আল্লাহতায়ালা এ পৃথিবীতে ধন-সম্পদ ও সন্তানসন্ততি দিয়ে থাকেন পরীক্ষা করার জন্য। অনেককে আল্লাহতায়ালা প্রচুর ধন-সম্পদ দান করেন ঠিকই কিন্তু সেই ধন-সম্পত্তির সঠিক ব্যবহার না করার ফলে দেখা যায় সে ধ্বংস হয়ে যায় আবার কাউকে সন্তানসন্ততি দেন ঠিকই কিন্তু তাদেরকে সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত না করার ফলে এই সন্তান তার জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। সন্তানসন্ততি যদি প্রকৃত নৈতিকগুন সম্পন্ন না হয় তাহলে মাতাপিতার জন্য তা একটি আজাব বই কিছুই না। অপর দিকে আমরা যদি নেক সন্তান রেখে যেতে পারি তাহলে সেই সন্তানের মাধ্যমে আমরা আমাদের মৃত্যুর পরেও পুণ্য লাভ করতে থাকবো।
যেভাবে হাদিসে এসেছে হজরত রাসুল (সা.) বলেন, ‘যখন মানুষ মৃত্যুবরণ করে, তখন তার সব আমল বন্ধ হয়ে যায়; তবে তিনটি কাজের প্রতিদান পেতে থাকে। এমন দান, যার কল্যাণ চলমান থাকে; এমন জ্ঞান, যা দ্বারা মানুষ উপকৃত হতে থাকে; এমন সৎকর্মশীল সন্তান, যে তার (পিতামাতার) জন্য দোয়া করে।’ (ইবনে কাসির)
জীবন-বিধান আল কুরআনের সুরা কাহাফের ৪৬ আয়াতে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘ধন-সম্পদ ও সন্তানসন্ততি দুনিয়ার সৌন্দর্য। এ সন্তানসন্ততি যদি আদর্শ চরিত্রের না হয় তাহলে তা হয় মা-বাবার জন্য পরীক্ষার কারণ-দুঃখের বোঝা।’
আর এজন্যই আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআন করিমে মুমিনদেরকে হুঁশিয়ার করে বলেছেন, ‘আর জেনে রাখ, তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তানসন্ততি পরীক্ষার কারণ (সুরা আনফাল, আয়াত: ২৭)। পবিত্র কুরআনে আরো বলা হয়েছে, ‘হে যারা ইমান এনেছ! তোমরা নিজেদের এবং তোমাদের পরিবারবর্গকে আগুন থেকে বাঁচাও’ (সুরা তাহরিম, আয়াত: ৬)।
দিনের পরদিন আমাদের সন্তানরা কেন এতো খারাপ পর্যায়ে চলে যাচ্ছে? এর কারণ কী? সমাজে যারা নানা অপকর্মে লিপ্ত তারা তো কোনো না কোন পিতা-মাতারই সন্তান। বিভিন্ন অপকর্মকারীদের সম্পর্কে যদি আমরা একটু খোঁজ নেই, তাহলে দেখতে পাব, তাদের পিতা-মাতা তাদেরকে সেভাবে গাইড করেননি যেভাবে করা উচিত ছিল। সন্তানরা কোথায় যাচ্ছে, কাদের সাথে বন্ধুত্ব করছে এসবের কোনো খেয়ালই হয়ত পিতামাতা কখনই রাখেনি।
সন্তানদের সম্পর্কে কোনো চিন্তা নেই বলেই তাদের মাধ্যমে আজ সংগঠিত হচ্ছে যত ধরনের ঘৃণ্য কাজ। আমাদের সন্তান সম্পর্কে আমরা যদি সচেতন থাকি এবং উত্তম শিক্ষা প্রদান করি, তাহলে কোনো সন্তানের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয় কারও ক্ষতি করা। আমরা দেখতে পাই, অনেকেই এমন আছেন যারা চান সন্তানদেরকে ধর্মের আলোয় আলোকিত করতে কিন্তু জাগতিকতার মোহে আসক্ত হয়ে সন্তানদেরকে তারা অতি মর্ডান হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন, যার ফলে সেই সন্তান একদিন আদালতে পিতামাতার বিরুদ্ধে গিয়ে দাঁড়াতেও আমাদের দেখতে হচ্ছে।
তাই প্রতিটি পিতামাতার দায়িত্ব হলো, নিজের সন্তানকে উত্তম শিক্ষা ও শিষ্টাচার শিখিয়ে নেক সন্তান হিসাবে গড়ে তোলা। আল্লাহপাক আমাদেরকে সেই তৌফিক দান করুন, আমিন।
লেখক: প্রাবন্ধিক, ইসলামি চিন্তাবিদ।