ফেনীতে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ৯ শতাধিক ঘর-বসতি

প্রকাশিতঃ 1:49 pm | July 21, 2025

ফেনী প্রতিবেদক, কালের আলো:

২৪-এর পর ২৫-এর বন্যায় ফেনীর তিন উপজেলা—ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়ার—১৩২ গ্রামের কয়েক লাখ মানুষ ঘরহারা হয়েছেন। পানি নামতে শুরু করলেও ক্ষতির চিহ্ন দিন দিন দগদগে হয়ে উঠছে।

তলিয়ে গেছে রাস্তা-ঘাট, ঘর-বসতি ও ফসলি জমি; এখনো নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছেন বন্যাদুর্গতরা। ফুলগাজীতে বন্যার পানিতে মাছ ধরতে গিয়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে। বন্যায় সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত ৪৯টি পরিবার এখন আত্মীয় বা পাশের প্রতিবেশীর ঘরে আশ্রয় নিয়েছে; কেউ কেউ বাঁশ টানিয়ে মাথার ওপর প্লাস্টিক দিয়ে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছেন। বন্যায় আবাসন খাতের ক্ষতির এই চিত্র গত শনিবার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় তুলে ধরা হয়।

সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাদের হিসাব অনুযায়ী, ফুলগাজীতে ২০টি এবং পরশুরামে ২৮টি কাঁচা ও আধাপাকা ঘর সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে। প্রতি ঘর দুই লাখ টাকা ধরে এ খাতে ক্ষতি আনুমানিক প্রায় এক কোটি টাকা। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত আধাপাকা/কাঁচা ঘর। ফুলগাজীতে ৪৯৫টি, ছাগলনাইয়া ৩০৪টি, পরশুরাম ৬৯টি—যার আর্থিক ক্ষতি প্রায় ৮ কোটি টাকা বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়েছে।

বন্যায় বিধ্বস্ত ফুলগাজীর শ্রীপুর পূর্ব পাড়ার সালেহা বেগম বর্তমানে পাশের ছোট্ট একটি স্কিম ঘরে রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তিনি বলেন, সবকিছু দুঃস্বপ্নের মতো লাগছে। এক বন্যায় আমাকে পুরো নিঃস্ব করে দিয়েছে। কিছুই রক্ষা করতে পারিনি। ছোট তিন সন্তানকে নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলাম; এক সপ্তাহ পর ফিরে এসেছি। কীভাবে ঘর তুলব বুঝতে পারছি না। এখন পর্যন্ত আমাদের পুনর্বাসনে সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই।

এদিকে রোববার রাতভর বৃষ্টির পর মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনীয়া নদীর পানি আবারও বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গেল সপ্তাহের বন্যায় ফুলগাজী সদর, আনন্দপুর, মুন্সীরহাট ও আমজাদহাট ইউনিয়নের ৬৭টির বেশি গ্রাম প্লাবিত হয়। গত সোমবার রাত ১০টার দিকে ফুলগাজী সদর ইউনিয়নের দক্ষিণ শ্রীপুর পশ্চিমমাথা এলাকায় বেড়িবাঁধের ভাঙনকবলিত স্থানে জাল ফেলে মাছ ধরতে গিয়ে মিজানুর রহমানের ছেলে মো. রাজু (সহ আরও তিন বন্ধু) প্রবল স্রোতে ভেসে যান। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে ফুলগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

পরশুরাম উপজেলার মির্জানগর, চিথলিয়া, বক্সমাহমুদ এবং পৌরশহরসহ ৪৪টির বেশি গ্রাম পানিতে তলিয়ে আছে। ছাগলনাইয়ার পাঠাননগর, রাধানগর ও শুভপুর ইউনিয়নের ১৫টির বেশি গ্রামেও বন্যা পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ফেনী সদরের ৯টি ও দাগনভূঞা উপজেলার ২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

অনেক এলাকায় রাস্তা-ঘাট, পুকুর, কৃষিজমি ডুবে গেছে; কোথাও কোথাও বন্যার পানি ঘরের ছাদ বা টিনের চাল ছুঁয়েছে। পানি নেমে যাওয়ার পরও বহু মানুষ বসতবাড়ি হারিয়ে আশ্রয়হীন অবস্থায় রয়েছেন। স্থানীয় প্রশাসন ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ত্রাণ সহায়তা নিয়ে দুর্গত এলাকায় কাজ করছে।

চলতি মাসের শুরুর দিকে মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনীয়া নদীর পরশুরাম অংশে ২২টি এবং ফুলগাজী অংশে ১৯টি—মোট ৪১টি স্থানে ভাঙন দেখা যায়।

ফুলগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফাহরিয়া ইসলাম বলেন, বন্যায় আবাসনসহ আরও একাধিক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করছি; সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিভিন্ন এনজিও ও সংগঠন ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে আর্থিক অনুদান দিয়েছে। তবে সরকারিভাবে পুনর্বাসনের এখনো কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো আপাতত অন্যের আশ্রয়ে আছে।

ফেনী জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম জানান, এবারের বন্যায় জেলায় প্রায় এক লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য সরকারের কাছে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে; নির্দেশনা পেলেই কাজ শুরু হবে।

জেলা প্রশাসনের হিসাব অনুযায়ী, এবারের ভয়াবহ বন্যায় ফেনীতে মোট ১৪৬ কোটি ৪৩ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে—কৃষি খাতে ৩৮ কোটি ৭ লাখ টাকা, মৎস্য ৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা, প্রাণিসম্পদ ৬৫ লাখ টাকা, সড়ক অবকাঠামো ৯০ কোটি টাকা এবং বাঁধ ভাঙনে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ক্ষতি ৯ কোটি টাকা।

গত বছরের (২০২৪) ভয়াব বন্যা ফেনীতে ফেনীতে ৭০ হাজার ৪১৫টি আধাপাকা ও কাঁচা ঘর, আসবাবপত্র ও বৈদ্যুতিক সামগ্রী পানিতে তলিয়ে যায়। আনুমানিক ক্ষতি ছিল ৫৩৩ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। ওই বন্যায় ৭ হাজার ৩৫০টি পরিবার সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত এবং ৫৬ হাজার ৬৫টি ঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

কালের আলো/এমডিএইচ