উপস্থিত থেকেও উদ্ধারে এগিয়ে না আসায় দায় এড়ানোর সুযোগ নেই

প্রকাশিতঃ 8:56 am | May 04, 2025

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, কালের আলো:

ভুক্তভোগী আবরার ফাহাদকে পেটানোর ঘটনায় কিছু অভিযুক্তকে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে এবং কিছু অভিযুক্তকে উপস্থিত থেকে ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে দেখা যায়। কিন্তু তাদের কেউই ভুক্তভোগীকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসেননি। এর মধ্য দিয়ে স্পষ্টতই প্রমাণ হয় তাদের অপরাধের মানসিকতা ছিল এবং উপস্থিতির মাধ্যমে তারা ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় ২০ আসামির মৃত্যুদণ্ড এবং ৫ আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল রেখে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়ে এমন পর্যবেক্ষণ এসেছে।

রায়ের পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়েছে, বিবেকবান ব্যক্তিদের মাধ্যমে এ ধরনের নির্মম ও অমানবিক নির্যাতন করার এটি কোনো যুক্তি হতে পারে না; যেখানে তারা নিজেদের বুয়েটের মেধাবী ছাত্র বলে দাবি করে।

সাড়ে পাঁচ বছর আগে বুয়েটের একটি হলে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে। নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডে দেশজুড়ে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। হত্যায় জড়িত ব্যক্তিদের সবাই ছিলেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের (বর্তমানে নিষিদ্ধ) নেতাকর্মী।

এ ঘটনায় করা মামলায় ২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর রায় দেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১। বিচারিক আদালতের রায়ে ২০ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড ও ৫ আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

এ মামলায় আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন), আপিল ও জেল আপিলের ওপর শুনানি শেষে হাইকোর্টের বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান (বর্তমানে আপিল বিভাগের বিচারপতি) ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ গত ১৬ মার্চ রায় ঘোষণা করেন।

আসামিদের ডেথরেফারেন্স অনুমোদন করে এবং আসামিদের আপিল ও বিবিধ আবেদন খারিজ করে রায় দেওয়া হয়। হাইকোর্ট বিচারিক আদালতের রায়ে আসামিদের দেওয়া দণ্ডাদেশ বহাল রাখেন।

পূর্ণাঙ্গ রায়ে তথ্যাদি পর্যালোচনা করে বলা হয়, আবরার ফাহাদ ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন, শুধু এমন অভিযোগে অভিযুক্তরা তাকে পিটিয়ে হত্যা করে বলে দেখা যায়। কিন্তু কোনো বিবেকবান ব্যক্তিদের মাধ্যমে এ ধরনের নির্মম ও অমানবিক নির্যাতন করার এটি কোনো যুক্তি হতে পারে না; যেখানে তারা নিজেদের বুয়েটের মেধাবী ছাত্র বলে দাবি করে। হতে পারে কিছু অভিযুক্ত ভুক্তভোগীকে পেটানোয় সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়নি, কিন্তু এর মানে এ নয় যে তারা শাস্তির বাইরে থাকবে এবং দায় এড়াতে পারবেন। তারা সবাই সেখানে উপস্থিত ছিলেন, যা ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে শনাক্ত করা হয়েছে।

তারা ভুক্তভোগীকে উদ্ধারের চেষ্টা করেননি, যা এ হত্যকাণ্ডকে পরোক্ষভাবে সমর্থন দেওয়ার শামিল বলেও পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে।

১৩১ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ের প্রত্যায়িত অনুলিপি গত ২৩ এপ্রিল হাতে পেয়েছেন বলে জানান আসামিপক্ষের অন্যতম আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু। দুই আসামির এ আইনজীবী বলেন, মোর্শেদ অমর্ত্য ইসলামের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়েছে। অথচ বিশেষজ্ঞ সাক্ষীসহ কোনো সাক্ষী ভিডিওতে তাকে শনাক্ত করেননি।

তিনি বলেন, অপর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মো. মেফতাহুল ইসলাম ওরফে জিয়ন শারীরিকভাবে অক্ষম, তার পক্ষে মারধর করা সম্ভব নয়—এসব যুক্তি তুলে ধরে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। চলতি মাসে আপিল করা হবে।

মামলার দিকগুলো এবং বিচারিক আদালতের দেওয়া পর্যবেক্ষণ পূর্ণাঙ্গ রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। বিচারিক আদালতের রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছিল, চাক্ষুষ ও পারিপার্শ্বিক সাক্ষীদের সাক্ষ্য, সরকারি সাক্ষীদের সাক্ষ্য, আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, প্রদর্শিত নথিপত্র ও সিসিটিভির পুরো ফুটেজ বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

সেখানে দেখা যায়, নিঃসন্দেহে সব আসামি পরস্পর যোগসাজশে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী শিবির সন্দেহে আবরার ফাহাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন অভিযোগ এনে তাকে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর বুয়েটের শেরেবাংলা হল থেকে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরারের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় তার বাবা বরকতউল্লাহ ঢাকার চকবাজার থানায় মামলা করেন। মামলার তদন্ত শেষে একই বছরের ১৩ নভেম্বর বুয়েটের ২৫ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশ করে ছাত্রশিবিরের কর্মী সন্দেহে মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলে আবরারকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছেন।

কালের আলো/এএএন