বঙ্গবন্ধু ও আ.লীগকে নিয়ে ইতিহাস বিকৃতি করেছেন লেখক মহিউদ্দিন!

প্রকাশিতঃ 9:25 pm | April 16, 2019

কালের আলো রিপোর্ট :

লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ’র লেখা ‘আওয়ামী লীগ উত্থানপর্ব ১৯৪৮-১৯৭০’ বইটিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে নিয়ে ইতিহাস বিকৃত করার অভিযোগ উঠেছে।

স্মৃতি-বিস্মৃতির ঝাঁপি খুলে দলটির উত্থানপর্ব ছেঁকে তুলতে গিয়ে ভুল ও অসত্য তথ্য উপস্থাপন করেছেন এই লেখক। এমনকি ইতিহাসের মহানায়ককেও কৌশলে ছোটও করেছেন। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন দলের চেয়ে মন্ত্রীত্বই ছিলো বঙ্গবন্ধু’র কাছে মুখ্য। বইটি পড়েছেন এমন কয়েকজন কালের আলো’র কাছে এসব অভিযোগ করেছেন।

৮৬ নম্বর পৃষ্ঠার একটি প্যারার তীব্র সমালোচনা করে তাঁরা বলেন, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ যেমন ঐতিহাসিক সত্য তেমনি বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ এক এবং অভিন্ন। অথচ লেখক মহিউদ্দিন আহমদ প্রকৃত ঘটনাকে বিকৃত আকারে তুলে ধরেছেন। মিথ্যা, উদ্ভট ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত এমন লেখায় দেশের মানুষের মাঝে চরম বিভ্রান্তি তৈরি হবে।

দেশকে যারা মেনে নিতে পারেননি তাদের ফাঁদে পড়েই তিনি এভাবে ইতিহাস বিকৃত করেছেন কীনা এই বিষয়টিও খতিয়ে দেখতে হবে। এই বইটি প্রত্যাখ্যানের পাশাপাশি বাজেয়াপ্ত করারও দাবি জানাচ্ছি, যোগ করেন তাঁরা।

লেখক মহিউদ্দিন আহমদ’র এই বইটি ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে প্রথমা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। তবে এতোদিন এই বিষয়টি কারো নজরে আসেনি। সম্প্রতি বইটি পড়েছেন এমন কয়েকজন কালের আলো’র কাছে এ বিষয়ে অভিযোগ করেন।

১৯৭০ সালে মুহসীন হল ছাত্র সংসদের সহ-সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মহিউদ্দিন। বিএলএফের সদস্য হিসেবে তিনি মুক্তিযুদ্ধেও অংশ নেন। দৈনিক গনকন্ঠে কাজ করেছেন প্রতিবেদক ও সহকারী সম্পাদক হিসেবে।

প্রথমা প্রকাশন থেকে এর আগে তাঁর প্রকাশিত বইসমূহ হচ্ছে- ‘জাসদের উত্থান পতন : অস্থির সময়ের রাজনীতি, বিএনপি : সময়-অসময়। প্রথম আলোতেও নিয়মিত কলাম লিখেন মহিউদ্দিন আহমদ।

কী লিখেছেন মহিউদ্দিন আহমদ?
বইটির ৮৬ নম্বর পৃষ্টায় মহিউদ্দিন লিখেছেন- ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী একই সঙ্গে মন্ত্রীসভা এবং এবং দলীয় পদে থাকার বিধান ছিল না। শেখ মুজিবুর রহমান দলের সাধারণ সম্পাদক পদ ছেড়ে দিতে ইচ্ছুক ছিলেন না। সাংগঠনিক কিছু বিষয়ে মতভেদ দেখা দেওয়ায় তিনি মন্ত্রীসভা গঠনের একদিন আগে সভাপতি মওলানা ভাসানীকে একটি চিঠি দেন।

চিঠিতে তিনি লেখেন, ‘অসুস্থতার কারণে আমার পক্ষে আপনার সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক থাকা সম্ভব নয়। আশা করি, এই চিঠিকে আমার পদত্যাগপত্র হিসেবে বিবেচনা করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গ্রহণ করবেন, তা না হলে সংগঠনের ক্ষতি হবে।’

তার এই পদত্যাগ কার্যকর হয়নি। শেখ মুজিব আতাউর রহমান খানের মন্ত্রীসভায় যোগ দেন এবং বিভিন্ন সময়ে বানিজ্য, শিক্ষা, শ্রম ও দুর্নীতি দমন মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব পালন করেন।’

অভিযোগ মিথ্যা তথ্য ও ইতিহাস বিকৃতির
বইটি পড়েছেন এমন কয়েকজন কালের আলো’র কাছে অভিযোগ করে বলেছেন, মহিউদ্দিন আহমদ সুস্পষ্টভাবে ইতিহাস বিকৃত করেছেন। আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধু অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও তিনি সুক্ষ্ণ কৌশলে বিকৃতভাবে ইতিহাসকে উপস্থাপন করেছেন।

যেখানে জাতির জনক বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করার জন্যে মন্ত্রীত্ব ত্যাগ করেন সেখানে এই ধরণের বিকৃতির বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা সময়ের সুতীব্র প্রয়োজন।

আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা মনে করেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাংগঠনিক দক্ষতা ও নেতৃত্বেই সব বাঁধা-বিপত্তি এবং শাসকদের আঘাতের মুখেও আওয়ামী লীগ তৃণমূল পর্যন্ত গণমুখী সংগঠনে রূপলাভ করে। মানুষের সঙ্গে একাত্ম হয়েই বঙ্গবন্ধু মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে গণমানুষকে সম্পৃক্ত করে নিরন্তর পথ হেঁটেছেন।

জাতির জনকের নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগ সত্তরের গণরায় নিয়ে সেই ৭ মার্চে জাতিকে এক সুতোয় বেঁধে স্বাধীনতার ডাক দিয়ে গোটা বাংলাকে উত্তাল করেছিলেন। একটি স্বাধীন মানচিত্র উপহার দিয়েছিলেন বীর বাঙালি জাতিকে।

কী বলছেন ৬৯’র গণঅভ্যুত্থানের নায়ক?
লেখক মহিউদ্দিন আহমদ বইটি’র ৮৬ নম্বর পৃষ্ঠার একটি অংশ নিয়ে কালের আলো’র পক্ষ থেকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় ৬৯’র গণঅভ্যুত্থানের নায়ক, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের।

মহিউদ্দিন সেখানে ডাহা মিথ্যাচার করেছেন বলে কালের আলোকে জানান তিনি। কিংবদন্তি এই রাজনীতিক সেই সময়কার ঘটনা প্রবাহ নিজের জবানীতে তুলে ধরে বলেন, ঐতিহাসিক ঘটনা হলো আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে ছিলো যে দুই পদে থাকা যাবে না।

দুই পদ মানে সদস্য থাকা যাবে কিন্তু দলীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব এবং মন্ত্রীত্ব দু’টিতে থাকা যাবে না। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হলে মন্ত্রী হওয়া যাবে না। আবার মন্ত্রী থাকলে সাধারণ সম্পাদক পদে থাকা যাবে না। বঙ্গবন্ধু এ কারণে মন্ত্রীত্ব ত্যাগ করেন। তিনি দলকে সংগঠিত করার জন্য দলের সাধারণ সম্পাদক পদে থেকেছেন।

ক্ষোভ প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য, অবিসংবাদিত এই সাবেক ছাত্র নেতা বলেন, লেখক মহিউদ্দিন লিখেছে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করছেন এটা একটা ডাহা মিথ্যা কথা। তিনি মন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। পদত্যাগ করার পর তাকে টি বোর্ডের চেয়ারম্যান বানানো হয়েছিলো।

১৯৬৭ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত ডাকসু’র এই নন্দিত ভিপি আরো বলেন, টি বোর্ডের চেয়ারম্যান আর তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদককে ভিত্তি হিসেবে নিয়ে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করেছেন। আবার স্বাধীনতার পরে তাজউদ্দিন ভাইকে বাদ দিয়ে জিল্লুর রহমান ভাইকে সাধারণ সম্পাদক করেন।

আবার বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী, তো এটা তো আর ছাড়া যাবে না। তাই তখন তিনি দলীয় প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করে কামরুজ্জামানকে আওয়ামী লীগের সভাপতি করেন। বঙ্গবন্ধু দুই পদে থাকেননি। এই হলো ইতিহাস।

দল গড়ার জন্য মন্ত্রীত্ব ছেড়েছিলেন বঙ্গবন্ধু
২০১৮ সালের ৩০ জুন গণভবনে আওয়ামী লীগের বিশেষ বর্ধিত সভায় বঙ্গবন্ধু’র জ্যেষ্ঠ কন্যা, প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা আবেগাপ্লুত হয়ে বলেছিলেন, ‘মানুষ মন্ত্রী হওয়ার জন্য দল পরিবর্তন করে আর বঙ্গবন্ধু দল গড়ার জন্য মন্ত্রীত্ব ছেড়েছিলেন।

দেশের মানুষকে ভালোবেসে আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।’ এর আগে ২০১৫ সালে ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে প্রধামন্ত্রী বলেছিলেন, ‘একটি কথা বলি, আওয়ামী লীগ সরকার জাতির পিতার নেতৃত্বে যখন ক্ষমতায়, উনি কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট পদ ছেড়ে দিয়ে কামরুজ্জামান সাহেবকে সভাপতি করেছিলেন।

উনাকে মন্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল। তিনি পার্টির প্রেসিডেন্ট হিসাবে পার্টি চালাতেন, কিন্তু মন্ত্রীর মর্যাদায় ছিলেন।’

সেদিন প্রধামন্ত্রী আরো বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু ’৫৭ সালে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। সংগঠনটাকে গড়ে তোলার জন্য পার্টির সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। বাংলাদেশে একমাত্র জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুই পার্টির সাধারণ সম্পাদকের পদ গ্রহণ করে দলকে সুসংগঠিত করতে মন্ত্রিত্ব ছেড়েছিলেন।’

বিএনপি আর আওয়ামী লীগের ইতিহাস লেখা এক নয়
লেখক মহিউদ্দিন আহমদ দেশের আরেকটি রাজনৈতিক দল বিএনপিকে নিয়ে বই রচনা করলেও চরম সমালোচনার মুখে পড়েছেন ‘আওয়ামী লীগ উত্থানপর্ব ১৯৪৮-১৯৭০’ বইটি প্রকাশ করে। সমালোচকরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, বিএনপি’র রাজনীতির সংগ্রামমুখর কোন ইতিহাস নেই।

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আশিকুল পাঠান সেতু কালের আলো’র কাছে অভিযোগ করে বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ। গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, আত্মত্যাগ আর দেশের মানুষের প্রতি অসাধারণ মমত্ববোধের কারণেই বিশ্ব ইতিহাসের মহানায়ক হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।

তিনি ও তাঁর দল আওয়ামী লীগকে নিয়ে লিখতে গিয়ে মিথ্যা ও উদ্ভট তথ্য দিয়ে মহিউদ্দিন আহমদ নেতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এজন্য তাঁর ক্ষমা চাওয়া উচিত। একই সঙ্গে আমি বইটি বাজেয়াপ্ত করার জোর দাবি জানাচ্ছি।

কালের আলো/এএ

Print Friendly, PDF & Email