সৌদি আরবের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক নিয়ে কেন এতো ‘মাথাব্যাথা’ মেননের?

প্রকাশিতঃ 10:03 am | March 12, 2019

বিশেষ প্রতিবেদক, কালের আলো :

এইতো মাত্র মাস কয়েক আগেও সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। এরও আগে ছিলেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। একজন বামপন্থী সংশোধনবাদী ধারার রাজনৈতিক নেতা হিসেবেই তিনি পরিচিত।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটে জিতলেও শরীকদের মধ্যে থেকে মন্ত্রীত্বে যারা বাদ পড়েছেন তাদেরও একজন চীনপন্থী রাজনীতিতে দীক্ষিত এই নেতা। তবে সাম্প্রতিক সময়ে হঠাৎ করেই সংসদে নানা ইস্যুতে সরব হয়ে ওঠেছেন তিনি। দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁর মনগড়া বক্তব্য ও প্রশ্নের কড়া সমালোচনা করে সমুচিত জবাব দিয়েছেন স্বয়ং আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বিশেষ করে সৌদি আরবের সঙ্গে সমঝোতা স্মারকেই যেন রীতিমতো ‘মাথাব্যাথা’ শুরু হয়েছে রাশেদ খান মেননের। ভারত, চীন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ইতোপূর্বে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা চুক্তি থাকলেও সৌদি আরবের সঙ্গে সমঝোতা স্মারকে কত উৎকন্ঠার মধ্যেই না পড়েছেন তিনি!

তাঁর পথ ধরেই যেন হেঁটেছেন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমামও। তাদের ভাষ্যে-এই চুক্তি সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন!

সোমবার (১১ মার্চ) জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আনীত ধন্যবাদ প্রস্তাবের ওপর আলোচনা ও একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বিএনপি প্রথম চীনের সঙ্গে যখন চুক্তি করেছিল সেটা কিন্তু খুব গোপন রেখেছিল। ‘আমাদের চীনপন্থী মাননীয় সংসদ সদস্য (রাশেদ খান মেনন) তখন এ কথাটা উল্লেখ করেছিলেন কিনা জানি না। কিন্তু এবারে তিনি বলেছেন।’

কেউ কেউ বলছেন, মন্ত্রীত্ব হারিয়ে প্রকারান্তরে নিজেকে ভেতরে ভেতরে ‘গুরুত্বহীন’ ভাবছেন মেনন। এই কারণেই হয়তো মিডিয়া ফোকাসে নিজেকে আনতে সমঝোতা স্মারককে চুক্তি হিসেবে আখ্যা দিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করতে চাচ্ছেন। এর পেছনে হয়তো মন্ত্রীত্ব না পাওয়ার ‘ব্যাথাও’ থাকতে পারে।’

জানা যায়, চলতি বছরের পহেলা ফেব্রুয়ারি থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ সৌদি আরব সফর করেন। ওই সময় সৌদি আরবের রিয়াদে বাংলাদেশ দূতাবাসের নবনির্মিত ভবন পরিদর্শনের সময় স্পষ্ট ভাষায় তিনি গণমাধ্যমকে জানান, ‘সৌদি আরবের সঙ্গে বাংলাদেশের সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রতিরক্ষা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হবে।’ পরবর্তীতে এই স্মারক সই হয়।

সেনাপ্রধান সেদিন এই সমঝোতা স্মারকের আদ্যোপান্ত তুলে ধরে বলেন, সৌদি ইয়েমেনের সীমান্তবর্তী যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় মাইন অপসারণে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণের লক্ষ্যে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। এ লক্ষ্যে একটি সমঝোতা স্মারক প্রস্তুত করা হয়েছে। এটি হলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দু’টি ব্যাটালিয়নে প্রায় ১ হাজার ৮০০ সেনা সদস্য মাইন অপসারণ কাজে নিয়োজিত হবে। যা সৌদি আরব ও বাংলাদেশের সামরিক সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে।’

তিনি আরো জানান, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সদস্যদের সৌদি আরবের বিভিন্ন সামরিক, বেসামরিক অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়নকাজে নিয়োজিত করার বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। এছাড়া সেনাবাহিনীর অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের সৌদি আরবের বিভিন্ন সামরিক খাতে নিয়োজিত করার প্রস্তাব দেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন চিকিৎসকেরা কাজের পাশাপাশি সৌদি আরবের বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে পারবে।

সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ সেদিন আরো জানান, সৌদি আরবের ইসলামিক মিলিটারি কাউন্টার টেররিজম কোয়ালিশন (আইএমসিটিসি)-এ বাংলাদেশ থেকে একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেলসহ চারজন কর্মকর্তাকে নিয়োগের জন্য নাম দেওয়া হয়েছে। এই কোয়ালিশনের সঙ্গে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সব ধরনের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে বলে তিনি জানান।

সেনাপ্রধান সৌদি আরবের সামরিক কর্মকর্তাদের বাংলাদেশে প্রশিক্ষণ গ্রহণের কথাও উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘সৌদি আরবের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর কর্মকর্তারা বাংলাদেশে মিলিটারি একাডেমি, ডিফেন্স কলেজ ও ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড ও স্টাফ কলেজে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে। জেনারেল আজিজ আহমেদ দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সৌদি আরবের চমৎকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। ভবিষ্যতে প্রতিরক্ষা খাতে এ সম্পর্ক আরও জোরদার হবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন।’

সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ এই সমঝোতা স্মারকের প্রেক্ষাপট ও তাৎপর্যসহ যাবতীয় তথ্য খোদ গণমাধ্যম কর্মীদের সামনে খোলাসা করার পরও গত ১৪ ফেব্রুয়ারি সংসদে বিরোধী দলীয় দুই সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন ও ফখরুল ইমাম এই স্মারকে সংবিধানের ২৫ বিধি লঙ্ঘিত হচ্ছে দাবি করেন।

এর মধ্যে সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান বলেন, সংবিধানে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বজায় রাখতে বলা হয়েছে। তাই এই বিষয়টি পর্যালোচনার দাবি রাখে। প্রথমটি হচ্ছে সেনাবহিনী মোতায়েন। এটা জাতিসংঘের সিদ্ধান্তের সাথে সঙ্গিতপূর্ণ কি না? দ্বিতীয়ত, আমাদের সেনাবাহিনী বিদেশ উপস্থিতিতে আমাদের রাজনৈতিক ভাবমুর্তি কি হবে?

ওইদিন তিনি আরো বলেন, ইয়েমেনে আমাদের সেনাবাহিনী উপস্থিত হয়ে সীমান্তে মাইন অপসারণ করবে, যারা একদিন ইরাকী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কুয়েতে মাইন অপসারণ করে সুনাম অর্জন করেছিল, তারা কেন মাইন অপসারণের নামে নিজেদের জীবন দেবে।

যেটা সংবিধান অনুমোদন করে না। এছাড়া ইয়েমেন সীমান্তে সেনাবাহিনী থাকলে খুব স্বভাবিকভাবেই একটি বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক সেখানে সৃষ্টি হবে। তাই আমি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ৩০০ বিধিতে একটি বিবৃতি দাবি করছি। পাশাপাশি বিষয়টি সংবিধানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কি না সে বিষয়ে আপনার (স্পিকার) কাছ থেকে রুলিং আশা করছি।’

সংবিধান লঙ্ঘনের প্রশ্নই আসে না : পররাষ্ট্রমন্ত্রী
সৌদি আরবের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বিষয়ক একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে এবং এতে সংবিধান লঙ্ঘনের প্রশ্নই আসে না বলে রোববার (১০ মার্চ) সংসদে বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ সৌদি আরবে সৈন্য মোতায়েন সংক্রান্ত কোনো চুক্তি স্বাক্ষর করেনি। বরং বাংলাদেশ-সৌদি আরবের মাঝে প্রতিরক্ষা বিষয়ক একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে, যার মাধ্যমে দুই দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনী সামরিক প্রশিক্ষণ ও অনুশীলন, শিক্ষা, সামরিক তথ্য ও গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়, প্রতিরক্ষা শিল্প সরবরাহ ও রক্ষণাবেক্ষণ, পরিদর্শন, দক্ষতা বিনিময়, সামরিক চিকিৎসা ও গবেষণা, সমাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ, বিনোদন, প্রযুক্তি বিষয়ক আলোচনা, সামরিক সদস্যদের পারস্পরিক বিনিময়, সামরিক সুরক্ষা ও জলদস্যুতা প্রতিরোধ ইত্যাদি ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে।’

‘বাংলাদেশের সংবিধানের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকার অঙ্গীকারাবদ্ধ। শেখ হাসিনার সরকারের সংবিধানের বাইরে যাওয়ার কোনো দৃষ্টান্ত অতীতে ছিল না, এখনো নেই, ভবিষ্যতেও থাকবে না’ যোগ করেন মন্ত্রী।

সৌদি আরবের সঙ্গে চুক্তি নয়, সমঝোতা স্মারক : প্রধানমন্ত্রী
একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে সাবেক মন্ত্রী ও বিরোধী দলের ‘হঠাৎ উৎকন্ঠিত’ নেতা রাশেদ খান মেননের প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মুজিবকন্যা বলেছেন, ‘এটি চুক্তি নয়, সমাঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করা হয়েছে।

এ ধরনের সমঝোতা স্মারক বহু দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের আছে। আমাদের প্রতিরক্ষা চুক্তিও অনেক দেশের সঙ্গে আছে। আমাদের বামপন্থী রাজনীতি যারা করতেন, যেসব দেশের আদর্শকে তারা ধারণ করে চলতেন, সেসব দেশের সঙ্গেও এই চুক্তি রয়েছে।

এখন কিন্তু “গ্লোবাল ভিলেজ”– এটা মনে রাখতে হবে। আমাদের সশস্ত্র বাহিনী কেবল আমাদের দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। জাতিসংঘের অধীনে তারা বিশ্বের সংঘাতপূর্ণ দেশে শান্তিরক্ষা মিশনে কাজ করে যাচ্ছে। এর বাইরে যুদ্ধবিধ্বস্ত কুয়েত গড়ে তোলা ও সেখানকার মাইন অপসারণ করার জন্য আমাদের সশস্ত্র বাহিনী সেখানে দীর্ঘদিন অবস্থান করে কাজ করে যাচ্ছে।’

প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ‘এই সমঝোতা স্মারকের আওতায় দুই দেশের প্রতিরক্ষা বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও তথ্য আদান-প্রদান হবে। সৌদি আরবের অবিস্ফোরিত মাইন অপসারণে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী কাজ করবে। তারা (সৌদি আরব) যদি কোনও দেশের সঙ্গে যুদ্ধ করে তবে সেই যুদ্ধে আমাদের সামরিক বাহিনী জড়াবে না।’

কালের আলো/ওএইচ/এএ