পাণ্ডব যুগের শেষের শুরু!

প্রকাশিতঃ 11:36 am | September 17, 2022

প্রভাষ আমিন:

জীবনে চলতে জানার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ থামতে জানা। আমরা যখন চলতে শুরু করি, তখন ভাবি সারা জীবন বুঝি একই গতিতে চলা সম্ভব। এই ভুল বিশ্বাস আমাদের জীবনের অনেক অর্জনকেই বিসর্জনে বদলে দেয়। এটা আমাদের জীবনের সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কিন্তু সবচেয়ে বেশি প্রযোজ্য খেলাধুলার ক্ষেত্রে। যত ভালোই হোন, একজন খেলোয়াড় সারা জীবন একই রকম খেলতে পারেন না। খেলাধুলার ক্ষেত্রে বলা হয়, ফর্ম ইজ টেম্পরারি, ক্লাস ইস পার্মানেন্ট। কিন্তু ক্লাস যতই ভালোই হোক, বয়সের থাবা সবাইকে কাবু করে ফেলে। মেসি আর রোনালদো এখনও খেলা চালিয়ে যাচ্ছেন বটে, তবে তাদের আগের সেই ক্ষিপ্রতা, আগের সেই গতি, আগের সেই পারফরম্যান্স আর নেই। ক্রিকেটে এটা আরও বেশি প্রযোজ্য। বেশিরভাগই শেষ পর্যন্ত খেলা চালিয়ে যেতে চান। তার যে দিন ফুরিয়ে আসছে, সেটা বুঝতেই পারেন না বা বুঝতে চান না। খেলোয়াড়দের বিষয়টাও আসলে বুঝতে অসুবিধা হয় না। তারা যতক্ষণ খেলতে পারবেন, ততক্ষণই আয় করতে পারবেন। খেলা ছাড়লেই আয় বন্ধ। অনেক তারকা খেলোয়াড়েরও শেষ জীবন কাটে অর্থকষ্টে।

শচীন টেন্ডুলকারের ছেলেবেলার বন্ধু এবং ভারতের একসময়ের তারকা ক্রিকেটার বিনোদ কাম্বলির এখন সংসার চালানোই দায়। কিন্তু ফুটবলার বা ক্রিকেটার যেই হোন, তিনি চাইলেই তো আর খেলতে পারবে না। নির্বাচকরা তাকে দলে নিতে হবে তো। আমাদের অনেক খেলোয়াড়ই বাদ পড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। তাতে মুছে যায় তার অতীতের অনেক অর্জন।

আলোচনাটা এলো বাংলাদেশ ক্রিকেটের সাম্প্রতিক টালমাটাল অবস্থা দেখে। ২-৩ বছর আগেও বাংলাদেশ ক্রিকেট ছিল পঞ্চপাণ্ডব নির্ভর। মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ- এই পাঁচ জনকে ঘিরেই আবর্তিত হতো বাংলাদেশ ক্রিকেটের সব পরিকল্পনা। সাকিব যদিও মনে করেন, পাণ্ডব তিনি একাই, বাকিদের কেউ তার তুল্য নয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই পাঁচ জনই অপরিহার্য ছিলেন। তখন মনে হতো, এই পাঁচ জন না থাকলে বুঝি বাংলাদেশ ক্রিকেট শেষ হয়ে যাবে। দীর্ঘদিন একসঙ্গে খেলার কারণে তাদের বোঝাপড়াটাও ভালো ছিল। পারফরম্যান্সের সাথে অভিজ্ঞতার মিশেলে তারা নিজেদের অপরিহার্য করে তুলেছিলেন। কিন্তু ওই যে বললাম, সময়। এই সময় আমাদের অনেক কিছুই কেড়ে নেয়। ধোনীকেও দল থেকে বাদ পড়তে হয়, কোহলিকে নিয়ে কথা হয়; এমনকি সর্বকালের অন্যতম সেরা শচীনকে নিয়েও ফিসফাস শুনেছি।

‘এখনও যাচ্ছে না কেন’ আর ‘এত তাড়াতাড়ি যেতে হবে কেন’ এই দুইটার ফারাকটা বুঝতে পারেন না অনেকেই। সাঙ্গাকারা বা জয়াবর্ধনে ফর্মের তুঙ্গে থেকে অবসর নেন, তখন সবাই বলেন, আরেকটু থেকে গেলে পারতো। এটাই তাদের টাইমিং। আর ক্রিকেটে টাইমিংটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যে শটে আপনার ছক্কা হতে পারে, টাইমিংয়ে গড়বড় হলে সেই একই বলে একই শটে আপনি আউটও হয়ে যেতে পারেন। সমস্যা হলো আমাদের অনেকে সেই টাইমিংটা বুঝতে পারি না। বলছিলাম বাংলাদেশ ক্রিকেটের পঞ্চপাণ্ডবের কথা। এক সাকিব ছাড়া কেউই আর অটোমেটিক চয়েজ নন। বাংলাদেশের সেরা অধিনায়ক এবং বাংলাদেশকে সম্মানজনক পরাজয় থেকে জয়ের ধারায় আনার দিনবদলের নায়ক মাশরাফি হারিয়ে গেছেন অনেক আগেই। বাংলাদেশে একসময় সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তি মাশরাফি মাঠ থেকে তো দূরের কথা, এমনকি আনুষ্ঠানিক অবসর নেওয়ারও সুযোগ পাননি। অবসর না নিলেও মাশরাফি কিন্তু আর ক্রিকেটে নেই।

বাংলাদেশের সেরা ওপেনার তামিম ইকবাল এখনও ওয়ানডে দলের অধিনায়ক, টেস্ট ক্রিকেটেও আছেন। কিন্তু টি-২০ থেকে তার বিদায়টা হয়েছে নিভৃতে। ইনজুরি থেকে ফেরার সময় যখন হলো, তখনও কানাঘুষা শুনলেন, তিনি আছেন, তবে অটোমেটিক চয়েজ নন। তার আগেই মানসম্মান রেখে নীরবে বিদায় বলে দেন। তামিমের ভাগ্য ভালো, টি-২০ ছাড়ার সময়ও কেউ কেউ বলেছেন, আরেকটু থেকে গেলে পারতেন। তামিম নাই বটে, তবে সমস্যা হলো, তারচেয়ে ভালো বিকল্প এখনও খুঁজে পায়নি বাংলাদেশ ক্রিকেট।

মুশফিকুর রহিমের পারফরম্যান্স নিয়েও আলোচনা-সমালোচনা অনেক দিনের। দেরিতে হলেও বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন তিনি। তাই টি-২০-কে বিদায় বলেছেন ফেসবুক স্ট্যাটাসে। কিন্তু মুশফিক যেটা বুঝতে পেরেছেন, সেটা মাহমুদউল্লাহ বুঝতে পারেননি।

মুশফিকের অবসর ঘোষণার সময় অনেকেই মন্তব্য করেছিলেন, ‘মাহমুদউল্লাহকে সাথে নিয়ে যান’। কিন্তু মাহমুদউল্লাহ তাকে অনুসরণ করেননি। বলা হয়, ‘আকেলমন্দকে লিয়ে ইশারাই কাফি’। কিন্তু মাহমুদউল্লাহ ইশারাটাও বোঝেননি। আগের সিরিজে টি-২০ অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহকে বিশ্রাম দেওয়া হয়। সেই সিরিজেই তাকে আবার ফিরিয়েও আনা হয়, তবে অধিনায়ক হিসেবে নয়। এই টানাহেঁচড়া দেখেই মাহমুদউল্লাহর বোঝা উচিত ছিল, তিনি দলের বোঝা হয়ে গেছেন। মাহমুদউল্লাহর সাম্প্রতিক পারফরম্যান্সে আমিও বিরক্ত ছিলাম। তবে তিনি যে বোকার দল থেকে বাদ পড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন, এটা দেখে তার জন্য মায়াই লাগছে। তামিম, মুশফিক তবু অবসরের ঘোষণা দিয়ে মুখরক্ষা করতে পারলেন, মাহমুদউল্লাহ তাও পারলেন না।

এখন যাদের আমরা দূর দূর করে তাড়িয়ে দিচ্ছি, যারা গেলেই আমরা খুশি; সেই মুশফিক, রিয়াদ, মাশরাফি, তামিমরাই কিন্তু আমাদের অনেক আনন্দের উপলক্ষ এনে দিয়েছেন। সমস্যা হলো, ক্রিকেটারদের শেষটাই শুধু আমরা মনে রাখি, অতীত ভুলে যাই দ্রুতই। আমরা না হয় আবেগী আমজনতা। কিন্তু ক্রিকেট বোর্ড তো জানে। আমার আফসোস হলো, বোর্ড কেন সিনিয়রদের সম্মানজনক বিদায়ের পথটা বাতলে দেন না। মাশরাফির মতো মহানায়ক কেন মাঠ থেকে বীরের মতো বিদায় নেওয়ার সুযোগ পান না। বোর্ডের মধ্যে কি ক্রিকেটারদের কোনও বন্ধু বা শুভাকাঙ্ক্ষী নেই। তারা কেন অনানুষ্ঠানিকভাবে তাদের বলে দেন না। কেন তাদের মাঠ থেকে বিদায়ের মঞ্চটা তৈরি করে দেন না। মাহমুদউল্লাহ যে বিশ্বকাপ পরিকল্পনায় নেই, এটা নিশ্চয়ই বোর্ড বা নির্বাচকরা আগেই জানতেন। যদি তাকে বলতেন, বাদ দেওয়ার আগেই তুমি অবসর নিয়ে নাও, তাহলে বিষয়টা অনেক সম্মানজনক হতে পারতো। পাণ্ডবদের বিদায়ই যদি এমন গ্লানির হয় তাহলে সাধারণ মানের খেলোয়াড়দের কী হবে। গুণীদের সম্মান না দেওয়ার এই রীতি যদি চলমান থাকে, তাহলে নতুনরা কী দেখে অনুপ্রাণিত হবে।

পাণ্ডবদের শেষের শুরুটা হয়েছে আগেই। একমাত্র সাকিব এখনও তিন ফরম্যাটেই আছেন, টেস্ট আর টি-২০তে আছেন অধিনায়ক হিসেবে। তামিম, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ এই আছি, এই নেই। বলা ভালো, বাংলাদেশ ক্রিকেট এখন এক টার্নিং পয়েন্টে দাঁড়িয়ে আছে, চলছে পালাবদলের খেলা। এই সময়েই ক্রিকেটকে ঘিরে আছে নানা বিতর্ক। কোচদের আসা-যাওয়া, দলের ভেতরে নানা গ্রুপিং, খেলোয়াড়দের বিতর্কে কারও কারও স্ত্রীর জড়িয়ে পড়াও অস্বস্তি তৈরি করছে ক্রিকেটে। আর ক্রিকেট বোর্ডের অদ্ভুতুড়ে কাণ্ডকারখানা তো আছে। আর বরাবরের মতো বিতর্কের কেন্দ্রে আছেন সাকিব আল হাসান। সাকিব বিশ্বেরই সেরা অলরাউন্ডার। কিন্তু শুধু মাঠে নয়, মাঠের বাইরের পারফরম্যান্সেও তিনি অলরাউন্ডার। অতীতের ধারাবাহিক বিতর্ক তো আছেই, সর্বশেষ শেয়ার কেলেঙ্কারিতেও এসেছে সাকিবের নাম।

তবে আমাদের চাওয়া হলো, আমরা যেন কারও অবদান ভুলে না যাই। যার যেটুকু প্রাপ্য, সেটুকু সম্মান যেন আমরা দেই। আর সব বিতর্ক পেছনে ফেলে বাংলাদেশ ক্রিকেট যেন দুঃসময় পেছনে ফেলে এগিয়ে যায় নতুন উচ্চতায়। সময়ের কারণেই পাণ্ডবদের বিদায় নিতে হবে। লিটন, সোহান, মিরাজ, আফিফ, রাব্বীরাও যেন ভয়ডরহীন ক্রিকেট দিয়ে নতুন দিনের যাত্রা শুরু করে। বাংলাদেশ টি-২০ ভালো খেলে না, এই বিশ্বকাপেই সেই বদনাম ঘুচে যাক।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

Print Friendly, PDF & Email