জিয়ার হাত ধরে বাংলাদেশে গুম-হত্যা শুরু হয়েছিলো : মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী
প্রকাশিতঃ 3:04 pm | August 31, 2022

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালে সেনা ও বিমানবাহিনীর সদস্যদের প্রক্রিয়া না মেনে অন্যায়ভাবে ফাঁসি দিয়েছিলেন বলে জানিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।
তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে গুম এবং হত্যা শুরু হয়েছিলো জিয়ার হাত ধরেই। মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছেন। ১৯৭৭ সালের অক্টোবর মাসে তাদেরকেই ফাঁসিতে ঝোলান জিয়াউর রহমান। বিচার করার বিধি-বিধান আছে। কিন্তু কোনো নিয়ম জিয়া মানে নাই। নাম একজনের দেখে আরেকজনকে ফাঁসির কাষ্ঠে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আগে গুম করা হয়েছে তারপরে ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। তাদের লাশটা পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
মঙ্গলবার (৩০ আগস্ট) দুপুরে আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘১৯৭৭ সালে খুনি জিয়ার সামরিক ষড়যন্ত্রের শিকার আমরা’ শীর্ষক ব্যানারে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় মন্ত্রী এসব কথা বলেন।
আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, পৃথিবীর অনেক দেশে নজির রয়েছে মুক্তিযোদ্ধারা অপরাধ করলে তাদের অপরাধকে ক্ষমা করে দেয়া হয়। আর এখানে তাদের বিচার করার আগেই ফাঁসি দেয়া হয়েছে। একটু আগে বিচারপতি বলে গেলেন মৃত ব্যক্তিদের বিচার হয় না। তবে গণদাবিতে অনেক কিছুই হয়। আইনের বাইরেও অনেক কিছু করতে হয়। গণমানুষের প্রয়োজনে আইনের ব্যত্যয়ও ঘটে। পৃথিবীতে মরণোত্তর বিচারের নজির আছে। বহু দেশে মরণোত্তর বিচার হয়েছে। সেই দায়িত্বববোধ থেকে জিয়ার মরণোত্তর বিচার হওয়া বাঞ্ছনীয় ও জরুরি। এটা করা কোনো বেআইনিও হবে না।
বঙ্গবন্ধু হত্যায় জিয়ার ‘প্রত্যক্ষ’ সম্পৃক্ততা রয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, জিয়া ছিলেন বর্ণচোরা মুক্তিযোদ্ধা। ওয়ার কাউন্সিল গঠন করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সংগঠিত মুক্তিযুদ্ধকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্র করেছিলেন। গণদাবিতে অনেক কিছুই হয়েছে, জিয়ার মরণোত্তর বিচার জরুরি ও বাঞ্ছনীয়। ১৫ অগাস্টের যারা আত্মস্বীকৃত খুনি তাদেরকে জিয়া পুনর্বাসন করেছেন। যারা মুক্তিযোদ্ধাদের বিরোধিতাকারী তাদেরকে মন্ত্রী বানিয়েছেন। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন।
সভায় সাবেক বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, জিয়া কর্তৃক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো আর্তনাদ শুনেছি। জিয়াকে যদি আবারও কোথায় পাওয়া যায়, তাকে ধরে যেন ফাঁসিতে ঝুলানো হয়। তাহলে কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলো শান্তি পাবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় জিয়ার বন্দুক থেকে একটি বুলেটও বের হয়নি। তার কাজ ছিল পাকিস্তানের চর হিসেবে কাজ করা। ফারুক, ডালিমসহ জিয়ার এজেন্ডা ছিল বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানী রাষ্ট্রে পরিণত করা।
তাই মুক্তিযোদ্ধাদের শেষ করার সুযোগ খুঁজছিল জিয়া। ’৭৭ সালের ২ অক্টোবর সুযোগ পেয়েই প্রহসনের বিচারের নামে দেড় হাজারের অধিক মুক্তিযোদ্ধাকে ফাঁসি দিয়েছে। আড়াই হাজারের মতো সেনা সদস্যকে সাজা দিয়েছে। মিনিটে একজনকে ফাঁসি দিয়েছে। বিচারের ন্যূনতম প্রক্রিয়া মানেনি জিয়া। জিয়ার নাম বাংলার মাটিতে থাকবে ঠিকই। তবে খুনী হিসেবে, হৃদয়হীন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী পাকিস্তানী দালাল হিসেবে থাকবে। জিয়ার তখনকার কর্মকা- তদন্তে রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতিকে রিভিউ করার নির্দেশ দিতে পারেন, সেটি করা হোক। ৪ নেতা হত্যার ও ’৭৭ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যার বিষয়েও দুটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হোক। এসময় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে জিয়ার কবর অপসারণসহ তার মরণোত্তর বিচার দাবি করে সাবেক এই বিচারপতি।
মেজর জেনারেল (অব) হেলাল মোর্শেদ বলেন, দুই থেকে তিন হাজার মুক্তিযোদ্ধা, সামরিক বাহিনীর সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়েছিল বিনা বিচারে। মৃত্যুদ- দেয়ার আগেই দ- কার্যকর করা হয়েছিল। কোন নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হয়নি। ৪৫ বছর আগের ওই ঘটনায় ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের কান্না শুনে বিহ্বলিত হচ্ছি। তিনি বলেন, একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে আজ এখানে এসেছি। মুক্তিযুদ্ধে অনেক হতাহত দেখেছি। মুক্তিযোদ্ধাদের আকুতি আমার কাছে পরিচিত।
মুক্তিযোদ্ধাদের কথাবার্তা, দাবি-দাওয়ার কথা শুনতাম। সব আক্ষেপকে ছাপিয়ে তারা বিচার চান। বিচার না হলে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মা শান্তি পাবে না। শুধু নামের মিল থাকায় তার মামা শ্বশুর বিমানবাহিনীর কর্পোরাল আমজাদ হোসেনকে ১০ দিন জেলে আটকে রাখা হয়। এরপর ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়। তাকে ফাঁসির অজু করানো হয়, জল্লাদ মুখে কালো কাপড় পরিয়ে মঞ্চের দিকে নিয়ে যায়। এ সময় চিৎকার করে আমজাদ বলেন, আমি সেই আমজাদ নই। পরে ম্যাজিস্ট্রেটের চৌকস অভিজ্ঞতায় আমজাদ ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও তিনি বাকি জীবন আর স্বাভাবিকভাবে কাটাতে পারেননি।
’৭৭ সালে যারা অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত হয়েছেন, সাজা ভোগ করেছেন তারাও তাদের দুর্বিষহ অভিজ্ঞতার কথা শোনান। ৪ বছর সাজা ভোগ করা সার্জেন্ট এমএ মজিদ বলেন, জিয়া ষড়যন্ত্রের বাহানা করে তাকেসহ অনেককে চাকরিচ্যুত করেছে। জেল খেটে এসে অনেক সহকর্মী জিজ্ঞেস করত, জানতে চাইত- ভাই, আমি কেন জেল খাটলাম। একজন লোক জানে না, সে কি কারণে জেল খাটল।
সভাপতির বক্তব্যে শহীদ সার্জেন্ট বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল বাশারের মেয়ে বিলকিস বেগম বলেন, আমার বাবাকে ১ অক্টোবর ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। আমার ছোট বোন তখন মায়ের পেটে। আমার বৃদ্ধা মা বাবার শোকে কাঁদতে কাঁদতে পাগল হয়ে গেছেন। আজও অনুষ্ঠানে আসার আগে মাকে হাসপাতালে ডাক্তার দেখিয়ে এসেছি। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন, আমার বাবাসহ যাদের ফাঁসি দেয়া হয়েছে, চাকরিচ্যুত ও সাজা দেয়া হয়েছে-এসব ঘটনায় জড়িত খুনী জিয়ার বিচার যেন হয়। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে মা এটাই জানতে চেয়েছেন, তার স্বামী দোষী নাকি নির্দোষ?
কালের আলো/ডিএ/এমএম