‘গণতন্ত্র মঞ্চ’: নেতারাই ‘কনফিউজড’!

প্রকাশিতঃ 10:42 am | August 10, 2022

আমীন আল রশীদ :

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দেশের রাজনীতিতে আরেকটি নতুন জোট আত্মপ্রকাশ করলো; নাম ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’। ৮ আগস্ট (সোমবার) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ ঘটে এই সাত দলীয় জোটের।

জোটভুক্ত দলগুলো হলো, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), নাগরিক ঐক্য, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ, ভাসানী অনুসারী পরিষদ ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন।

এরমধ্যে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) এবং বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি ছাড়া বাকি দল-সংগঠনগুলো নির্বাচনে কমিশনে নিবন্ধিত নয়। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত না হলে সেই দলের প্রার্থী হয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ নেই। সেক্ষেত্রে আগ্রহীরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে জয়ী হতে পারেন। অতীতে দেখা গেছে, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অনেকে কোনও দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যান।

যে সাতটি দল মিলে নতুন এই মঞ্চ তৈরি করলো তার মধ্যে সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য এবং জোনায়েদ সাকির গণসংহতি আন্দোলন মূলত মানুষের কাছে পরিচিত দলের প্রধান ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত কারণে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিপি, আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা এবং ভালো বক্তা হিসেবে মাহমুদুর রহমান মান্নার ব্যাপারে জনগণের কিছুটা আগ্রহ আছে। আর জোনায়েদ সাকি মূলত টেলিভিশনে টকশোতে সাহসী বক্তব্যের জন্য অনেকের কাছে প্রশংসিত। তার দল দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের চেষ্টা করছে। কিন্তু নিবন্ধ পায়নি। এ নিয়ে উচ্চ আদালতে রিটও হয়েছে। নাগরিক ঐক্যকে নিবন্ধন দেওয়া হলেও পরে তা বাতিল করা হয়।

এর বাইরে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রয়াত সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার ছেলে রেজা কিবরিয়া এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের নবগঠিত গণঅধিকার পরিষদের ব্যাপারে জনমনে এখন পর্যন্ত পরিষ্কার ধারণা তৈরি হয়েছে—তা বলা যাবে না। ভাসানী অনুসারী পরিষদ ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের নামও খুব বেশি মানুষ জানে বলে মনে হয় না।

স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রবের নাম জড়িয়ে আছে। আর বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির শীর্ষ নেতা সাইফুল হক একজন সজ্জন মানুষ হিসেবে পরিচিত। তা সত্ত্বেও তাদের দল জেএসডি এবং বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি দেশের রাজনীতিতে খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়।

তার মানে যে সাতটি দল-সংগঠন মিলে এই মঞ্চ গঠন করলো, এটিকে শক্তিশালী জোট বলবার কোনও সুযোগ নেই। তারা নিজেদের সরকারবিরোধী জোট হিসেবে দাবি করলেও আওয়ামী লীগের মতো শক্তিশালী ও বৃহৎ দলের বিরুদ্ধে; রাজপথে এবং ভোটের মাঠে তারা কী করতে পারবে—তা নিয়ে খুব বেশি আলোচনার প্রয়োজন নেই।

তাহলে কেন এই জোট
নতুন জোটের আত্মপ্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে সরকারবিরোধী আন্দোলনের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে এই মঞ্চ গঠিত হয়েছে।

এর আগে গত ২ আগস্ট গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, তৃতীয় শক্তি হতে জোট বাঁধছেন রব, মান্না, সাকী, নূর। এদিন এক অনুষ্ঠানে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘মানুষের এখন এমন অবস্থা তারা আওয়ামী লীগকেও বিশ্বাস করে না। আবার বিরোধী দল হিসেবে বিএনপিকেও বিশ্বাস করে না। তারা বিকল্প চায়। আমরা সে চেষ্টা করছি। আমরা একটা পরিবর্তন চাই এবং মানুষকে সেটি বোঝাতে হবে। এই পরিবর্তন শুধু সরকারের পরিবর্তন না, রাষ্ট্রব্যবস্থারও পরিবর্তন।’

যদিও গণঅধিকার পরিষদের আহ্বায়ক রেজা কিবরিয়া সম্প্রতি জানিয়েছেন, তারা বিএনপির ডাকের অপেক্ষায় আছেন। আবার তার মানে এখানে জনাব মান্না ও রেজা কিবরিয়ার বক্তব্যের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট। অথচ নতুন যে জোট করা হলো, সেখানে এই দুটি দলই রয়েছে।

সম্প্রতি বিএনপির সঙ্গে সংলাপ শেষে জোনায়েদ সাকিও বলেছেন, তারা সরকার পতন ইস্যুতে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করবেন। যদিও জনাব সাকি আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে একই মনে করেন।

যারা তৃতীয় শক্তি হতে চান; আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে এক মনে করেন, তাদেরই কেউ কেউ বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের কথা বলছেন কেন, সেই প্রশ্নের সুস্পষ্ট জবাব নেই। জোটের একজন নেতা বলছেন তারা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে তৃতীয় শক্তি হবেন; আরেকজন বলছেন তারা বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করবেন। অর্থাৎ যারা আওয়ামী বিরোধী জোট করছেন, তারা নিজেরাই ‘কনফিউজড’। এরকম সংশয় নিয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনের ডাক দিলে মানুষ তাতে কেন সাড়া দেবে?

বিএনপির মতো দলই যেখানে আওয়ামী লীগের গত তিন মেয়াদে রাজপথে বড় কোনও আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে, সেখানে নতুন এই মঞ্চ কী করবে? এই মুহূর্তে যেসব জনইস্যু রয়েছে, যেমন নিত্যপণ্য ও জ্বালানি তেলের দাম, লোডশেডিং—সেসব ইস্যুতেও তারা যদি রাজপথে আন্দোলনের ডাক দেয়, কতজন সাড়া দেবে?

এই সাতটি দল-সংগঠনের মোট নেতা, কর্মী ও সমর্থকের সংখ্যা কত? তারা সবাই মিলে রাস্তায় নামলেও সেই সংখ্যাটি কত হবে?

বাস্তবতা হলো, দেশের সব ছোট দল মিলেও মাঠ ও ভোটের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগকে মোকাবিলা করার ক্ষমতা রাখে না। এখন পর্যন্ত দেশের মানুষ মনে করে আওয়ামী লীগের বিকল্প হচ্ছে বিএনপি। তাহলে কি এখন সরকার পতনের দাবিতে আন্দোলন করার জন্য জোট করছেন, তারা শেষ পর্যন্ত বিএনপির ঘাটেই তরি ভিড়াবেন?

যদিও নুরুল হক নুর বলেছেন, ‘বিএনপিকে ক্ষমতা দেওয়া যাবে না।’ কিন্তু বিএনপির নেতৃত্বে যদি কোনও জোট হয় এবং যদি নির্বাচনে এই জোট জয়ী হয় তাহলে স্বাভাবিকভাবে বিএনপিই সরকার গঠন করবে। কারণ অবাধ সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলেও এককভাবে রেজা কিবরিয়া ও নুরল হক নুরের দল গণঅধিকার পরিষদ কিংবা অন্যান্য দল মিলে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করলেও তাদের দশটির বেশি আসনে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। সুতরাং আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে তৃতীয় শক্তি গঠন করে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখা যত সহজ, বাস্তবতা তার চেয়ে আরও অনেক বেশি কঠিন।

তবে রাজনীতিতে যেহেতু শেষ কথা বলে নেই, ফলে ভোটের আগে যে আরও অনেক কিছু ঘটবে; আরও একাধিক জোট হবে এবং জোট ভাঙবে; ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও হয়তো জোট করবে, সেই জোটে জাতীয় পার্টি আপাতত থাকবে না বলে মনে হলেও শেষমেশ তারা আগের মতোই আওয়ামী লীগের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধবে কিনা—এসব বিষয়ে এখনই উপসংহারে পৌঁছানো কঠিন।

বলা হয়, নির্বাচনি মাঠ দখলের চেয়েও বেশি প্রয়োজন আন্দোলনের মাঠ দখল। অতীতে দেখা গেছে, ভোটের আগে যেসব দল ও জোট আন্দোলনের মাঠ দখল করতে পেরেছিল, তারাই আন্দোলন পরবর্তী নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় গেছে।

১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগে আন্দোলনের মাঠ ছিল আওয়ামী লীগের দখলে। তারা ওই নির্বাচনে জিতেছে। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে রাজপথ বিএনপির দখলে ছিল এবং ওই নির্বাচনে তারা জয়ী হয়। ২০০৭ সালের নির্বাচনের আগে দেশের রাজনীতিতে টালমাটাল অবস্থা সৃষ্টি হয় এবং তখন আন্দোলনের মাঠ ছিল আওয়ামী লীগের দখলে। দুই বছর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব পালনের পর ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয় আওয়ামী লীগ। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপি আন্দোলনের মাঠে থাকলেও তারা সুবিধা করতে পারেনি। ব্যাপক প্রাণহানি হয়েছে ঠিকই—সরকার সেই আন্দোলন দমনও করেছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পরেও বিএনপি কোনও ইস্যুতেই সরকারকে নড়াতে পারেনি।

২০১৮ সালের নির্বাচনের পরেও এখন পর্যন্ত কোনও ইস্যুতে বিএনপি বা কোনও দল বা জোট বড় কোনও আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। আগামী নির্বাচনে বিরোধীদের মূল দাবি নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের অধীনে ভোট—যে সরকারের প্রধান হবেন শেখ হাসিনা ছাড়া অন্য কেউ। এই দাবি আদায়ে যদি বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ব্যর্থ হয়, তাহলে আগামীতে আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতায় আসবে—এ বিষয়ে সন্দেহ কম। কিন্তু এরকম একটি বড় দাবি মানতে গেলে যেখানে সংবিধান সংশোধন করতে হবে, তাতে আওয়ামী লীগকে বাধ্য করানোর ক্ষমতা কি নবগঠিত গণতন্ত্র মঞ্চের আছে? সহজ উত্তর হচ্ছে ‘না’। যদি না থাকে তাহলে তারা কী করবে? শেষমেশ তারা বিএনপির সঙ্গেই জোট করবে নাকি তৃতীয় শক্তি হিসেবে নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণের চেষ্টা করবে—যা বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে শুধু কঠিন নয়, রীতিমতো অসম্ভব? এটি দেখতে হলে আগামী কয়েক মাসের রাজনীতির চেয়েও নজর রাখতে হবে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির দিকে।

লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।

Print Friendly, PDF & Email