আমার কাছে দেশ মানে এক লোকের পাশে অন্য লোক
প্রকাশিতঃ 11:08 am | April 15, 2022

তুষার আবদুল্লাহ:
মানুষ দেখা আমার শখ। যত দেখি তত তৃষ্ণা বাড়ে। বই পাঠ করার মতোই মানুষ পাঠ করা আমার নেশা। এমন হয় মানুষ পাঠ করতে করতে সহায়ক হিসেবে আমি বইয়ের দিকে হাত বাড়াই। উল্টোটাও হয়, বই পাঠের এক পর্যায়ে মানুষ পাঠ অনিবার্য হয়ে ওঠে।
দুইয়ের পাঠ হয়ে ওঠে আনন্দ পাঠ। কখনো কখনো এই দুইয়ের সঙ্গে যোগ করি প্রকৃতি। এই যে যানজটের এক অসহনীয় শহরে বসবাস আমার। দিনের ঘণ্টা ছয়েক যানজটের দুর্ভোগকে উৎসর্গ করে, জীবনের অপচয় করছি। সেই সঙ্গে আক্রান্ত হয়ে আছি দূষণের ক্ষয় রোগে, তারপরও পুরো চৈত্র জুড়ে ঢাকার পথে পথে ফুটে থাকা ফুল আমাকে আনন্দ দিয়েছে। অবশ্য পথে পথে বললে, মনে হতে পারে ঢাকার সকল রাস্তা নগরবাসীকে দিবারাত্রি ফুলেল সম্ভাষণ জানায়।
আমার মতো যারা হাতিরঝিল, ধানমন্ডি, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দিয়ে যাতায়াত করেন, তাদের চোখে হয়তো পড়তে পারে রক্তরাগ, কুর্চি, বসন্ত মঞ্জুরি, জারুল। বাকি এই মহানগর খানাখন্দ ও ধুলোয় ভরা। রাস্তা কেটেছে একজন, ভরাটের দায়িত্ব আরেক জনের। তিনি কবে সদয় হবেন, কেউ জানে না।
রমজানে যানজট না হয়ে উপায় কি? অফিস আদালতের পাশাপাশি বিদ্যায়তন খোলা। সবাই মোটামুটি বাড়ি গিয়ে ইফতার করতে একই সময়ে পথে নামছেন। গণপরিবহন সংকটের শহরে ব্যক্তিগত ব্যবহারে গাড়ি বাড়ছে ক্রমশ। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প এবং রকমারি দখলে রাস্তার পরিমাণ কমেছে।
দ্বিতল রাস্তা যে ঠিকঠাক বা সুদূর পরিকল্পনা নিয়ে করা হয়নি, সেটা এখন সকলেই উপলব্ধি করতে শুরু করেছেন। সেবা সংস্থাগুলোও এ নিয়ে মুখ খুলতে শুরু করেছে। অপরিকল্পিত ও সুদূর ভাবনা নিয়ে যে শহর গড়ে উঠেনি, সেই শহরে স্বস্তি খোঁজা বোকামি। নতুন বছরেও ঐ গোত্র থেকে নিজেকে দূরে রাখতে চাই।
মানুষের হিংস্রতার আরও অনেক কারণের মধ্যে একটি বড় কারণ হচ্ছে, সে জোট বদ্ধ থাকতে পারছে না বা থাকতে দেওয়া হচ্ছে না। ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হচ্ছে। শুধু শারীরিকভাবে নয়, মানসিকভাবেও।
মানুষের দিকে যে তাকাব, সেই সহজ মানুষ কই। পণ্য বা বাজার সভ্যতার যুগে, মানুষ হয়তো জটিল হয়ে উঠেছে অনেক আগে থেকেই। শুধু মেট্রোপলিটন শহরের মানুষ নয়, গ্রামের মানুষও এখন অনেক দুর্বোধ্য। নগর গিয়ে যেভাবে হামলে পড়েছে, তাতে গ্রাম মুখ লুকিয়েছে। নগরের জটিলতা, প্রতিযোগিতা, ভোগ সবই এখন গ্রামে সুলভ।
রাজনীতি এখানে কোচের দায়িত্ব পালন করেছে। গ্রামের সহজ মানুষ বদলে যেতে পেরেছে তড়িৎ। দুর্বোধ্যতা তাও মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু মানুষের হিংস্রতা কি মেনে নেওয়া যায়? মানুষ যখন নেকড়ের রূপ ধরে তখন, তাকে পাঠ করায় আনন্দ নেই বরং আতঙ্ক, ভয় এসে জাপটে ধরে ভূতের গল্পের মতো।
মানুষের হিংস্র হওয়ার কারণ হলো তার বিপন্নতা বেড়েছে। যাপিত জীবনে বেড়েছে আয় ও ব্যয়ের দূরত্ব। সামাজিকভাবে শ্রেণিগত অবনমন ঘটছে তার। অন্যদিকে আরেক মানুষ ফন্দি ফিকির করে উঁচু তলায় উঠে যাচ্ছে। অপার ভোগের সুযোগ পেয়ে দিশেহারা। কোনো ভোগই তাকে তৃপ্তি দিতে পারছে না। নিজের চেয়ে, অপরের পাতের দিকে তার লোভ। এটাও এক প্রকার মানসিক বিপন্নতা। যা মানুষকে হিংস্র করে তোলে।
মানুষের হিংস্রতার আরও অনেক কারণের মধ্যে একটি বড় কারণ হচ্ছে, সে জোট বদ্ধ থাকতে পারছে না বা থাকতে দেওয়া হচ্ছে না। ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হচ্ছে। শুধু শারীরিকভাবে নয়, মানসিকভাবেও। তার মন নোঙর করার মতো পল্টুন খুঁজে পাচ্ছে না। ফলে মানুষ শত্রু হয়ে উঠছে মানুষেরই।
আদিম সমাজেও এমন ছিল। যদিও সেই আদিমতা মানুষ কখনো ছেড়ে আসতে পারেনি। তবু কিছু শুভ চিন্তা, দেখার সুন্দর চোখ মানুষকে সভ্য বলে ডাকার সুযোগ দিয়েছিল। মানুষকে সুন্দর থাকতে দেওয়া হয় না। সুন্দর বিশ্বাসেও দেওয়া গণহত্যার না স্থির থাকতে।
বিশ্বাস পবিত্র। সেই পবিত্রতা থেকে মানুষকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয় হুজুগের খোয়ারে। সেখানে মল্ল যুদ্ধটা আরও বীভৎস হয়। সেই বীভৎসতা কারো কারো জন্য উপভোগ্য। কিন্তু বিপন্ন হয় সুন্দর ও সভ্যতা। ধর্মের বিশ্বাসে মনোনিবেশ বা অনুশীলনে মন না দিয়ে মানুষকে উন্মাদ করে রাখা হচ্ছে পোশাকে।
হিজাব, বোরকা এ বিষয়গুলো ব্যক্তির পছন্দ ও অধিকারের বিষয়, টিপ দেওয়া না দেওয়াও একই কথা। ধর্ম বিজ্ঞানের বাইরে নয়। কারণ সৃষ্টি মানেই বিজ্ঞান। সুতরাং ধর্ম নিয়ে আলোচনায় বিজ্ঞান আসবে যেমন, তেমনি বিজ্ঞানের আলোচনাতেও ধর্ম আসবে। কারণ ধর্ম জীবনের অংশ। এই দুই নিয়ে মানুষের প্রশ্ন থাকা স্বাভাবিক।
ভিন্ন মত থাকা ও তর্কও সুন্দর হয়ে উঠতে পারে যদি মানুষের মধ্যে সহিষ্ণুতা থাকে। কিন্তু ধর্ম নিয়ে কথা বললেও, ধর্মের মান চলে যাচ্ছে বলে চিৎকার করতে গিয়ে আমরা ভুলে যাই, ধর্মের একটি বড় গুণ বা উপকরণ সহিষ্ণুতা।
ভিন্ন মত থাকা ও তর্কও সুন্দর হয়ে উঠতে পারে যদি মানুষের মধ্যে সহিষ্ণুতা থাকে। কিন্তু ধর্ম নিয়ে কথা বললেও, ধর্মের মান চলে যাচ্ছে বলে চিৎকার করতে গিয়ে আমরা ভুলে যাই, ধর্মের একটি বড় গুণ বা উপকরণ সহিষ্ণুতা। মানুষ এই সহিষ্ণুতা হারিয়ে ফেলছে বলেই তার বিপন্নতা প্রকট হয়ে উঠছে।
বাঙালি সংস্কৃতির মৌলিকত্ব হারানোর কোনো ভয় নেই। কোনো সংস্কৃতিরই জুজু’র ভয় থাকে না। সকল সংস্কৃতিরই বাইরের বা অতিথি আচার হজমের শক্তি আছে। এই ভূমিতে কত শাসক, পরিব্রাজক, ব্যবসায়ী, ধর্ম প্রচারক এসেছেন। এখনো আসছেন। তথ্যপ্রযুক্তির বহুমাত্রিকতায় পৃথিবী এখন এক উঠোনের বাড়ি। সেখানে এই ভূমিরও হজম ক্ষমতা বাড়ার কথা। ভূমির হয়তো আছে। কিন্তু ভূমির মানুষ দোআঁশ মাটির মতো হতে পারেনি।
সংকট এখানেই। ভূমির সঙ্গে আমাদের দূরত্ব বাড়ছে। আমরা কোথায় যেন উড়াল দিতে চাইছি। গন্তব্যহীন কুসুম আকাশে আমরা আমাদের আর খুঁজে পাচ্ছি না বলেই, সর্বত্র ঝরে পড়ার, ভেঙে পড়ার আওয়াজ।
নতুন বছরে সেই আওয়াজ আর কানে তুলতে চাই না। খুব বেশি কিছু নয়, সামান্য চাওয়া-মাটির সঙ্গে সম্পর্ক আবার তৈরি হোক। দেখবেন টিপ, হিজাব, ধর্ম- বিজ্ঞান, মন্দির, মসজিদ, লোভ এবং মানুষের হিংস্রমুখ সরে গিয়ে, একদম বৈশাখের তরুণ পাতার মতোই সহজ মানুষ আসবে ফিরে আবার।
গণমাধ্যমকর্মী