দলবাজ নাকি শুভাকাঙ্ক্ষী?

প্রকাশিতঃ 10:42 am | December 19, 2021

তুষার আবদুল্লাহ :

বিজয় দিবসের বিকাল থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনার প্রতিপাদ্য ছিল ‘বানান’। এখনও সেই আলোচনা চলমান। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর শেখ রেহানা পোডিয়ামে এলেন, দাঁড়ালেন এবং দর্শক হিসেবে আমাদের সামনে ভেসে উঠলো পোডিয়ামে লেখা ভুল বানানটি। বিজয়ের দিনে শপথ নিতে তৈরি সকলেই মুজিববর্ষ ‘মুজিবর্ষ’ হয়ে যাওয়ায় স্তম্ভিত ও বিব্রত। ঝড় ওঠে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বানান নতুনভাবে তৈরি হলো কিনা এ নিয়েও সংশয় প্রকাশ করছিলেন কেউ কেউ। পরিস্থিতি কোন দিকে যায়, আওয়ামী লীগ সমর্থকরা বিষয়টি এড়িয়ে বা চেপে যাবেন কিনা বুঝে উঠতে পারছিল না কয়েকজন। তাই তারা ‘মুজিবর্ষ’ বানানটিকে হালাল করতে মাঠে নামতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের কোনও শুভাকাঙ্ক্ষীর পক্ষে এই ভুল মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।

শুধু আওয়ামী লীগ নয়, বাংলাদেশের কোনও নাগরিকই ‘মুজিবর্ষ’ মেনে নিতে পারেন না। চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে আওয়ামী লীগের সঙ্গে কারও বিরোধ বা দূরত্ব থাকতে পারে, কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এমন ভুল বাঙালির মেনে নেওয়ার কথা নয়। সেটাই হয়েছে। তাই প্রতিবাদে সরব হলেন সবাই। সেই আওয়াজ থামিয়ে দিতে কর্তৃপক্ষ যে প্রযুক্তির ব্যাখ্যা দিলো তা ধোপে টেকেনি। বরং দুই-একজন পুরনো উদাহরণ সামনে এনে দেখালেন– মুজিবর্ষ জুড়ে ভুল বানানটির ব্যবহার চলছিল। কেউ খেয়াল করেননি বা ভুল ধরাননি। কারণ কী? কারণ একটাই– দরদ দিয়ে কেউ দেখেনি। শুভাকাঙ্ক্ষীর চোখে দেখেনি কেউ। সকলে ছিলেন দায়সারাভাবে ইভেন্ট আয়োজনের ব্যস্ততায় বা ইভেন্ট ধরার ‘ধান্দায়’।

মুজিববর্ষের শুরুতে দেখেছি কীভাবে ঝাঁপ দিতে শুরু করেছিল ‘ধান্দাবাজ গোষ্ঠী’। এরা আওয়ামী লীগের নন। বিএনপিরও নন। কিন্তু সব ঘরের মিঠাই-মন্ডায় সবার আগে ভাগ বসান। যদি বই প্রকাশনা দিয়ে শুরু করি, যে প্রকাশকরা বিএনপি সরকারের সময় তাদের নেতা-মন্ত্রীদের গুণকীর্তন করে বই লিখেছেন ও সেসব প্রকাশ করেছেন, তারাই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বই প্রকাশ করতে জান কোরবান করে দিলেন। বাংলা একাডেমির প্রয়াত মহাপরিচালক এবং গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক উভয়ের কাছেই শুনেছি, কত নিম্নমানের বই প্রকাশিত হয়েছে। কোনও কোনও প্রকাশক বইয়ের মলাট বদল করেছেন শুধু। উদ্দেশ্য– মুজিববর্ষে বইয়ের বিপুল সরবরাহের ব্যবসা ধরা।

গণমাধ্যমের অন্যান্য ঘরানারও হঠাৎ সকলকে বঙ্গবন্ধু ভক্ত হয়ে উঠতে দেখলাম। তাদের কারও কারও আনুগত্য কোথায় ছিল আগে, অতীতে ফিরে তাকালেই তা জানা যাবে। খুব সহজেই এরা বঙ্গবন্ধু ভক্ত হয়ে গেছেন, বেশি খাটাখাটুনি করতে হয়নি। একটা মুজিব কোট আর অনবরত সেলফি। এতেই তারা মুজিব অন্তঃপ্রাণ হয়ে উঠলেন। পদ-পদবী, প্রতিষ্ঠান রক্ষা এবং মুজিববর্ষের অনুষ্ঠানের বরাদ্দের বড় ভাগিদার হয়ে উঠলেন তারা। তারাই বারবার নিজেদের আওয়ামী লীগের বলে প্রমাণের জন্য ঢাক পেটাতে থাকেন। দুই-একজনের খোলস এরই মাঝে খসে পড়লেও বেশিরভাগই খোলস ধরে রেখেছেন। এই খোলসধারীরা আওয়ামী লীগের শুভাকাঙ্ক্ষী নন। স্রেফ দলবাজ। তারা মিঠাই-মন্ডার জন্য আজ দলবাজি করছেন।

আওয়ামী লীগ কোনও রাজনৈতিক সংকটে পড়লে একদল উড়াল দেবে। আরেক দল খোলস বদলে ফেলবে মুহূর্তেই। তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে উপলক্ষ্য করে আয়োজিত অনুষ্ঠানগুলো স্রেফ ইভেন্টে পরিণত হয়েছে। সেখানে ভালোবাসা ও আদর্শ অনুপস্থিত। এই ইভেন্ট মনস্কতাই মুজিববর্ষকে ‘মুজিবর্ষ’তে পরিণত করেছে।

ক্ষণিকের দলবাজদের কৌশল হলো ‘জিকির’-এর ঢোলক বাজিয়ে যাওয়া। তারা নির্লজ্জভাবে এই কাজটি করতে পারে। তাদের বাজনায় মোহিত হয়ে পড়েন নীতি-নির্ধারকরা। বাজারেও তাদের দর ওঠে তরতর করে। ফলে ফায়দা আদায়ে বেশিক্ষণ সবুর করতে হয় না। কিন্তু যারা দলের শুভাকাঙ্ক্ষী তারা ক্ষণিকের সওদাগর নন। ব্যক্তিস্বার্থে দল ও আদর্শের জন্য তারা নিবেদিত নন। তাদের নিবেদনের পুরোটাই দল ও আদর্শের জন্য। তাই কোনও বাদ্য-বাজনাতে তারা নেই। দলের সুখের সময় অনাদৃত থাকলেও দুঃখের সময় দলকে আগলে রাখতে কোনোদিন ভুল করেননি। বরং দল সুখের সময় তাদের নিয়ে সংশয়ে থাকে, তারা কি আদৌ দলের?

সামনে ভোট আসছে। খোলস পাল্টানোরা নানান চমক দেখাতে পারে। কিন্তু দলের স্বার্থে আওয়ামী লীগকে কাছে টানতে হবে শুভাকাঙ্ক্ষীদের। দলবাজের খোলসধারীরা বিশ্বস্ত নয় মোটেও।

বিশ্বস্ত যে নয়, তার সবশেষ প্রমাণ রাখলো রাজশাহীর বাগমারার পৌর আওয়ামী লীগ। তারা শহীদদের শ্রদ্ধা জানানোর পর বঙ্গবন্ধুর খুনিদের জান্নাত চেয়েছেন। এটাও নাকি ভুলে হয়েছে। এত ভুল হচ্ছে কেন? খোলস আর ধরে রাখা যাচ্ছে না তাই?

লেখক: গণমাধ্যম কর্মী