শেখ কামাল: একজন আলোকিত ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব
প্রকাশিতঃ 10:37 am | August 05, 2021

অধ্যাপক ড. সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদ :
বাংলাদেশের জন্ম থেকে উন্নয়নের অগ্রযাত্রা—সবই এসেছে বঙ্গবন্ধু পরিবারের হাত ধরে। অর্থাৎ বাংলা ও বাঙালির জন্য যা কিছু মঙ্গলজনক- সবই এসেছে শেখ মুজিব কিংবা শেখ হাসিনার হাত ধরে।
আজীবন দেশের ও মানুষের কল্যাণে নিজেদের আত্মনিয়োগ করেছেন বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যরা। অথচ বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা যেন বিশেষ একটি গোষ্ঠীর প্রিয় বিষয়। এই অপ্রচারের শিকার হয়েছেন বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামাল।
পিতা শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা করেছেন, এরপর বন্দী হলেন। নিয়ে যাওয়া হলো পাকিস্তানের কারাগারে। কী এক অনিশ্চয়তা! এর মাঝেই পরিবারের সদস্যদের ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ফেলে কামাল দেশ মাতৃকার আহ্বানে চলে গেলেন মুক্তিযুদ্ধে।
একাত্তরের বীর সেনানী মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামালের আজ ৭২ তম জন্মবার্ষিকী। বেঁচে থাকলে ৭৩ বছরে পা দিতেন উজ্জ্বল এই ক্রীড়াবিদ। ১৯৪৯ সালের ৫ আগস্ট গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। জন্মের পর পিতা শেখ মুজিবকে তেমন একটা কাছে পাননি। মমতাময়ী শেখ ফজিলাতুন্নেছার আদরেই বেড়ে ওঠেন শেখ কামাল।
পিতার আদর্শে যোগ্য মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলেন শেখ কামাল। দেশকে ভালোবেসে দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে এগিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেন তিনি। মাত্র ২৬ বছর বছরে এক্ষেত্রে সফলও হয়েছিলেন।
রণাঙ্গণে যখন অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন তখনই তিনি স্বপ্ন দেখতেন— স্বাধীন বাংলাদেশ হবে, এই দেশ হবে এক নতুন ক্রীড়াদিগন্ত। স্বাধীন দেশে সীমিত সুযোগের মধ্যেও তিনি আবাহনীর মতো ক্রীড়া সংগঠন গড়ে তোলেন।
ওই সময়ে তরুণদের কাছে আবাহনী ক্রীড়া চক্র যেন ক্রীড়ায় বিপ্লব ঘটিয়ে দেয়। শত বাধা পেছনে ফেলে আবাহনী ক্রীড়া চক্রকে নতুন ধারার ফুটবলের গৌরবের উচ্চ আসনে বসিয়েছিলেন শেখ কামাল। নিজেও ছিলেন একজন কৃতি ক্রীড়াবিদ।
সাফল্যের চূড়ান্তে ট্রিপল ক্রাউন লাভে উৎফুল্ল হয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুও। তিনি ছিলেন আবাহনীর প্রধান উপদেষ্টা। ক্রীড়াজগতে নিজ সন্তানের অসীম সাফল্যে বঙ্গবন্ধু হয়েছিলেন আনন্দিত আর সন্তানের গর্বে ভরা এক পিতা।
শুধু কী তাই? জাতির পিতার পুত্র হওয়া স্বত্ত্বেও নিজে কোনো বাড়তি সুবিধা নেননি। অসাধারণ হয়েও সাধারণের সঙ্গেই নিজেকে দেখেছেন তিনি।
আবাহনী ক্রীড়া চক্র তখন তরুণ প্রজন্মের কাছে একটা ক্রেজ। সারা দেশের শাখা গঠনে সেবার শেখ কামাল ফরিদপুর যাচ্ছিলেন। পদ্মা নদী পারাপারের জন্য বিশেষ ফেরি তখনো ঘাটে ভেড়েনি। এরই ফাঁকে আরিচা ঘাটে খবর ছড়িয়েছে বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামাল এসেছেন।
এ বিষয়ে আবাহনী ক্রীড়া চক্রের প্রতিষ্ঠাকালীন আলোকচিত্রী পাভেল রহমান বলেন, তখন ঘাটে ক্ষুদ্র ফেরিওয়ালাদের ভিড় পড়ে গেল। কলা বিক্রেতা, ডাব বিক্রেতা ছুটে এলেন। তাঁদের অনুরোধ একটাই, রাজার (বঙ্গবন্ধু) ছেলে যেন তাঁদের এই ভালোবাসা গ্রহণ করেন।’
ওই সময় শেখ কামাল ও তাঁর সঙ্গে থাকা ব্যক্তিদের নিয়ে ফেরিটি ওপারে যাওয়ার জন্য ইঞ্জিন স্টার্ট দেয়। তখন ফেরিতে তাদের পাঁচটা গাড়ি ছিলো। কিন্তু পাড়ে আরও অনেক যানবাহন আটকা পড়ে ছিলো।
বিষয়টি প্রথমে প্রথমে কামালের চোখে পড়েনি। যখনই দেখলেন, তাৎক্ষণিক বললেন, ফেরি তীরে ভিড়াতে। ওই সময় অপেক্ষমাণ যাত্রীদের গাড়িসহ যানবাহনগুলো ফেরিতে ওঠে এবং সবাই মিলে ওই পাড়ে যান।
এদিকে মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের বিলুনিয়া থেকে সেনাবাহিনীর প্রথম যে ব্যাচটি কমিশন লাভ করে, শেখ কামাল ছিলেন সেই ব্যাচের একজন সদস্য। এছাড়া বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর প্রথম ব্যাচের একজন ক্যাডেট অফিসার ছিলেন শেখ কামাল।
সেকেন্ড লেফট্যানেন্ট থাকা অবস্থায় তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এমএজি ওসমানীর এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তবুও তার মুক্তিযুদ্ধ যাওয়া নিয়েও প্রোপাগান্ডায় মেতে ওঠে একটি পক্ষ।
শেখ কামাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সহপাঠী থেকে শিক্ষক—সবার সঙ্গে ছিলো তাঁর ভালো সম্পর্ক। সবাইকে সম্মান করতেন, কোনো দাম্ভিক ভাব ছিলো না তাঁর মাঝে। ছিলো না প্রধানমন্ত্রী কিংবা প্রেসিডেন্টের পুত্রসুলভ কোনো অহমিকা।
অথচ কত ঘটনা-ই না সাজানো হয়েছে তাকে নিয়ে? উঠেছে ব্যাংক ডাকাতির মিথ্যা অভিযোগও। ১৯৭৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর, বিজয় দিবস উদযাপনের প্রস্তুতি চলছে।
এর আগের রাতে গুজব ছড়িয়ে পড়ে, ঢাকা শহরের বিভিন্নস্থানে হামলা হতে পারে। এ অবস্থায় বেশ সতর্ক পুলিশ। সাদা পোশাকে পুলিশ গাড়ি নিয়ে শহরজুড়ে টহল দিতে থাকে।
সর্বহারা পার্টির সন্ত্রাসীদের খোঁজে শেখ কামালও তাঁর বন্ধুদের নিয়ে মাইক্রোবাসে করে ধানমন্ডি এলাকায় বের হন। তখন সর্বহারা পার্টির নেতা সিরাজ শিকদারকে ধরতে তৎপর ছিলো পুলিশ। এমতাবস্থায় সন্দেহজনক মনে করে পুলিশ তাদের মাইক্রোবাসে গুলি চালায়। এতে শেখ কামাল ও তাঁর বন্ধুরা গুলিবিদ্ধ হন।
গুলি লাগে শেখ কামালের কাঁধে। তাঁকে তৎকালীন পিজি (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেদিন তাকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলেন সেনা কর্মকর্তা মইনুল হোসেন চৌধুরী।
এ বিষয়ে পরে তিনি তাঁর ‘এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য : স্বাধীনতার প্রথম দশক’ বইয়ে লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু ওই রাতে ছেলের অবাঞ্ছিত ঘোরাফেরায় ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন এবং শেখ কামালকে হাসপাতালে দেখতে যেতে প্রথমে অস্বীকৃতি জানান। পরে ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে বঙ্গবন্ধু হাসপাতালে যান। (পৃষ্ঠা ৬৫-৬৬)’
অথচ এই ঘটনাকে ব্যাংক ডাকাতি বলে চালিয়ে দিয়েছেন সেই সময়ের অনেকে। যার কোনো ভিত্তি পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী লিখেন, ”… স্বাধীনতাবিরোধী ও আওয়ামী লীগ বিদ্বেষীরা এই ঘটনাকে ভিন্নরূপে প্রচার করে। ‘ব্যাংক ডাকাতি’ করতে গিয়ে কামাল পুলিশের হাতে গুলিবিদ্ধ হয়েছে বলে তারা প্রচারণা চালায় এবং দেশ-বিদেশে ভুল তথ্য ছড়াতে থাকে। যদিও এসব প্রচারণায় সত্যের লেশমাত্র ছিল না।”
১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে শেখ কামাল বিয়ে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ব্লু’ খ্যাত ক্রীড়াবিদ সুলতানা কামাল খুকীকে৷ এ বিয়ে নিয়েও অপ্রচার করতে ছাড়েনি ষড়যন্ত্রকারীরা।
তাদের অভিযোগ ছিলো যে, ঢাবি ছাত্রী তৎকালীন স্বনামধন্য অ্যাথলেট সুলতানা খুকীকে শেখ কামাল উঠিয়ে নিয়ে বিয়ে করেন। কিন্তু এটাও সম্পূর্ণ মিথ্যাচার।
স্বনামধন্য অ্যাথলেট খুকীকে পছন্দ করতেন শেখ কামাল। খুকীর বাবা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী। বিষয়টি পরিবারকে জানালে দুই পরিবারের সম্মতি ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এ বিয়ে হয়।
এ বিষয়ে প্রখ্যাত আলোকচিত্রী পাভেল রহমান লিখেন,”… পারিবারিকভাবে কনে দেখার আয়োজনে হলো। বঙ্গবন্ধুর সরকারি বাসভবনে দুই পরিবারের গুরুজনদের নিয়ে ‘কনে দেখা’–র অনুষ্ঠানে সেই সন্ধ্যায় প্রথম সাক্ষাতেই বঙ্গবন্ধু মুগ্ধ হয়ে গেলেন পুত্রবধূ সুলতানা কামাল খুকীর প্রতি। বেগম মুজিব আগেই পছন্দ করে বসেছেন। কনে দেখার সেই সন্ধ্যায় হাসিনা আপা ছোট ভাইয়ের বউকে শরবত খাওয়ালেন। ছোট দেবর শেখ রাসেল মিষ্টি ভাবিকে পেয়ে আনন্দে আটখানা। সেই সন্ধ্যারাতেই কামাল ভাইয়ের বিয়ের তারিখ চূড়ান্ত হয়ে যায়—১৯৭৫ সালের জুলাইয়ে।”
এই থেকে প্রতীয়মান হয় যে, উজ্জ্বল ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব ও মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামালকে নিয়ে এ ধরনের ভিত্তিহীন অভিযোগ ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যেমূলক। জাতির পিতার জ্যেষ্ঠ সন্তান ও আলোকিত মানুষ হওয়ায় ষড়যন্ত্রীরা প্রতিহিংসার কারণে এ ধরনের হীন কর্মকাণ।ড করে।
স্বাধীনতার পর একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকে বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা গড়ে তোলার কাজ শুরু করলেও ষড়যন্ত্রকারীরা সব সময়ই তাঁর বিরুদ্ধে অপ্রচার ও দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে রেখেছে। তাঁকে বরাবরই বড় হুমকি ও বাঁধা মনে করেছে ষড়যন্ত্রকারীরা।
তাইতো তাকে টার্গেট করে ‘নগ্নভাবে’ মিথ্যাচার ও অপপ্রচারে লিপ্ত হয় তারা। তাদের টার্গেট হয়ে শেষ পর্যন্ত হাতে বিয়ের মেহেদীর রঙ মুছার আগেই অকালে প্রাণ দিতে হয় তাঁকে।
এ বছরে আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন করছি। এখনও ষড়যন্ত্র থেমে নেই। ষড়যন্ত্রের জাল বোনা চলছেই। ১৯ বার বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। কিন্তু মানুষের অবিরাম ভালোবাসা তাঁকে ফিরিয়ে এনেছে জনগেণের কাছে। এমন কোনো ষড়যন্ত্রই বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা থামিয়ে দিতে পারবে না। বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে-ই।
কামাল চেয়েছিলেন খেলাধুলার মাধ্যমে বিশ্বে একদিন বাংলাদেশের পতাকা উড়বে পতপত করে। তাঁর সেই স্বপ্ন এখন বাস্তব। ক্রিকেটে বাংলাদেশ বিশ্বে একটি উজ্জ্বল নাম। ক্রিকেটের পরাশক্তিও এখন বাংলাদেশকে সমীহ করছে। শেখ কামাল তো এমন বাংলাদেশই চেয়েছিলেন। জন্মদিনে শহীদ শেখ কামালের প্রতি অজস্র শ্রদ্ধা। শুভ জন্মদিন।
লেখক: উপাচার্য, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়; জামালপুর।