মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা!

প্রকাশিতঃ 10:51 am | July 26, 2021

প্রভাষ আমিন :

দেশে এখন করোনার সুপারি পিক চলছে। ঈদের ছুটিতে করোনা টেস্ট কিছুটা কম হলেও সংক্রমণের হার ৩০ ভাগের ওপরেই রয়েছে। প্রতিদিনের মৃত্যুও দুইশর আশেপাশেই ওঠানামা করছে। ঈদের আগে পরিস্থিতি যা ছিল, তাতে কঠোরতম লকডাউনেই থাকার কথা। জাতীয় পরামর্শক কমিটিও ঈদের আগে কারফিউ জারির পরামর্শ দিয়েছিল। দেশে যখন কারফিউর বাস্তবতা, তখন সরকার লকডাউন আটদিনের জন্য শিথিল করে দেয়। অনেকে এই সিদ্ধান্তের সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন। নিশ্চয়ই এই শিথিলতা করোনা পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটাবে। সপ্তাহ দুয়েক পরে করোনা পরিস্থিতির আরো অবনতি হওয়াটা এখন বাস্তবতা। সংক্রমণ বাড়বে, মৃত্যু বাড়বে; এটা জেনেও সরকার কেন কারফিউ না দিয়ে লকডাউন শিথিল করলো? এটাও আসলে বাস্তবতাই।

অতীতে আমরা দেখেছি, লকডাউন দিয়ে ঈদের সময় মানুষের বাড়ি ফেরা ঠেকানো যায়নি। বরং লকডাউন থাকলে মানুষ যেনতেনভাবে বাড়িতে যাওয়া আসা করতে গিয়ে করোনা পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটিয়ে ফেলে। কিন্তু পশুর হাট, ঈদে বাড়ি যাওয়া-আসা, অর্থনীতির বিবেচনায় আটদিনের শিথিলতা কাটিয়ে দেশ যখন আবার কঠোর লকডাউনে ফিরলো, তখন তো আমাদের সবার উচিত তা মেনে চলা, করোনার বিস্তার রোধে সহায়তা করা। কিন্তু সরকার কঠোর হলেও পুলিশের সাথে সাধারণ মানুষের চোর-পুলিশ খেলার প্রবণতা বন্ধ হয়নি। ঠুনকো অজুহাতে ঘোরাফেরা করার প্রবণতাও বন্ধ হয়নি। যাদের সত্যি জরুরি দরকার, ঘর থেকে না বেরুলে যাদের চুলা জ্বলবে না; তাদের কথা আলাদা। কিন্তু অকারণে ঘর থেকে বেরিয়ে যারা জরিমানা গুণছেন, কারাগারে যাচ্ছেন, হেনস্থার শিকার হচ্ছেন; তাদের জন্য আমার কোনোই সহানুভূতি নেই। ২৩ জুলাই থেকে কঠোর লকডাউন শুরু হবে, এটা অনেক আগেই সবার জানা। এটা জেনেও যারা ২৩ জুলাইয়ের পর ঢাকায় ফিরতে গিয়ে পথে পথে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন, তাদের জন্যও কোনো সমবেদনা নেই।

সরকার মশা মারবে, টিকা আনবে, হাসপাতাল বানাবে। কিন্তু আমাদের নিজেদের সুরক্ষা নিজেকেই নিশ্চিত করতে হবে। করোনাভাইরাস যাতে ঢুকতে না পারে, সেজন্য মুখ-নাক ঢেকে রাখতে হবে। এডিস মশা যেন কামড়াতে না পারে, সে জন্য নিজেকে ঢেকে রাখতে হবে। জান বাঁচানো ফরজ। তাই সরকারের দিকে তাকিয়ে না থেকে নিজেকেই সাবধান থাকতে হবে। সাবধানের মার নেই।

আমরা সহায়তা না করলে সরকারের পক্ষে করোনা মহামারি মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। সরকারের অনেক ব্যর্থতা আছে। তারপরও সরকার নানাভাবে করোনা মোকাবেলার চেষ্টা করছে। হাসপাতালের সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে। নানামুখী চেষ্টায় ২১ কোটি ডোজ টিকার ব্যবস্থা করছে। মাসে এক কোটি লোককে টিকা দেয়ার পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে সরকার। এখন আমাদের উচিত এই লড়াইয়ে সরকারের পাশে থাকা। ব্যক্তিগত সচেতনতা নিশ্চিত করতে না পারলে প্রাণঘাতী করোনা মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না।

দেশজুড়ে যখন করোনার ভয়াবহতা বাড়ছে। তখন সবার অলক্ষ্যে থাবা বিস্তার করছে ডেঙ্গু। করোনা আসার পর থেকে অন্য সব অসুখ-বিসুখের প্রতি আমাদের নজর কমে গেছে। নন-কোভিড রোগীরা অনেক ক্ষেত্রেই যথাযথ চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন না। সিনিয়র ডাক্তারদের অনেকেই এখন নিয়মিত রোগী দেখছেন না। ফলে মানুষকে নানামুখী ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এই সময়ে ডেঙ্গু ধেয়ে আসছে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে। এমনিতে ডেঙ্গুর মৌসুম এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত। তবে ডেঙ্গু সুপার পিকে থাকে জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। করোনার পাশাপাশি এখন দেশে ডেঙ্গুরও সুপার পিক চলছে। জুলাই মাসের প্রথম ২৪ দিনে দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ১২শরও বেশি মানুষ, যেখানে জুনে এই সংখ্যাটা ছিল মাত্র ২৭২। সরকারি হিসাবে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর কথা স্বীকার করা না হলেও এ মৌসুমে অন্তত ৫ জন ডেঙ্গু জ্বরে মারা গেছেন বলে জানা গেছে।

মৌসুম শুরুর আগেই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন মশা মারার নানা চেষ্টা করেছে। তবে সেটা যে যথেষ্ট ছিল না, ডেঙ্গুর প্রকপেই তা প্রমাণিত। সরকার এরই মধ্যে ডেঙ্গুর জন্য আলাদা হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। করোনা আর ডেঙ্গু যেন একাকার হতে না পারে, সে চেষ্টা করছে সরকার। কিন্তু করোনা এবং ডেঙ্গু ডে হারে বাড়ছে, কতদিন তা আলাদা রাখা যাবে, তা ভাবনার বিষয়।

এতদিন জ্বর হলে মানুষ প্রথমেই করোনার কথা ভাবতো। কিন্তু এখন ডেঙ্গুর কথাও ভাবতে হবে। জ্বর হলে দুটি টেস্টই করতে হবে। তারপর ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চিকিৎসা নিতে হবে। প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। তবে করোনা বলেন আর ডেঙ্গু- সুস্থতার মূল চাবিকাঠি কিন্তু আপনারই হাতে। সরকারের, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনেক অব্যবস্থাপনা নিয়ে, দুর্নীতি নিয়ে অনেক কথা বলা যাবে। কিন্তু সেটা বলার জন্যও আগে সুস্থ থাকতে হবে। লকডাউন শিথিল থাকার সুবাদে আমরা সবাই ঈদ উদযাপন করার সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু আসলেই কি সবাই ঈদ করতে পেরেছে?

ঈদের দিনেও হাসপাতালে হাসপাতালে করোনা রোগীদের হাহাকার ছিল। ঈদের দিনে ১৭৪ জন মারা গেছেন। তাই করোনা বা ডেঙ্গু ঈদ বা উৎসব চেনে না। সাবধান না হলে আমরা যে কেউ যখন তখন আক্রান্ত হতে পারি।

করোনার সাবধানতাগুলো এতদিনে আপনাদের সবার মুখস্থ হয়ে গেছে। সবসময় পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে, সবসময় মাস্ক ব্যবহার করতে হবে, কিছুক্ষণ পরপর হাত ধুতে হবে, জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে, কোনো মানুষের তিন ফুটের মধ্যে যাওয়া যাবে না, অকারণে বাসার বাইরে যাওয়া যাবে না, গেলেও বাসায় ফিরে গোসল করতে হবে, বাইরের সব পোশাক ধুয়ে ফেলতে হবে, বাইরে থেকে আনা জিনিস স্যানিটাইজ ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

ডেঙ্গুর সতর্কতাগুলো আপনাদের অজনা নয়। তবুও ভুলে একটু মনে করিয়ে দিচ্ছি। কোনোভাবেই যেম মশা আপনার নাগাল না পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। রাতে অবশ্যই মশারি খাটিয়ে ঘুমাবেন। চোখ-কান খোলা রাখুন, বাসার আশেপাশে যাতে এডিস মশা বংশবিস্তার করতে না পারে। আমরা সবাই জানি, এডিস মশা বংশবিস্তার করে পরিষ্কার পানিতে। তাই বাসার, বারান্দার, ছাদের টবে যেন পানি জমতে না পারে। রাস্তায় যেন আমরা ডাবের খোসা, পরিত্যক্ত টায়ার বা পানি জমার মত কিছু ফেলে নরা রাখি। আর বাসার চারপাশ পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। কোরবানির পশুর বর্জ্যও ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ঘটাতে পারে।

সরকার মশা মারবে, টিকা আনবে, হাসপাতাল বানাবে। কিন্তু আমাদের নিজেদের সুরক্ষা নিজেকেই নিশ্চিত করতে হবে। করোনাভাইরাস যাতে ঢুকতে না পারে, সেজন্য মুখ-নাক ঢেকে রাখতে হবে। এডিস মশা যেন কামড়াতে না পারে, সে জন্য নিজেকে ঢেকে রাখতে হবে। জান বাঁচানো ফরজ। তাই সরকারের দিকে তাকিয়ে না থেকে নিজেকেই সাবধান থাকতে হবে। সাবধানের মার নেই।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএননিউজ