এয়ারলাইন্সগুলোর বকেয়া ৫ হাজার কোটি টাকা, ব্যবস্থা নিচ্ছে বেবিচক
প্রকাশিতঃ 9:56 am | May 29, 2021

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:
দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করা এয়ারলাইন্সগুলোর বকেয়া দিনে দিনে বেড়েই চলছে। ছাড় দিতে দিতে পাওনার এখন পরিমাণ হয়েছে পাহাড়সম! বর্তমানে এয়ারলাইন্সগুলোর কাছে পাঁচ হাজার কোটিরও বেশি টাকা পাবে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এক-দুই কোটি করে বাড়তে বাড়তে এখন ৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এছাড়া করোনা পরিস্থিতিতে ফ্লাইটও নিয়মিত চলছে না। ফলে এয়ারলাইন্সগুলোর আয় কমে গেছে। এ অবস্থায় বেবিচকের নানা চার্জ পরিশোধ করতে না পারায় বকেয়া বাড়ছে।
বিপুল এ পাওনা আদায়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বেবিচক কর্মকর্তারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো সূত্রে জানা গেছে, অ্যারোনটিক্যাল ও নন-অ্যারোনটিক্যাল চার্জ, ভ্যাট, আয়কর ও সারচার্জ মিলে বাংলাদেশে পরিচালিত এয়ারলাইন্সগুলোর কাছে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ হাজার ১৯০ কোটি টাকা পাবে বেবিচক। আর বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর কাছে মে পর্যন্ত পাওনার পরিমাণ ১৭২ কোটি টাকা।
সংস্থাটি বলছে, ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত বেবিচক বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কাছে ৪ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা পাবে। আর বন্ধ হয়ে যাওয়া জিএমজি এয়ারলাইন্সের কাছে পাওনা রয়েছে ৩৬৮ কোটি টাকা।
আর ফ্লাইট চলাচল স্থগিত রাখা বেসরকাটি রিজেন্ট এয়ারওয়েজের দেনা ২৬৩ কোটি টাকা এবং ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের কাছে ২০৩ কোটি টাকা পাওনা হয়েছে।
এছাড়া ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের কাছে ১৬ কোটি ৮২ লাখ টাকা এবং নভোএয়ারের কাছে তিন কোটি ২৭ লাখ টাকা পাবে বেবিচক।
এসব পাওনা আদায়ে বেবিচকের পক্ষ থেকে বারবার তাগাদা দেওয়া হলেও করোনাকালীন সংকটের কথা বলে পাওনা অর্থ পরিশোধ করছে না এয়ারলাইন্সগুলো।
জানা গেছে, বর্তমানে করোনার মধ্যেও নিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স দেশের অভ্যন্তরীণ সব রুটে এবং আন্তর্জাতিক রুটের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশ ও যুক্তরা
এর আগে ২০০৮ সালেও প্রায় ১৮০০ কোটি টাকার দেনায় পড়েছিল বিমান। ওই সময় অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে ১২১৬ কোটি টাকার সারচার্জ মওকুফ করিয়ে ৫৭৩ কোটি টাকা পরিশোধ করে দায়মুক্তি পায় সংস্থাটি।
এ বিষয়ে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আবু সালেহ মোস্তফা কামাল বলেন, বেবিচকের চেয়ারম্যান (এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান) বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পরিচালনাপর্ষদের সদস্য। উনি বিমানের আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে অবগত। আমরা আশা করব বেবিচকের পক্ষ থেকে তিনি চার্জ কমাবেন। এছাড়া বিমানের পক্ষ থেকেও কীভাবে বকেয়া পরিশোধ করা যায় আমরা সেই পরিকল্পনা করছি।
এদিকে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের উড়োজাহাজ। সর্বশেষ ২০১৬ সালে ফ্লাইট পরিচালনা বন্ধ করে দেয় সংস্থাটি। ২০০৭ সালে ফ্লাইট অপারেশন শুরু করে ইউনাইটেড এয়ার।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইউনাইটেড এয়ারের তৎকালীন কয়েকজন কর্মকর্তা কালের আলোকে জানান, আগাম ঘোষণা ছাড়াই আকস্মিক ফ্লাইটের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে ওই সময় বলা হয়েছিল যে, বহরে থাকা ১০টি উড়োজাহাজের সবকটির রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন।
কিন্তু দুই সপ্তাহ পর ফ্লাইট পরিচালনায় ফেরার কথা বললেও পাঁচ বছর পরও অপারেশনে ফিরতে পারেনি সংস্থাটি।
এদিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ কোম্পানিটির পর্ষদ ভেঙে সম্প্রতি নতুন সাতজন স্বতন্ত্র পরিচালক বসিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন- বিএসইসি।
এই সাতজনের মধ্যে এভিয়েশন ও ভ্রমণ বিষয়ক সাময়িকী ‘বাংলাদেশ মনিটর’ সম্পাদক কাজী ওয়াহিদুল আলমকে পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান করা হয়েছে।
যোগাযোগ করা হলে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের চেয়ারম্যান কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, শুধু বেবিচক নয়, আমাদের (ইউনাইটেড) আরও অনেক দায়দেনা আছে। সবমিলে আমরা একটা ওয়ার্কিং প্ল্যান তৈরি করছি। আমরা কীভাবে দায়দেনাগুলো পরিশোধ করব, সেটা ঠিক করছি।
বেবিচকের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজে বের করা হবে বলে জানান কাজী ওয়াহিদুল আলম।
এদিকে ২০২০ সালের মার্চে করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময় সবধরনের ফ্লাইট স্থগিত করে দেয় রিজেন্ট এয়ারওয়েজ। সংস্থাটির কাছে ২৮৩ কোটি টাকা পায় বেবিচক।
টাকা পরিশোধের উদ্যোগের বিষয়ে রিজেন্টের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) আশিস রায় চৌধুরী বলেন, দেনার বিষয়ে আমরা বেবিচকের সঙ্গে একটা সমঝোতায় যাবো। বেবিচক আমাদের বলেছে, অপারেশনে ফিরতে হলে মোটা অঙ্কের একটা বিল দিতে হবে। সেটা নিয়ে আলোচনা হবে। আমরা একটা সাবস্টেনশিয়াল (সঙ্গতিসম্পন্ন) অঙ্কের বিল পরিশোধের লক্ষ্যে কাজ করছি।
সূত্র জানায়, ২০০৪ সালে আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করে বেসরকারি জিএমজি এয়ারলাইন্স। ২০১২ সালে ফ্লাইট বন্ধের ঘোষণা দেয় প্রতিষ্ঠানটি।
ফ্লাইট বন্ধের কারণ হিসেবে তারা ‘জেট ফুয়েলের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং নতুন ব্যবসায়িক পরিকল্পনা নেওয়ার উদ্যোগ’-এর কথা জানায়।
তবে সংস্থাটি ২০১৩ সালের মধ্যে ফিরে আসার ঘোষণা দিলেও আর ফ্লাইট পরিচালনা করা হয়নি। ফ্লাইট বন্ধের সময় জিএমজির কাছে বেবিচকের পাওনা ছিল প্রায় ২০০ কোটি টাকা। সময়মতো পরিশোধ না করায় তা চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে।
এছাড়া শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জিএমজির একটি উড়োজাহাজ এখনো পড়ে আছে। সেটির চার্জসহ বর্তমানে দেনার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৬৮ কোটি টাকায়।
পাওনা পরিশোধে বারবার চিঠি দেওয়ার পরও জিএমজি এবং তার শেয়ার কিনে নেওয়া বেক্সিমকো গ্রুপের কেউই বকেয়া অর্থ পরিশোধে কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন বেবিচকের একাধিক কর্মকর্তা।
এদিকে বকেয়া পরিশোধের বিষয়ে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) মো. কামরুল ইসলাম বলেন, যাত্রা শুরুর পর থেকে বেবিচকের সবধরনের বিল পরিশোধ করে আসছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স। ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আমাদের প্রায় সব বিল পরিশোধ করা হয়েছে। অবশিষ্ট বকেয়া সময়মতো পরিশোধ করা হবে।
বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর কাছে পাওনা ১৭২ কোটি টাকা
জানা গেছে, করোনার দোহাই দিয়ে ১৭২ কোটি টাকার পাওনা পরিশোধ করছে না বাংলাদেশে ফ্লাইট পরিচালনা করা ২৪টি বিদেশি এয়ারলাইন্স।
বিল আদায়ে বারবার তাগাদা দিলেও সে অনুযায়ী সাড়া পাচ্ছে না বেবিচক। এক্ষেত্রে ভবিষ্যতে যাতে কোনো বিদেশি সংস্থা বকেয়া রাখতে না পারে সেজন্য কার্যক্রম শুরুর আগে সিকিউরিটি মানি চাওয়ার চিন্তা ভাবনা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন একাধিক কর্মকর্তা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেবিচকের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, পাওনাগুলো আদায়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
জানা গেছে, বেবিচকের কাছে ইরান এয়ার, ইরাকি এয়ারওয়েজ, গারুদা ইন্দোনেশিয়া, কোরিয়ান এয়ার ও পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স নতুন করে ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি চেয়েছে।
বিপুল পরিমাণ এ অর্থ আদায়ের বিষয়ে বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান বলেন, আমাদের আগে বছরে ১৬শ থেকে ১৭শ কোটি টাকা আয় হতো। অভ্যন্তরীণ ও ব্যবস্থাপনা ব্যয় শেষে অতিরিক্ত আয়ের অর্থ বেবিচকের চলমান উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালিত হয়। তবে ২০২০ সালে রাজস্ব আয় কমে হাজার কোটি টাকায় নেমে এসেছে। অনেক এয়ারলাইন্সের কাছে পাওনাও রয়েছে।
বকেয়ার এই টাকা আদায়ের বিষয়ে তিনি বলেন, বিপুল পরিমাণ পাওনা আদায়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
এসব অর্থ পুনরুদ্ধার হলে বেবিচকের উন্নয়ন কাজগুলো আরও ত্বরান্বিত হবে বলে জানান বেবিচক চেয়ারম্যান।
কালের আলো/ডিএসকে/এমএনএল