ফারহানারাই এগিয়ে যাবে, এগিয়ে নেবে

প্রকাশিতঃ 7:31 am | September 02, 2020

প্রভাষ আমিন:

শখের তোলা নাকি লাখ টাকা। আসলে নাকি নয়, সত্যি সত্যি শখের কোনো মূল্য হয় না। শখ মেটাতে মানুষ সম্ভব-অসম্ভব কত কিছু করে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। বিয়ে নিয়েও মানুষের হরেকরকম স্বপ্ন থাকে। কেউ পানির নিচে বিয়ে করে, কেউ করে আকাশে। বাংলাদেশে কেউ ঘোড়ায়, কেউ হাতিতে চড়ে বিয়ে করতে যায়। কয়েকবছর আগে কুমিল্লার বরুড়ার এক গ্রামের ছেলে হেলিকপ্টারে বিয়ে করতে গিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল। সেই ছেলে আবার ছাত্রলীগ করতো। তাই দেশজুড়ে নিন্দা আর প্রতিবাদের ঝড়। সেই ছেলে নাকি ছাত্রলীগের ক্ষমতায় কোটি কোটি টাকা কামিয়েছে, তাই টাকার গরম দেখাতে হেলিকপ্টারে বিয়ে করতে গেছে। এই চিরবিদ্রোহী জাতিকে কে বোঝাবে, হেলিকপ্টারে বিয়ে করতে যেতে ছাত্রলীগ করতে হয় না, কোটিপতি হতে হয় না। এটা লাখ টাকার মামলা, গ্রামে অনেক পরিবার তার ছেলের বিয়েতে কয়েক লাখ টাকা খরচ করে। এটা আসলে শখের ব্যাপার, ভাবতে পারার ব্যাপার।

তেমনি আরেক শখ নিয়ে এখন তোলপাড় চলছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমে। গত মাসে যশোরে একজন মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে নিজের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। এটুকু পড়ে আপনি অবাক হতে পারেন, মোটরবাইকের বহর নিয়ে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে যোগ দেয়া নিয়ে তোলপাড়ের কী আছে? এই প্রশ্ন আমারও। কিন্তু উত্তরটা হলো, মোটরসাইকল চালিয়ে এবং বহর নিয়ে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে এন্ট্রি নেয়া ব্যক্তিটি ছেলে নয়, মেয়ে। এখানেই যত বিপত্তি। একটা মেয়ে মোটরসাইকেল চালিয়ে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে যেন মহাভারত অশুদ্ধ করে ফেলেছেন।

কিছু ‘অতি মুসলমান’ এর তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হচ্ছে, একজন মেয়ের মোটরসাইকেল চালিয়ে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে যোগ দেয়া না দেয়ার সাথে বাংলাদেশে ইসলামের থাকা না থাকা নির্ভরশীল। এই মেয়েটি যেন ইসলামকে ডুবিয়ে দিয়েছে। তবে ফারহানা আফরোজ নামে এই সৌখিন মেয়েটি একই সঙ্গে ‘অতি মুসলমান’ এবং ‘অতি পুরুষ’দের আঁতে ঘা দিয়েছেন। সবার ধারণা শখ-টখ শুধু ছেলেদের ব্যাপার, মেয়েদের এত শখ থাকবে কেন?

বাংলাদেশে বিয়েতে ছেলেরা সবসময় অ্যাকটিভ, মেয়েরা প্যাসিভ। ছেলেরা বিয়ে করতে যায়, মেয়েরা বিয়ে বসে। বিয়েতে মেয়েরা কাঁদে। বিয়েটা পারস্পরিক নয়। মেয়ের ভরণপোষণের দায়িত্ব ছেলের। এমন একতরফা ভাবনায় আঘাত করে, একটা মেয়ে যখন মোটরসাইকেল চালিয়ে, বন্ধুদের বহর নিয়ে সিনেমা স্টাইলে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে এন্ট্রি দেয়; তখন আমরা চমকে যাই, আমাদের আজন্মলালিত ভাবনা-চিন্তায় জট লেগে যায়, আমরা নড়েচড়ে বসি। আমরা ভয় পাই, এই বুঝি পুরুষদের রাজত্ব ধসে পড়লো, এই বুঝি ধর্মের ভয় আর কাজ করছে না।

ফারহানা আফরোজের মোটরসাইকেলের বহরের ভিডিও আমি দেখেছি। দেখে ভালো লেগেছে। নতুন হলেও আমার কাছে অস্বাভাবিক লাগেনি। তাই কিছু লেখার কথাও ভাবিনি। কিন্তু ধর্ম আর সমাজের মোড়লরা যেভাবে ফারহানার পেছনে উঠেপড়ে লেগেছেন, তাতে তার পাশে দাঁড়ানো নৈতিক দায়িত্ব। আমাদের সমস্যা হলো, আমাদের দেখার দৃষ্টিতে বৈষম্য আছে। আমরা ছেলেদের জন্য একটা উদার দৃষ্টি আর মেয়েদের জন্য একটা সংকীর্ণ দৃষ্টি লালন করি। ছেলেদের কাজ, মেয়েদের কাজ বলে ভাগ করে ফেলি। মানছি, আমাদের দেশে-সমাজে নারীরা একটু কম নিরাপদ। সেটা তো আমাদের সমস্যা, নারীদের নয়। কিন্তু মোটরসাইকেল চালানো তো নারী-পুরুষের কাজ হিসেবে আলাদা করা নেই। কোনো ধর্মগ্রন্থ, সমাজগ্রন্থ বা আইনগ্রন্থে কী লেখা আছে, ‘মেয়েরা মোটরসাইকেল চালিয়ে নিজের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে এন্ট্রি মারিতে পারিবে না।’

ফারহানা জানিয়েছে, ঢাকার একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে তিনি বরকে মোটরসাইকেল চালিয়ে প্রবেশ করতে দেখেছেন। বিষয়টা তার ভালো লেগেছে। তাই একজন লেডি বাইকার হিসেবে নিজের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান অন্যরকম করে সাজিয়েছেন। এতে সমস্যা কোথায়? একটা ছেলে যদি পারে, মেয়ে পারবে না কেন? কদিন আগে কক্সবাজারে ক্রসফায়ারে মেজর (অব.) সিনহাকে হত্যার পর তার টিমের সদস্য শিপ্রার ক্ষেত্রেও দৃষ্টিভঙ্গিগত বৈষম্যের উদগ্র প্রকাশ দেখিয়েছি। আমাদের সমালোচনার লাইন ছিল, একটা মেয়ে হয়ে শিপ্রা কেন মদ খাচ্ছে, সিগারেট খাচ্ছে। যেন মেয়েদের মদ-সিগারেট খাওয়া বারণ; ছেলে হলে সমস্যা নেই। আপনি যদি মনে করেন, মদ-সিগারেট খারাপ; তবে সেটা ছেলেমেয়ে সবার জন্যই খারাপ হওয়া উচিত। মোটর সাইকেল নিয়ে গায়ে হলুদে যাওয়াকে যদি আপনার খারাপ মনে হয়, তবে সেটা ছেলেমেয়ে সবার জন্যই খারাপ। ‘একটা মেয়ে হয়ে এটা করতে পারলো’ মাথা থেকে এই ধারণাটা খুলে ফেলুন। দেখার চোখ সমান করুন।

কাঠমোল্লারা ফারহানার চরিত্র, বংশ নিয়ে অশ্লীল গবেষণায় মেতেছেন। খালি একটা প্রশ্ন, ১৪০০ বছর আগে মুসলমান নারীরা যদি যুদ্ধে যেতে পারে, এখন নারীরা শখের বশে মোটরসাইকেল নিয়ে হলুদের অনুষ্ঠানে যেতে পারবে না কেন? তারচেয়ে বড় কথা হলো, ফারহানার স্বামী, শ্বশুর বা মা কারোই তার এই মোটরসাইকেল অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে আপত্তি নেই। বরং তার শশুর তাকে একটি মোটরসাইকেল কিনে দেবেন বলেছেন। তাহলে আপনাদের সমস্যা কোথায়?

ফারহানাকে মোটরসাইকেল চালাতে দেখে আপনার চোখ টাটাচ্ছে, কিন্তু কত নারী পেটের দায়ে রিকশা চালাচ্ছে, টমটম চালাচ্ছে, নসিমন চালাচ্ছের, ঢাকায় পাঠাওয়ের মোটরসাইকেল চালাচ্ছে, গাড়ি চালাচ্ছে; আপনি জানেন, আপনি দেখেছেন? নারীরা নিজের যোগ্যতায় ট্রেন চালাচ্ছে, বিমান চালাচ্ছে, বিমান থেকে লাফ দিচ্ছে, দেশ চালাচ্ছে; আপনার অশ্লীল চিৎকার কিন্তু আপনার অযোগ্যতাকেই আরও বেশি করে তুলে ধরছে। ঠুনকো সমাজ আর ধর্মের দোহাই দিয়ে নারী-পুরুষ কাউকেই আপনারা আর আটকে রাখতে পারবেন না। ফারহানারা এগিয়ে যাবে এই অচলায়তন ভেঙে। আমি বলছি না কাল থেকে সব নারী সিগারেট খাবে, মদ খাবে, মোটরসাইকেল নিয়ে গায়ে হলুদে যাবে। আমার পয়েন্ট ক্লিয়ার- যার যেটা ভালো লাগবে, প্রচলিত আইন মেনে, অন্যের ক্ষতি না করে; তার সেটা করার পূর্ণ অধিকার আছে। তিনি ছেলে না মেয়ে সেটা বিবেচ্য নয়।

ফারহানার কথাবার্তা শুনে মনে হয়নি তিনি তাত্ত্বিক নারীবাদী। তিনি শুধু স্বাধীনভাবে মনের আনন্দে নিজের কাজটা করতে চেয়েছেন। তিনি টেরও পাননি, নিজের অজান্তে তিনি বাংলাদেশের নারীদের তিনি কতটা এগিয়ে দিয়েছেন, তাদের সামনে থেকে কত বড় বাধা সরিয়ে দিয়েছেন। ইদানীং কিছু আল্ট্রা নারীবাদী দেখি, যাদের কাছে নারীবাদ মানে হলো পুরুষবিদ্বেষ, তারা পুরুষশূন্য সমাজে বাস করে নারীবাদ কায়েম করতে চান। তারা জগতের সবকিছুর ওপর বিরক্ত, পায়ে পা বাঁধিয়ে ঝগড়া করতে একপায়ে খাড়া থাকেন। হাতে মদ আর সিগারেট নিয়ে স্বল্প পোশাকের ছবি ফেসবুকে দেয়াকে তারা স্বাধীনতা মনে করেন, নারীবাদ মনে করেন। কিন্তু আমার কেন জানি মনে হয়, এই উগ্র ড্রইংরুম নারীবাদীরা মাঠে কাজ করা নারীদের প্রতিদিনের লড়াইটাকে আরও কঠিন করে দিচ্ছেন। আমার বিবেচনায় মাঠে-ঘাটে রিকশা চালানো, ইটভাঙা নারীরাই সত্যিকারের নারীবাদী; সৌখিন হলেও ফারহানারাই আসল নারীবাদী।

আমি নারীবাদী নই, আমি মানবতাবাদী। আমি কখনোই নারীদের বা কারো সমান অধিকারে বিশ্বাসী নই। আমাদের সমাজের পদে পদে বৈষম্য। সমান অধিকার দিয়ে বৈষম্য দূর হবে না। বৈষম্য দূর করতে চাই, ন্যায্য অধিকার। বছরের পর বছর নির্যাতন করে, ঠকিয়ে, কম দিয়ে নারীদের পিছিয়ে রাখা হয়েছে। তাই এখন সমান অধিকার দিলেও নারীরা পেছনেই থাকবে। আগে ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করে তাদের এগিয়ে আনতে, বৈষম্য দূর করতে হবে। তারপর সমান অধিকারের প্রশ্ন। আর নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্কটা হতে হবে, আস্থা-বিশ্বাস-ভালোবাসার; কোনোভাবেই বিদ্বেষের নয়।

ফিরে যাই ফারহানার মোটরসাইকেল বহর নিয়ে কনের হলুদযাত্রায়। সেখানে দুইটা পয়েন্ট- কারো মাথায় হেলমেট এবং মুখে মাস্ক নেই। তবে এ ব্যাপারে ফারহানার বক্তব্যকেই সমর্থন করে বেনিফিট অব ডাউটটা আমি তাকেই দিতে চাই। পুরো ব্যাপারটা ভিডিও করা হয়েছে। হেলমেট বা মাস্ক পরলে কাউকেই চেনা যেত না। আর বধূ বেশের ফারহানা হেলমেট পরলে তার সাজ নষ্ট হয়ে যেত। আর পুরো ব্যাপারটি অতি অল্পসময়ের। নিজের অজান্তে ফারহানা যত বড় বিপ্লব করেছে, এইটুকু বিচ্যুতি সেখানে মার্জনীয়।

ফারহানারাই এগিয়ে যাবে, সমাজকে এগিয়ে নেবে। যারা বসে বসে ফারহানাদের টেনে ধরতে চাইবে, তারা পেছনেই থাকবে।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএননিউজ