এফটিএ আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের সাড়ায় রপ্তানি প্রবাহে বাড়বে গতি
প্রকাশিতঃ 10:03 pm | May 19, 2025

কালের আলো রিপোর্ট:
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য রপ্তানি পণ্যের জন্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার নিশ্চিতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। দু’দেশের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) সংক্রান্ত আলোচনার শুরুর বাংলাদেশের প্রস্তাবে দেশটি সাড়া দেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রবাহে নতুন গতি সঞ্চার হতে পারে বলে মনে করছেন অংশীজনরা। ইতোমধ্যে উচ্চপর্যায়ে অংশীজনদের সঙ্গে একাধিক বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে। পতিত সরকারের সময়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এফটিএ স্বাক্ষরের জন্য আহ্বান জানানো হলেও ওয়াশিংটন আগ্রহ দেখায়নি। তবে এবার ড.মুহাম্মদ ইউনূস’র নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এফটিএ স্বাক্ষরের বিষয়ে একমত হয়েছে দেশটি। এর মাধ্যমে দেশের রপ্তানি খাতে একটি মাইলফলক অর্জিত হবে বলে মনে করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
জানা যায়, যুক্তরাষ্টের আরোপিত ৩৭ শতাংশ শুল্ক প্রত্যাহার বিষয়ে গত মাসে বাংলাদেশের একটি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন প্রতিনিধি দল যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে। সেখানে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বাড়াতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এফটিএ স্বাক্ষরের জন্য প্রস্তাব করা হয়। উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন এই প্রতিনিধি দলে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমানও ছিলেন। বাংলাদেশের প্রস্তাবে রাজি হয়ে তাদের কাছে চুক্তির খসড়া চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির দপ্তর। সেই মোতাবেক কাজও শুরু করেছে বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (এফটিএ) আয়েশা আক্তারকে প্রধান করে গঠন করা হয়েছে ৮ সদস্যের একটি কমিটি। গত ১২ মে গঠন করা কমিটিকে ১৫ দিনের মধ্যে খসড়া প্রণয়ন করে বাণিজ্য সচিবের কাছে দাখিলের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমানের সভাপতিত্বে গত মঙ্গলবার (১৩ মে) একটি স্টেকহোল্ডার সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রস্তাবিত পাল্টা শুল্ক এড়াতে যুক্তরাষ্ট্রের ১০০টি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার সম্ভাব্যতা নিয়ে আলোচনা হয়। পাশাপাশি, এফটিএ স্বাক্ষরের কৌশল ও প্রক্রিয়া নিয়েও আলোচনা হয়।
বৈঠকে উপস্থিত প্রতিনিধিরা বলেছেন, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নিয়মানুযায়ী বাংলাদেশ মোস্ট ফেভার্ড নেশন (এমএফএন) ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের ১০০টি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিলে এ সংস্থার সদস্য অন্যান্য দেশও এসব পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে। তখন অন্যান্য দেশের পণ্যগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য প্রতিযোগিতায় সক্ষম না হলে- দেশটি থেকে বাংলাদেশের বেসরকারিখাতের আমদানি বাড়বে না। যার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের এফটিএ আলোচনা শুরুর একটি প্রস্তাব ওঠে। এই প্রস্তাব অনুযায়ী, এফটিএ স্বাক্ষর করে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যকে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার বিপরীতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য রপ্তানি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা আদায়ের প্রস্তাব করা হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা শুরুর প্রস্তুতির বিষয়টি নিশ্চিত করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘এটি নি:সন্দেহে বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় এক খবর। তাঁরা আমাদের কাছে চুক্তির একটি খসড়া চেয়েছে। প্রস্তাবিত এফটিএ’র খসড়া তৈরির জন্য আমরা ডেডেকেটেড একটি কমিটিও গঠন করেছি।’
তৈরি পোশাক খাতের (আরএমজি) ব্যবসায়ী নেতারা জানান, তৈরি পোশাক খাতে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনাম ও ভারত ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) প্রস্তাব করেছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে মাত্র ৭ শতাংশ শুল্কের সুবিধা পাচ্ছে ভিয়েতনাম। বিপরীতে বাংলাদেশকে ১৫ শতাংশেরও বেশি শুল্ক দিতে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এফটিএ স্বাক্ষরিত হলে তাদের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) এর সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজও। তিনি বলেন, ‘বাড়তি চাহিদা পূরণে টেক্সটাইল ও সুতা উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ বাড়বে। পোশাক শিল্পের সম্প্রসারণের ফলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে লাখো নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।’
যদিও এর মধ্যে কিছু চ্যালেঞ্জও দেখছেন তৈরি পোশাক খাতের (আরএমজি) ব্যবসায়ী নেতারা। তাঁরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক শ্রম মান মেনে চলার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখে। ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার, কর্মপরিবেশ ও ন্যূনতম মজুরির প্রশ্নে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া পরিবেশবান্ধব উৎপাদন পদ্ধতি ও গ্রিন ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠার প্রবণতা বাড়াতে হবে।’
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বর্তমান শুল্ক কাঠামোয় বড় বৈষম্য রয়েছে, এতে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর গড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে আমদানি করা পণ্যে গড় শুল্ক হার মাত্র ৬.১ শতাংশ। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে সবচেয়ে বেশি আমদানি করে কাঁচা তুলা ও স্ক্র্যাপ লোহা। এই দুটি পণ্যে শুল্ক হার যথাক্রমে ০ শতাংশ ও ১ শতাংশ। ২০১৩ সালের আগে পর্যন্ত স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়েছে, যার মধ্যে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকখাত অন্তর্ভুক্ত ছিল না। প্রায় ১৫.৫০ শতাংশ শুল্ক দিয়ে বাংলাদেশি তৈরি পোশাক রপ্তানি হচ্ছে দেশটিতে।
এই পরিস্থিতি আরও জটিল রূপ নেয় যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর। ট্রাম্পের প্রশাসন বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করেছে। ঢাকার অনুরোধের প্রেক্ষিতে যা বর্তমানে তিন মাসের জন্য স্থগিত রেখেছে।
গত অর্থবছর বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৭.৬০ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) দেশটিতে রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭.১৯ বিলিয়ন ডলার, যা এই সময়ে বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ১৭.৮৭ শতাংশ। যার বিপরীতে, গত অর্থবছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ ২৮ হাজার ১৪৪ কোটি টাকা মূল্যের পণ্য আমদানি করেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে এর পরিমাণ ২২ হাজার ১৬৮ কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু হওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক অগ্রগতি। এই ধরনের আলোচনা দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক আরও গভীর করতে পারে এবং উভয় দেশের ব্যবসায়িক ও বিনিয়োগ পরিবেশে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) এর সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ তুলা, স্ক্র্যাপ, সয়াবিন ও কৃষিপণ্য আমদানি করে, যার বেশিরভাগ হয় শুল্কমুক্ত, নাহয় সামান্য শুল্কে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। তাই দেশটির সঙ্গে এফটিএ স্বাক্ষর হলে, বাংলাদেশের রাজস্ব আহরণে খুব বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।’
যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) নিয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হওয়া দেশের কৃষি খাতের জন্য এক নতুন দিগন্তের সূচনা হতে পারে। কৃষিপণ্য রফতানির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র একটি সম্ভাবনাময়, কিন্তু বর্তমানে সীমিতভাবে ব্যবহৃত বাজার। শুল্ক ও অশুল্ক বাধা কমে গেলে বাংলাদেশের কৃষিপণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে আরও প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠতে পারে। বাংলাদেশের উৎপাদিত আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, লিচু, ড্রাগন ফল, আলু, চা, মসলা, ফুল, শুঁটকি, মাছ ইত্যাদি যুক্তরাষ্ট্রের বড় বাংলাদেশি ও দক্ষিণ এশীয় ডায়াসপোরার মধ্যে জনপ্রিয়। এফটিএ কার্যকর হলে এসব পণ্যে শুল্ক হ্রাস বা বিলুপ্ত হবে, ফলে রফতানি বহুগুণে বাড়বে।
ফ্রোজেন ফুড, প্যাকেটজাত মসলা, হালাল মাংস, শুকনা ফলমূল, রেডি-টু-ইট খাবার ইত্যাদি প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। এফটিএ সুবিধা পেলে এসব পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি ঝুড়িতে যুক্ত হতে পারে। এফটিএ এর আওতায় কৃষি যন্ত্রপাতি, হাইব্রিড বীজ, স্মার্ট ইরিগেশন এবং কৃষিভিত্তিক আইওটি প্রযুক্তি সহজ শর্তে আমদানি করা সম্ভব হবে। এতে উৎপাদনশীলতা বাড়বে ও কৃষক উপকৃত হবেন।
কালের আলো/আরআই/এমএসএকে