জোড়াতালিতে চলছে ট্রেনের ইঞ্জিন

প্রকাশিতঃ 10:39 am | March 22, 2025

কালের আলো রিপোর্ট:

মানুষভর্তি ট্রেনকে টেনে নিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে ও নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছাতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন)। কিন্তু সেই ইঞ্জিনই যদি চলে জোড়াতালিতে, তাহলে নির্দিষ্ট সময়ে ও নিরাপদে ট্রেনের গন্তব্যে পৌঁছানো অসম্ভব এক ব্যাপার। কিন্তু এমনটিই ঘটছে প্রতিনিয়ত। মাঝপথে অহরহ বিকল হচ্ছে ট্রেনের লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন)। এ নিয়ে চালকদের চোখে-মুখেও দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ২৬ বার আর ফেব্রুয়ারি মাসে ৩০ বার ইঞ্জিন বিকলের ঘটনা ঘটেছে। আর গত বছরের ডিসেম্বর মাসে বিকল হয়েছিল ৩১ বার। এতে গন্তব্যে পৌঁছাতে সর্বনিম্ন সোয়া ঘণ্টা থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে আট ঘণ্টা পর্যন্ত বাড়তি সময় লেগেছে যাত্রীদের।

রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, চাহিদা অনুযায়ী ট্রেন চালাতে যে পরিমাণ ইঞ্জিনের প্রয়োজন সেটি তাদের নেই। জোড়াতালি দিয়ে ট্রেন সচল রাখতে হচ্ছে। ইঞ্জিনগুলো বিরতিহীনভাবে ব্যবহার করতে হচ্ছে। তাই বিকল হওয়ার ঘটনা ঘটছে। তবে ঈদের সময় যাতে মাঝপথে ইঞ্জিন বিকল না হয়, সে জন্য তাঁরা তৎপরতা শুরু করেছেন। ইঞ্জিন-সংকটের কারণে ঈদের সময় এবার পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলে বিশেষ ট্রেনের সংখ্যা ১০ জোড়া থেকে কমিয়ে ৫ জোড়া করা হয়েছে।

এমনই একটি বিড়ম্বনার ঘটনা ঘটে জামালপুর-চট্টগ্রাম রুটে চলাচল করা আন্তঃনগর বিজয় এক্সপ্রেস (৭৮৬)। ২০২৪ সালের ২৪ মে জামালপুর থেকে চট্টগ্রাম যেতে ট্রেনটিতে চারটি ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়েছিল। রেল সূত্র বলছে, জামালপুর থেকে ট্রেনটিকে টেনে আনছিল রেলওয়ের ২৯১৯ নম্বর ইঞ্জিন। ময়মনসিংহের গৌরীপুর স্টেশন এলাকার কাছে এসে ইঞ্জিনটি বিকল হয়ে যায়। পরে ময়মনসিংহ থেকে ২৬১৪ নম্বর ইঞ্জিন এনে রওনা করে ট্রেনটি। ওই ইঞ্জিন বিজয় এক্সপ্রেসকে নিয়ে ভৈরব সেতুতে উঠতে না পারায় আখাউড়া থেকে ২৯২৩ নম্বর ইঞ্জিন এনে ট্রেনটিকে টেনে নেওয়া হয়। কিন্তু এই ইঞ্জিনও চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বারৈয়ারঢালা এলাকায় গিয়ে বিকল হয়। পরে চট্টগ্রাম থেকে ২৯৩৭ নম্বর ইঞ্জিন এনে চট্টগ্রাম স্টেশনে নেওয়া হয় ট্রেনটিকে।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুরোনো ইঞ্জিনগুলোর বেশিরভাগই সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে গেছে। যাত্রী সেবা দেওয়া যদি রেলওয়ের চিন্তা থাকত, তাহলে ইঞ্জিন সংকট মোকাবিলার প্রস্তুতি অবশ্যই আগে থেকেই নিত সেবা সংস্থাটি। অন্যদিকে, রেল কর্তৃপক্ষ বলছে, নতুন ইঞ্জিন আনার পর পুরোনো ইঞ্জিনগুলো ধীরে ধীরে বাদ দেওয়া হবে।

বর্তমানে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে ২৯ জোড়া আন্তনগর, ৩০ জোড়া কমিউটার ও মেইল ট্রেন, ১৯ জোড়া লোকাল, ৪ জোড়া পণ্যবাহী ট্রেন, অর্থাৎ ১৬৪টি ট্রেন পরিচালনা করে। ঈদের সময় ট্রেনের সংখ্যা আরও বাড়বে। কেননা ঈদযাত্রায় যাত্রীবাহী ট্রেনের সাপ্তাহিক ছুটি বাতিল করা হয়েছে। নিয়মিত ট্রেনের বাইরে বিশেষ ট্রেন চালানো হবে। তখন চাপ আরও বেড়ে যাবে।

জানা যায়, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে রেল খাতে লাখকোটি টাকা ব্যয় হয়। বিশেষ করে রেলপথ নির্মাণ ও দৃষ্টিনন্দন স্টেশন নির্মাণে বিপুল অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। তবে ইঞ্জিন ও কোচের সংকটে নিরসনে মনোযোগ ছিল কম। শেষ ১২ বছরে মাত্র ৩৯টি ইঞ্জিন কেনা হয়েছিল। যার মধ্যে সর্বশেষ ২০২১ সালে কেনা হয় ২৯টি ইঞ্জিন। যেগুলোর মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

রেলওয়ের যান্ত্রিক প্রকৌশল বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে প্রতিদিন ১১৩ থেকে ১১৬টি ইঞ্জিন প্রয়োজন। কাগজে-কলমে ১৪০টি ইঞ্জিন থাকলেও পাওয়া যায় ৮০ থেকে ৮২টি। একটি ইঞ্জিন গন্তব্যে পৌঁছার পর কিছু সময়ের জন্য বিশ্রামে রাখতে হয়। কিন্তু তা সম্ভব হয় না। ফলে মাঝপথে ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আফজাল হোসেন বলেন, ‘ব্রডগেজ ইঞ্জিনে তেমন কোনো সমস্যা নেই। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছি মিটারগেজ ইঞ্জিন নিয়ে। মিটারগেজ ইঞ্জিনের স্বল্পতা রয়েছে। এখন যত ইঞ্জিন আছে, তার বেশিরভাগই পুরাতন। মিটারগেজ ইঞ্জিনগুলোর ফেইল করার সংখ্যা এখন বেশি। নতুন ৩০০০ সিরিজ ইঞ্জিনেও কিছু সমস্যা আছে।’

তিনি বলেন, ‘মিটারগেজ ইঞ্জিন যেগুলো আছে, সেগুলো মেরামতের জন্য আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। এ বছর ২৪টি মিটারগেজ ইঞ্জিন মেরামত করে লাইনে ফেরাব। প্রতি মাসে দুটি করে মিটারগেজ ইঞ্জিন লাইনে ফেরানো আমাদের টার্গেট। নতুন কিছু ইঞ্জিন কেনার জন্য একটি ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) তৈরি করা হয়েছে। খুব দ্রুতই এটির দরপত্র আহ্বান করা হবে।’

কালের আলো/এমএসএএকে/আরআই