অক্টোবরে ভয়ঙ্কর ডেঙ্গু

প্রকাশিতঃ 8:22 am | October 06, 2025

কালের আলো রিপোর্ট:

মশা ও মানুষ, কেউ কিন্তু কারও শত্রু নয়। তবুও প্রতি বছর মশার কামড়ে মারা যাচ্ছে অগণিত মানুষ। মৃত্যু অনিবার্য, তবে সেটা একটা বয়স বা সময়ের পরে হওয়াটাই কাম্য। কিন্তু শুধু অসচেতনতা, প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেওয়াসহ জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত নানা অবহেলার কারণে প্রতি বছর শুধু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে বহু মানুষ মারা যাচ্ছে। বর্তমানে ডেঙ্গু দেশের অন্যতম জনস্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু তা নিয়ে বিস্তর আলাপ হলেও এই সংকট নিরসনে তেমন কার্যকর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।

সময় যত যাচ্ছে ডেঙ্গু কমার বদলে বাড়ছে। আক্রান্ত যেমন বাড়ছে তেমনি বাড়ছে মৃত্যুও। বিশেষ করে চলতি অক্টোবরে ডেঙ্গু যেন হয়ে উঠেছে আরও ভয়ঙ্কর। সারাদেশে গত ২৪ ঘণ্টায় এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ৯ জন মারা গেছেন। এই সময়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১০৪২ জন। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ২১২ জনে এবং শনাক্ত রোগী বেড়ে ৪৯ হাজার ৯০৭ জনে দাঁড়িয়েছে। রোববার (৫ অক্টোবর) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোলরুম থেকে পাঠানো ডেঙ্গুবিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এমন তথ্য জানানো হয়। মৃত ৯ জনের মধ্যে ৭ জনই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের। বাকি দুজনের একজন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ও অন্যজন চট্টগ্রাম বিভাগের।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় যারা ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন তাদের মধ্যে বরিশাল বিভাগে ১৯৫ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ১০৪ জন, ঢাকা বিভাগে ২০১ জন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ১৯৮ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ১২১ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৪১ জন, রংপুর বিভাগে ২৩ জন, সিলেট বিভাগে ৯ জন ও রাজশাহী বিভাগে ৮২ জন রয়েছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় ৮৯৮ ডেঙ্গুরোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন। এ নিয়ে চলতি বছর আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে এখন পর্যন্ত ছাড়পত্র পেয়েছেন ৪৭ হাজার ২৫৬ জন। ২০২৪ সালে দেশে মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিল ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন এবং মৃত্যু হয়েছিল ৫৭৫ জনের। এর আগের বছর ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে মারা যান সর্বোচ্চ ১ হাজার ৭০৫ জন এবং আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন।

প্রতিবছর ডেঙ্গুর কারণে মানুষের মৃত্যু কেন থামছে না, এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাবেক একজন অধ্যক্ষ বলেন, ‘দেশে বেশ কয়েক বছর থেকে ডেঙ্গুর প্রার্দুভাব বেশি দেখা যাচ্ছে। এ বছর আক্রান্তের সংখ্যা লাখ অতিক্রম করে গেছে। ডেঙ্গুর কারণে মৃত্যুও থেমে নেই। ডেঙ্গু মোকাবিলায় দেশের স্বাস্থ্য খাত সমন্বিত কোনো উদ্যোগ হাতে নেয়নি। শুধু সিটি করপোরেশন মশা নিধনের কাজ করবে, তা কিন্তু নয়। এর সঙ্গে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, কীটতত্ত্ববিদ, পরিবেশবিদদের সমন্বিতভাবে কাজ করা প্রয়োজন।’

এই অধ্যাপক বলেন, ‘দেশে অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে যেখানে‑সেখানে পানি জমছে। এতে মশার বংশবৃদ্ধি ঠেকানো যাচ্ছে না। অন্যদিকে জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। আমাদের দেশে কিন্তু এখন ছয়টি ঋতু দেখা যায় না। শীতে ঠান্ডা পড়ার কথা থাকলেও আবহাওয়া থাকে উষ্ণ। এই উষ্ণ আবহাওয়ার মশার প্রজনন বাড়ে। এ ক্ষেত্রে জলবায়ুর পরিবর্তনের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।’

কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, অক্টোবর মাস ডেঙ্গু সংক্রমণের সবচেয়ে উপযোগী সময়। এই মাস থেকে প্রতিদিনই সংক্রমণ বাড়বে। কিন্তু এমন আতঙ্ক ও উদ্বেগজনক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকার বিভাগ বা তার সংস্থা সিটি করপোরেশন কী ভূমিকা রাখছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু মূলত বর্ষাকালের রোগ। বাংলাদেশে ২০০০ সাল থেকে ২০২২ সালের মধ্যে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বাড়ে আগস্ট মাসে। কিন্তু ২০২১ সাল থেকে এই দৃশ্যের পরিবর্তন হতে শুরু করে। এখন সেপ্টেম্বর বা অক্টোবর মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি। ২০২২ সালে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ সংক্রমণ হয় অক্টোবর মাসে। এবারও এই মাসে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বৃদ্ধির শঙ্কার কথা জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। জলবায়ু পরির্তনের ফলে এই বছর গত কয়েক সপ্তাহের ব্যাপক পরিমাণে বৃষ্টিপাতের কারণে অক্টোবরে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বাড়বে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলেন, ‘দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে মশক ব্যবস্থাপনা সিস্টেমে এ বছর একটু চেইন অব কমান্ডটা আমরা দুর্বল দেখছি। আরেকটা কারণ হচ্ছে, ডেঙ্গুর রোগী যখন বাড়ে, তখন এটাকে এপিডেমোলজিকেল ট্রায়াঙ্গেলকে ব্রেক বা ভাঙতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশ এই ট্রায়াঙ্গেল থামাতে পারছে না, একইসঙ্গে সেক্টর ব্যবস্থাপনাও করা যাচ্ছে না। ফলে ডেঙ্গুর ব্যাপক সংক্রমণ বাড়ছে।’

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা এ কে এম আরিফ উদ্দিন মনে করেন, মশা নিধনের ব্যর্থতার জন্য সিটি করপোরেশন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সম্মিলিতভাবেই দায়ী। যেমন: যেসব ওষুধ দেওয়া হচ্ছে, সেগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সেগুলো যথাযথভাবে প্রয়োগ হচ্ছে কি না, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। বিক্ষিপ্তভাবে কিছু কীটনাশক ছিটানো ছাড়া সংঘবদ্ধভাবে কোনো কাজ নেই। এই পরিস্থিতি উত্তরণে বর্তমানে খুব দ্রুত কীটতত্ত্ববিদ দিয়ে দল গঠন করে এডিস মশার প্রজননস্থল (বংশবৃদ্ধির হট স্পট) চিহ্নিত করে মশার লার্ভা ধ্বংস করার ব্যবস্থা নিতে হবে। এই কাজে প্রতিটি ওয়ার্ডে কীটতত্ত্ববিদদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের কাজে লাগানো যেতে পারে।

কালের আলো/এমএএইচ/এইচএন