আশায় বসতি

প্রকাশিতঃ 10:40 am | February 28, 2022

প্রভাষ আমিন:

সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে গঠিত হলো নতুন নির্বাচন কমিশন। রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ১১৮৯(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং চারজন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করেছেন। বাংলাদেশের ৫০ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আইনের আলোকে গঠিত হলো নির্বাচন কমিশন। সংসদে পাস হওয়া আইনের আলোকে গঠিত অনুসন্ধান কমিটি প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজের কাছ থেকে পাওয়া ৩২২ জনের নামের তালিকা প্রকাশ করেছিল। তারা শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির কাছে ১০ জনের নামের তালিকা দিয়েছিল। রাষ্ট্রপতি সেখান থেকে পাঁচজনকে নিয়োগ দিয়েছে।

প্রথমবারের মতো আইনের আলোকে গঠিত হলেও ফর্মুলার বাইরে যেতে পারেনি নির্বাচন কমিশন। বাংলাদেশসহ বিশ্বের কোটি মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে বাংলাদেশের আবিষ্কার ওরস্যালাইন। এই ওরস্যালাইন চাইলে ঘরে বসেও বানানো যায়। আধা লিটার ফুটানো পানি ঠান্ডা করে তাতে এক চিমটি লবণ আর এক মুঠো গুড় মিশিয়ে ঘুটা দিলেই হয়ে যায় ওরস্যালাইন। বাংলাদেশের প্রায় সব মানুষ এই ফর্মুলাটি জানে। নির্বাচন কমিশন গঠনের ফর্মুলাটিও সবার জানা। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তিনজন সাবেক সিনিয়র সচিব, একজন সাবেক জেলা ও দায়রা জজ, একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা- ব্যস হয়ে গেলো নির্বাচন কমিশন।

শুরুর দিকে বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশনের নেতৃত্ব দিতেন বিচারপতিরা। বাংলাদেশের প্রথম ছয়জন প্রধান নির্বাচন কমিশনারই বিচারপতি। ১৯৯৬ সালে সপ্তম প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবু হেনাকে দিয়ে নির্বাচন কমিশনে আমলাদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। পরের সাত প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মধ্যে বিচারপতি এম এ আজিজকে বাদ দিলে বাকি সবাই সাবেক আমলা। নবগঠিত নির্বাচন কমিশনে আমলাদের কর্তৃত্ব আরও সুস্পষ্ট হয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ কমিশনের তিনজনই সাবেক সিনিয়র সচিব। তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের শেষটা সিনিয়র সচিব হিসেবে হলেও তার শুরুটা ছিল বিচার বিভাগেই।

সংবিধান অনুযায়ী একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চারজন কমিশনারের সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়। তবে আলোচনা-সমালোচনা সবকিছুর কেন্দ্রে থাকেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। ভালোর কৃতিত্বও তার, মন্দের দায়ও তাকেই বইতে হয়। ব্যতিক্রম ছিলেন মাহবুব তালুকদার। সদ্য সাবেক কমিশনের এই সদস্য পাঁচ বছর ধরেই ভিন্নমত পোষণ করে আলোচনার আলো অনেকটাই নিজের দিকে টেনে নিয়েছিলেন।
এবার নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের পরপরই আমি মজা করে জানতে চাইলাম, এই কমিশনের ‘মাহবুব তালুকদার’ কে? তবে সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি যেহেতু এবারের নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়ার কোনো পর্যায়েই অংশ নেয়নি, তাই এবার কমিশনে তাদের পছন্দের কারও থাকার কোনো সুযোগ ছিল না। তবে দারুণ টুইস্ট হয়ে এসেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার স্বয়ং।

অনুসন্ধান কমিটি প্রাথমিকভাবে ৩২২ জনের নামের তালিকা প্রকাশ করলেও সেই নামগুলো কারা দিয়েছিলেন, তা জানায়নি। তবে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী অনুসন্ধান কমিটির সাথে বৈঠক শেষে তার পছন্দের আটজনের নাম বলেছিলেন গণমাধ্যমে। সেই তালিকায় ছিল নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের নামও। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী কট্টর সরকারিবিরোধী হিসেবে পরিচিত। তাকে সবাই বিএনপির শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবেই চেনেন।

যদিও যৌক্তিক সমালোচনার কারণে ইদানীং বিএনপিও তাকে পছন্দ করেছ না। ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম সংগঠক ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। আওয়ামী লীগ সরকারকে হটাতে তার চেষ্টার অন্ত নেই। সেই জাফরুল্লাহ চৌধুরীর পছন্দের তালিকা থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেয়াওটা অবশ্যই রাজনীতিতে বড় টুইস্ট।

নিজের দেওয়া তালিকা থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বেছে নেওয়ায় সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি বলেছেন, ‘সরকার একটা ভালো কাজ করল। সব বিরোধী দলকে বলব সিইসিকে মেনে নিতে। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাকে চিনি। তিনি খারাপ করবেন না।’ চাকরি জীবনে কাজী হাবিবুল আউয়ালের দৃঢ়তার উদাহরণ দিয়ে জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘সরকার নতুন সিইসির ওপর খুব বেশি প্রভাব খাটাতে পারবে না। কারণ, তার মধ্যে সততা আছে। তিনি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করবেন বলে আমার বিশ্বাস। নির্বাচন কমিশনে আরও যারা আছেন, তাদের নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ভালো কিছু করতে পারলে যে সংকট এখন চলছে, সেই সংকট থেকে হয়তো আমরা বের হতে পারব। তিনি সব বিরোধী দলকে নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে মেনে নিয়ে নির্বাচনে আসার অনুরোধ জানান।’

অনুসন্ধন কমিটির ৩২২ জনের তালিকা এবং জাফরুল্লাহ চৌধুরীর আটজনের তালিকায় নাম থাকলেও কাজী হাবিবুল আউয়াল প্রথান নির্বাচন কমিশনার হওয়ার ব্যাপারে প্রস্তুত ছিলেন এমনটি মনে হয়নি। রাষ্ট্রপতি যখন প্রজ্ঞাপন জারি করেন, তখন তিনি বৈকালিক ভ্রমণে বাইরে ছিলেন। তার ফোনও বন্ধ ছিল। হাঁটা শেষে একা একা ওয়ালসো টাওয়ারের বাসায় ফিরে সাংবাদিকদের কাছ থেকে তিনি প্রথম খবর পান। লিফটের গোড়ায় দাঁড়িয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি, বিএনপির আস্থা অর্জন এবং তাদের নির্বাচনে আনাকেই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি এও উল্লেখ করেন, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান নির্বাচন কমিশনের একার দায়িত্ব নয়। সব স্টেকহোল্ডার মিলেই নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।

প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় কাজী হাবিবুল আউয়াল আসল চ্যালেঞ্জটিই তুলে এনেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও প্রাথমিকভাবে তাকে নিয়ে উচ্ছ্বাসই প্রকাশ করেছে। তার সততা ও দৃঢ় নৈতিক চরিত্রের প্রশংসাই করেছেন সবাই। পরে তার বিরুদ্ধে দুটি অভিযোগ সামনে এসেছে। আইন সচিব পদে তার নিয়োগ অবৈধ ঘোষণা করেছিল উচ্চ আদালত। পরে তাকে ধর্ম সচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তবে আইন সচিব হিসেবে নিয়োগের বৈধতার প্রশ্নটি তার ব্যক্তিগত দায় নয়। নির্বাহী বিভাগের সাথে বিচার বিভাগের দ্বন্দ্বের শিকার হয়েছিলেন তিনি। তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ তিনি সরকারের সুবিধাভোগী। কারণ প্রতিরক্ষা সচিব হিসেবে দুই দফায় তার চাকরির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল।

অনুসন্ধান কমিটির সাথে বৈঠকে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা সরকারের সুবিধাভোগী কাউকে নিয়োগ না দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল। নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে সে পরামর্শ মানা হয়নি। তবে এটা ঠিক আওয়ামী লীগ এক যুগের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায়। এই সময়ে যারা সরকারি চাকরি করেছেন, তারা কোনো না কোনোভাবে সরকারের সুবিধাভোগীই হবেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার হোক, আইনের মাধ্যমে হোক, অনুসন্ধান কমিটি খুঁজে বের করুক; নির্বাচন কমিশন গঠনে এই বাংলাদেশ থেকেই তো লোক নিতে হবে। অনুসন্ধান কমিটি তো মঙ্গলগ্রহ থেকে লোক আনতে পারবে না। ধরে নিলাম, নির্বাচন গঠনের পূর্ণ এখতিয়ার বিএনপিকে দেওয়া হলো। তারা কাদের নিয়োগ দেবে। বাস্তবতা হলো, আমাদের বিদ্যমান বাস্তবতা মেনে নিয়ে সবচেয়ে ভালো কাউকে খুঁজে নিতে হবে। কাজী হাবিবুল আউয়াল সম্পর্কে এখন পর্যন্ত যা ভাবনা, তাতে তাকে নিয়ে একটা চেষ্টা করা যেতে পারে।

কাজী হাবিবুল আউয়াল প্রধান নির্বাচন কমিশনার হওয়ার পর ২০২১ সালের ২৯ আগস্ট প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি সাক্ষাৎকার নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। সে সাক্ষাৎকারে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হওয়া বাঞ্ছনীয়। সংসদে পাতানো নয়, শক্তিশালী বিরোধী দল থাকা বাঞ্ছনীয়। এতে দ্বান্দ্বিকতার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের সুশাসন চর্চা হয়, নিরবচ্ছিন্ন চর্চার মাধ্যমে আদর্শ রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, গণতন্ত্র সুসংহত হয়। রাজনীতিবিদরা আরও প্রাজ্ঞ, বিচক্ষণ ও দায়িত্বশীল হয়ে জনগণের প্রকৃত আস্থা ও শ্রদ্ধাভাজন শাসক হতে পারেন। তৃতীয় শক্তির উদ্ভবের সম্ভাবনা তিরোহিত হয়।’ এই সাক্ষাৎকার যখন দিয়েছেন, তখন তিনি নিশ্চয়ই প্রধান নির্বাচন হওয়ার কথা ভাবেননি। তখন যদি তার এই উপলব্ধি হয়ে থাকে, আশা করি তিনি তার উপলব্ধিতে অটল থাকবেন।

কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের দক্ষতা, যোগ্যতা, সততা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। এখন শুধু চাওয়া তারা আইনের মধ্যে থেকে, সাহসের সাথে, সব দলকে আস্থায় নিয়ে একটি সুষ্ঠু, অবাধ, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন জাতিকে উপহার দেবেন। আমরা শুধু আশায় বুক বাঁধতে পারি।

২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২২