আম্পানে পড়া আমের বিহিত করা জরুরি

প্রকাশিতঃ 4:35 pm | May 22, 2020

অধ্যাপক ড. মোঃ সাইদুর রহমান এবং ড. মোঃ শরফ উদ্দিন:

একে তো করোনার চাপ তার উপর আম্পানের নারকীয় তান্ডব। এ যেন মরার উপর খড়ার ঘা। বাংলাদেশ আজ সত্যিই প্রাকৃতিকভাবে বিপর্যস্ত। সুপার সাইক্লোন আম্পান ৪৬টি জেলার প্রায় ১ লক্ষ ৭৬ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট করেছে এবং ২৬টি জেলায় ঘরবাড়ি, গবাদিপশু ও গাছপালার ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রনালয়ের মাননীয় মন্ত্রী ডাঃ মোঃ এনামুর রহমান জানিয়েছেন যে, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। হাওর এলাকার ধান কাটা সাফল্যজনকভাবে শেষ হলেও আম্পানের প্রভাবে অন্যান্য এলাকার ধান কাটায় কিছুটা বিড়ম্বণায় পড়তে হলো। তবে তাতে খুব বেশি কোন নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না কারণ বেশিরভাগ ধান কাটা শেষ হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন মাননীয় কৃষি মন্ত্রী ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক।

চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে, করোনায় আক্রান্ত হলে তা থেকে রেহাই পাবার মূল হাতিয়ার হলো শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যা দিয়ে করোনাকে পরাজিত করা যায়। এ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাদ্য গ্রহণে ব্যাপক প্রচার চালানো হচ্ছে। বাংলাদেশে নানা ধরণের দেশী ফলমূল রয়েছে যার মধ্যে আম, কলা, আনারস, তরমুজ, পেয়ারা, বড়ই, প্রভৃতি অন্যতম যেগুলো থেকে প্রচুর পরিমাণ পুষ্টি পাওয়া সম্ভব।

বাঙালির নিকট বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মধুমাস হিসেবে পরিচিত। এ মাসে প্রচুর দেশী ফল বাজারে আসবে। তবে সাধারণ মানুষের সবচেয়ে পছন্দের ফল হলো আম যাকে ফলের রাজা বলা হয়। আমে প্রচুর পুষ্টিগুন রয়েছে। প্রতিদিন জনপ্রতি ২০০ গ্রাম করে আম খাওয়ার প্রয়োজন থাকলেও আমরা গ্রহণ করি মাত্র ৮২ গ্রাম। মে মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে পর্যায়ক্রমে বাজারে আসা শুরু হয়েছে সাতক্ষীরা অঞ্চলের গোবিন্দভোগ আম দিয়ে। এর পরই বাজারে আসবে গোপালভোগ, হিমসাগর, খিরসাপাত, ল্যাংড়া, বারি আম-২, ফজলি, বারি আম-৩, বারি আম-৪ এবং আশি^না আম দিয়ে মৌসুম শেষ হবে। সাধারণত দেখা যায় মে থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত ৬০-৭০ ভাগ মৌসুমী ফল বাজারে আসে।

ধারাবাহিক এ প্রক্রিয়ায় বাধা হয়ে দাঁড়াল সুপার সাইক্লোন আম্পান। আমের বাগানে আঘাত হেনে লন্ডভন্ড করে দিল আম বাগান মালিক ও আম ব্যবসায়ীদের স্বপ্ন। অসংখ্য পরিমাণ আধা-পাকা আম ফেলে দিল গাছ থেকে। চাঁপাইনবাবগঞ্ছ, রাজশাহী, নওগাঁ, রংপুর, মেহেরপুর, সাতক্ষীরা এবং পার্বত্য জেলাগুলোসহ ২৩ জেলায় বানিজ্যিকভাবে আম চাষাবাদ হয়ে থাকে এবং উল্লেখিত জেলাগুলোর ৪১,৬৭৬ হেক্টর এলাকায় ১২.৮৮ লক্ষ মেট্রিক টন আম উৎপাদন হয় যার বাজারমূল্য আনুমানিক ১০-১২ হাজার কোটি টাকা (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, ২০১৯)। আম্পানে মোট আম উৎপাদনের প্রায় ১৫-২৫ শতাংশ আগাম ফেলে দিল এবং বেশি ক্ষতি করেছে সাতক্ষীরা, খুলনা ও নাটোর জেলায়। বিবিএস এর মতে আম্পানে পড়া আমের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২.৫ লক্ষ মেট্রিক টন। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অনুমান প্রায় ৪ লক্ষ মেট্রিক টন আম পড়ে গেছে। যার ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ১০০-১৬০ কোটি টাকা। উক্ত আম বাজারজাত করা নিয়ে বাগান মালিক ও আম ব্যবসায়ীরা এখন দিশেহারা এবং উদ্বিগ্ন।

বিভিন্ন জেলায় উৎপাদিত পাকা আম সারা দেশে বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, ফেনী, কুমিল্লায় বাজারজাতকরণ করা হয়ে থাকে। আম উৎপাদনের পর তা সংগ্রহ করে স্থানীয় আড়তে জমা করা হয় এবং সেখান থেকে এজেন্ট বা কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ট্রাক, বাস, ট্রেন, কাভার্ডভ্যান, ভডভডি ও খোলা ভ্যানে করে আমের বাজার তথা বিভিন্ন জেলায় পৌঁছানো হয়। তবে সবচেয়ে বেশি আম পৌছানো হয় রাজধানী ঢাকায়। করোনার কারণে গণপরিবহণ বন্ধ থাকায় ঝরে পড়া আম বাজারজাতকরণে অসুবিধা হচ্ছে। আম প্রক্রিয়াজাত করা বড় বড় কোম্পানী গুলোও (প্রাণ ও এসিআই) করোনার দোহাই দিয়ে আম্পানে পড়া আম ক্রয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। আম প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে না আসলে ব্যক্তি পর্যায়ে উক্ত আমের মাত্র ১০-১৫ শতাংশ দিয়ে আচার, আমসত্ত, আমচুর তৈরি আর কিছু হয়তো তরিতরকারিতে ব্যবহার হবে। বাকী ৮৫-৯০ শতাশ আমই পঁচে যাবে। আর তাই বাগান মালিকদের মাথায় বাজ পরার মতো অবস্থা হয়েছে। এ অবস্থা নিরসনে তারা সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করছে।

এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার যা করতে পারে তা হলো কৃষি মন্ত্রনালয়ের সচিব মহোদয়ের নেতৃত্বে একটি কমিটি করে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ নেয়া। উক্ত কমিটিতে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের একজন মেম্বর-ডিরেক্টর, বাংলাদেশ কৃষি গবেষনা ইনস্টিটিউটের ফল গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক, আম ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধি, আম বাগান মালিক সমিতির প্রতিনিধি, আম প্রক্রিয়াজাতকারীদের প্রতিনিধি, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি সদস্য হিসেবে থাকতে পারেন। উনারা একত্রে বসে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে আম প্রক্রিয়াজতিকারীদেরকে উক্ত আম ক্রয়ের ব্যবস্থা করাতে পারে। কোম্পানীগুলো এ আম ব্যবহার করে আমের জুস, আচার এবং অন্যান্য দ্রব্য প্রদত্ত করতে পারবে। করোনাকালীন এসময়ে আম প্রক্রিয়াজাতকারীদের আম পরিবহণের অনুমতিসহ বাড়তি কোন সুবিধার প্রয়োজন হলে সরকার তাতে সহযোগিতা করতে পারে। প্রতিবছরই কিছু না কিছু প্রাকৃতিক দুর্যোগে আম ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং সেগুলো সংরক্ষণের জন্য স্থানীয় পর্যায়ে কিছুদিন সংরক্ষনের জন্য হিমাগার তৈরি করা যেতে পারে। এবছর বাকি আম শিঘ্রই বাজারে আসবে সেজন্য আম ব্যবসায়ীরা যেন স্বাস্থ্য বিধি মেনে নির্বিঘ্নে আম সংগ্রহ ও পরিবহণ করতে পারে তারজন্য সরকারের আশু ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। এছাড়া আম পরিবহণের গাড়িগুলো চলাচলে অনুমতি দেয়া, আমের আড়ত ও এজেন্ট এবং কুরিয়ার সার্ভিসগুলো চালু রাখার ব্যবস্থা করা আবশ্যক।

অন্যথায় উল্লেখিত জেলাগুলোর ক্ষতিগ্রস্ত বাগান মালিক এবং আম ব্যবসায়ীদেরও বিশেষ প্রণোদনা প্রদানের যৌক্তিক দাবী উঠবে।

লেখকদ্বয়ঃ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ এর কৃষি অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা
কেন্দ্রের ফল বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা।