কঠিন-কোমল মেজাজে আইজিপি

প্রকাশিতঃ 12:02 pm | May 12, 2019

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :

থানাকেই সেবার মূলকেন্দ্রবিন্দুতে রূপ দিতে চান। আস্থা ও বিশ্বাসের এই স্থানে সেবা দিয়েই নিজ বাহিনীর সদস্যদেরই প্রমাণ করতে বলেছেন তাঁরা জনগণের বন্ধু। বিপদগ্রস্ত মানুষকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়ার বার্তাও দিয়েছেন বারবার।

সেবা প্রার্থীদের জন্য বরাবরই ‘নরম পলিমাটি’র মতো মন নিয়েই কথা বলেছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড.মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী, বিপিএম (বার)। বিপরীতে কোন পুলিশ সদস্যের ব্যক্তিগত অপরাধের ‘দায়’ বাহিনী বহন করবে না বলেও অবস্থান পরিস্কার করেছেন।

আরো পড়ুন: কঠোর পথে আইজিপি, মাদক ‘বিপর্যয়’ থেকে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে দেশ?

পুরোপুরি আমলে নিয়েছেন মাদক ব্যবসায়ীর সঙ্গে গুটিকয়েক পুলিশ সদস্যের ‘অবৈধ সম্পর্কের’ অভিযোগও। প্রতিনিয়তই বিশেষ নজর রাখছেন ‘শর্ষেক্ষেতে ভূত’ তাড়ানোতেও। জঙ্গি দমনের মতোই মাদকের বিরুদ্ধেও ‘অল আউট’ অ্যাকশনের আগে এক্ষেত্রেও তদারকি করছেন নিবিড়।

পাশাপাশি সতর্ক করেছেন মাদকের বল্গাহীন ‘পাগলা ঘোড়া’ থামাতে দেশ রক্ষার এ যুদ্ধে ত্রুটিপূর্ণ ধনুকের মতোন অভিযানে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়াকে মেনে না নেওয়ার বিষয়েও। আবার মাদক ব্যবসায়ীরা আত্মসমর্পণ করতে চাইলে তাদের সুযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে নরম হচ্ছেন। পরক্ষণে সুর চড়িয়ে বলেছেন, ‘সুযোগ উপেক্ষা করলেই পরিণত ভয়াবহ।’

পুলিশ প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত কঠিন ও কোমল দু’ ভাষা বা মেজাজেই দেখা গেছে অনেকটাই ‘নিখুঁত’ মানুষ ড.মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারীকে। প্রতিবারই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, মাদক ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘জিরো টলারেন্স’ অবস্থানকে। বলেছেন, ‘যুদ্ধে জয়ী না হওয়া পর্যন্ত মাদক বিরোধী অভিযান।’

আরো পড়ুন: বঙ্গবন্ধু’র ‘স্বপ্নের পুলিশ’ উপহারের মিশনে আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী

মাদকের রাশ সজোরে টেনে ধরার কার্যকর উদ্যোগ নিয়েছে পুলিশ। এর আগে চলেছে বিশেষ সাঁড়াশি অভিযান। এতে মাদক পুরোপুরি বন্ধ না হলেও ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সরবরাহ লাইন বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অতীতে চুনোপুঁটিরা ‘ধরা’ পড়লেও পার পেয়ে যেতো রাঘব বোয়ালরা। ফলশ্রুতিতে প্রশ্ন উঠতো এই ধরা না পড়ার অপার রহস্য নিয়ে।

এখন দিন অনেকটাই বদলেছে। চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারে টেকনাফের সরকার দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির চার ভাইসহ ১০২ জন ইয়াবা কারবারি’র আত্মসমর্পণের ঘটনা ছিলো ‘টক অব দ্যা কান্ট্রি’। সেদিনই তাদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।

মূলত তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারিরা পুলিশের অ্যাকশনে কুলিয়ে উঠতে না পেরেই আত্মসমর্পণের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার আগ্রহ দেখায়। পরে পুলিশের পক্ষ থেকে বিষয়টি সরকারের উচ্চপর্যায়ে জানানো হয়। এতে ‘সবুজ সংকেত’ মেলার পর কক্সবাজারে ঘটা করেই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

সেদিন আত্মসমর্পণকারীদের প্রতি ‘নমনীয় মনোভাব’ নিয়ে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) জাবেদ পাটোয়ারী বলেন, ‘যারা আত্মসমর্পণ করেছেন, তাদের নিশ্চয়তা দেওয়ার জন্য যা যা করণীয়, তা করা হবে, আইনগত সহায়তা দেওয়া হবে তাদের। আইনের মাধ্যমে স্বল্প সময়ে যেন তা নিষ্পন্ন করা যায়, সেই ব্যবস্থাই নেওয়া হবে।’

আরো পড়ুন: জঙ্গি দমনে বিশ্বে ‘নজির’ বাংলাদেশ, বঙ্গকন্যার বিচক্ষণতায় সাফল্যে পুলিশ

এ আত্মসমর্পণের পর নতুন করে ১০ থেকে ১৫ টি জেলায় আরো অনেক মাদক কারবারি একই পথে হাঁটছেন। তাদেরও জোর প্রস্তুতি চলছে আত্মসমর্পণের। কক্সবাজারের সেই অনুষ্ঠানেই দেশের প্রতিটি জেলায় এ রকম আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছিলেন আইজিপি।

এরই ধারাবাহিকতায় কক্সবাজার মডেলকে সামনে রেখে দ্বিতীয় দফাতেও আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়া চলছে। দ্বিতীয় দফার অনুষ্ঠানে যুক্ত হতে পারে বরিশাল, কুমিল্লা, বি-বাড়িয়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, সিলেট, রাজশাহীসহ কয়েকটি জেলার প্রায় দুই সহস্রাধিক মাদক কারবারি।

অনেকে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণের সুযোগকে নিরুৎসাহিত করলেও সাবেক পুলিশ কর্মকর্তারাও বিষয়টির সবিশেষ গুরুত্ব অনুধাবন করেছেন। সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নুরুল হুদা এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘ইয়াবা কারবারিদের সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সুযোগের বিষয়টি ইতিবাচক।

কেউ সুস্থ সমাজে ফিরে আসার সুযোগ চাইলে অবশ্যই তাদের সেই সুযোগ দেওয়া উচিত। আমাদের প্রতিবেশী দেশেও এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে। নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা অনেক অপরাধ নিয়ন্ত্রণে এ পদ্ধতি কার্যকর। আমাদের প্রচলিত আইনেও একই কথা বলা আছে।’

বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের কঠোর মনোভাব আর পুলিশের আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলেই জঙ্গিবাদ দমনে বিশ্বে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। জীবনবাজী রেখে পুলিশ জঙ্গিদের রুখে দেওয়ার পর তাদের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ ‘মাদক নির্মুল’।

পর্যবেক্ষকরাও মেনে নিয়েছেন, প্রথম দিকে জঙ্গিবাদ নির্মুল স্বপ্ন যতটা অবাস্তব শোনাত, মাদকের বেলাতেও এখন তেমনই মনে হচ্ছে। সময়মতোই জঙ্গিবাদের বিষবৃক্ষ সমূলে তুলে ফেলে নিজেদের সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে পুলিশ।

ফলে সারা দেশেই ইয়াবাসহ গোটা মাদক ব্যবসার জাল ধ্বংস করে দেওয়া অসম্ভব নয় মোটেও। তাদের বিশ্বাস, ঝলমলে, সক্রিয়, কর্মঠ এবং দক্ষ কাপ্তান জাবেদ পাটোয়ারী’র নেতৃত্বাধীন পুলিশের পক্ষেই সেটা সম্ভব।

‘মাদক ব্যবসায়ী যে-ই হোক তার সঙ্গে কঠোর আচরণ করা হবে’ পুলিশ প্রধানের কন্ঠে এমন ‘প্রাঁজলতা’ মাদক নির্মুলে পুলিশের সর্বাত্মক ব্যবস্থারই প্রতিধ্বনি।

ঘাপটি মেরে থাকা মাদককারবারিদের মতোই নিজ বাহিনী বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদ্যরাও মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকলে তাদের সঙ্গেও ‘মাদক ব্যবসায়ীদের’ মতো আচরণ করার ঘোষণা দিয়েছেন আইজিপি। মাদক কারবারিরা ‘রাইট ট্র্যাকে’ ফেরার মানসিকতা পোষণ করলে আবার তাদের ‘অভয়’ দিতেও ভুলেননি তিনি।

ড.মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশ্বাস ও আস্থা অর্জনে সর্বাত্মকভাবে কাজ করে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন পুলিশ সদর দপ্তরে নিজের প্রথম সংবাদ সম্মেলনে। বঙ্গবন্ধু জ্যেষ্ঠ কন্যার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে পুলিশের এ আইজি সেদিন বলেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আমাকে বিশ্বাস করে দায়িত্ব দিয়েছেন।

আমি সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করব তার বিশ্বাস এবং আস্থা অর্জন করার।’ ওইদিন প্রধানমন্ত্রী তাকে র‌্যাংক ব্যাচ পরিয়ে দেয়ার সময় মাদক নির্মুলে কাজ করতে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছিলেন।

জঙ্গি, মাদক ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে থাকা পুলিশের পেশাদার এ সর্বোচ্চ কর্মকর্তা থানায় সেবাপ্রার্থী সাধারণ মানুষের মর্মযাতনা উপলব্ধি করে দ্বিধাহীনভাবে নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করে প্রকারান্তরে নিজ বাহিনীর সদস্যদের বুঝিয়ে দিয়েছেন নাগরিক প্রত্যাশার বিষয়টি। বাতলে দিয়েছেন সেবক হিসেবে ভূমিকা রাখার পথও।

সাধারণ মানুষের আবেগ-অনুভূতির সঙ্গে একাত্ন হয়ে, তাদের প্রতি অধিক সংবেদনশীলতা, সহমর্মিতা এবং জনসেবার মূল্যবোধের অধিকারী হয়ে পেশাদারিত্বের সঙ্গেই নিজ বাহিনীর সদস্যদের দায়িত্ব পালন করার কঠোর বার্তাও উচ্চারিত হয়েছে আইজিপির কন্ঠে।

কালের আলো/এইকেআ/এএএমকে

Print Friendly, PDF & Email