বিগো-লাইকির মাধ্যমে মাসে শতকোটি টাকা পাচার
প্রকাশিতঃ 11:53 am | June 14, 2021

অপরাধ সংবাদদাতা, কালের আলো:
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে অপকর্মে জড়িতদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আর এই অভিযানের শুরুতেই উঠে এসেছে ভয়ংকর সব তথ্য।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ভিডিও স্ট্রিমিং অ্যাপ ‘লাইকি’ ও ‘বিগো লাইভ’র মাধ্যমে অবৈধভাবে দেশ থেকে প্রতি মাসে শতকোটি টাকা পাচার হচ্ছে। বিনোদনের আড়ালে হচ্ছে দেহ ব্যবসা। ছড়ানো হচ্ছে আপত্তিকর ভিডিও।
লাইভ ভিডিও স্ট্রিমিং অ্যাপ ‘লাইকি’ ও ‘বিগো লাইভ’-এর ডিজিটাল কয়েনসদৃশ ‘ডায়মন্ড’ বিক্রির মাধ্যমে অবৈধভাবে দেশ থেকে প্রতিমাসে শতকোটি টাকা পাচারের অভিযোগে বিদেশি এক নাগরিকসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তারা হলেন- মোস্তফা সাইফ রেজা, আরিফ হোসেন, এসএম নাজমুল হক, আসমা উল হুসনা সেজুতী এবং এক বিদেশি নাগরিক।
গত দুইদিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, প্রাইভেট কার, বিভিন্ন ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড, বিভিন্ন ব্যাংকের চেক বই ও নগদ টাকা উদ্ধার করা হয়। রবিবার (১৩ জুন) এক সংবাদ সম্মেলন এসব তথ্য জানায় সিআইডির উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) জামিল আহমেদ।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) বলছে, লাইকির বাংলাদেশ শাখার শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাংলাদেশ শাখার শীর্ষস্থানীয় ওই কর্মকর্তা একজন বিদেশি নাগরিক। এরা প্রত্যেকেই দীর্ঘদিন ধরে ‘লাইকি’ ও ‘বিগো লাইভ’ ব্যবহার করে অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছিল।
কর্মকর্তারা বলছেন, শুরুর দিকে অ্যাপস দুটি সামাজিক যোগাযোগ ও বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হতো। কিন্তু এখন ব্যবহার হচ্ছে ভয়ংকর সব অপরাধের প্ল্যাটফরম হিসেবে। তাদের টার্গেট দেশের তরুণ আর যুব সমাজ এবং প্রবাসী বাংলাদেশিরা। তরুণীদের মাধ্যমে তাদের লাইভে আড্ডায় এনে অশ্লীলতায় মেতে ওঠে।
সম্প্রতি ভারতের বেঙ্গালুরুতে বাংলাদেশি এক তরুণীর ওপর চালানো নির্মম যৌন নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর শুরু হয় তোলপাড়। টিকটকে মডেল হিসেবে উপস্থাপনের প্রলোভন দেখিয়ে ওই তরুণীকে ঢাকা থেকে বেঙ্গালুরুতে কার্যত পাচার করা হয়েছিল। এ কান্ডে মারাত্মক সমালোচনা শুরু হয় লাইকি, টিকটক, বিগোর মতো অনলাইন প্ল্যাটফরমগুলো নিয়ে; বিতর্কিত এসব অ্যাপ বন্ধের ওপর গুরুত্বারোপ করে সংশ্লিষ্ট মহল। এর পরই শুরু হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা।
লাইকি ও বিগো দিয়ে যেভাবে অর্থ পাচার
পুলিশ জানায়, গ্রেপ্তার বিদেশি নাগরিক বিগো লাইভ ও লাইকির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। বাংলাদেশি নাগরিক মোস্তফা সাইফ রেজা বিগোর বাংলাদেশি অ্যাডমিন। মো. আরিফ হোসেন বাংলাদেশে বিভিন্ন মেয়েদের মাসিক বেতনে চাকরি দিয়ে বিগো লাইভের সঙ্গে যুক্ত করতেন। এস এম নাজমুল হক ভার্চুয়াল মুদ্রা ডায়মন্ড বিক্রির অন্যতম প্রধান বাংলাদেশি এজেন্ট এবং আসমা উল হুসনা সেঁজুতি বিগো লাইভের প্রধান অ্যাডমিন। অ্যাডমিনরা মাসে ১ লাখ টাকা করে বেতন পেতেন।
বিগো লাইভ ও লাইকিতে সাধারণত দেশের উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণী ও প্রবাসী বাংলাদেশিরা ভিডিও স্ট্রিমিং করে। বিগো লাইভ অ্যাপে দুই ধরনের আইডি রয়েছে। একটি ব্রডকাস্টার আইডি ও অন্যটি সাপোর্টার আইডি বা সেন্ডার আইডি। ব্রডকাস্টার আইডি ব্যবহার করে উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণীরা ভিডিও লাইভ স্ট্রিমিং করে।
এই ভিডিও লাইভ স্ট্রিমিংয়ের মাধ্যমে কথিত বিনোদনের আড়ালে বিভিন্ন ধরনের অশ্লীলতা ছড়িয়ে দেওয়া হতো। এ ছাড়াও সাপোর্টার আইডি বা সেন্ডার আইডির মাধ্যমে যারা ভিডিও স্ট্রিমিং করত, বিনিময়ে তাদের ডিজিটাল কয়েনসদৃশ ডায়মন্ড গিফট করা হতো। পরবর্তীতে এই ডায়মন্ড টাকায় রূপান্তরের মাধ্যমে অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করত। তাদের টার্গেট মূলত দেশের যুব সমাজ এবং বিদেশে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের ডিআইজি জামিল আহমেদ বলেন, ডায়মন্ড সাধারণ ব্যবহারকারীদের মধ্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্য রয়েছে বিভিন্ন নামে বিভিন্ন এজেন্সি। এরকম একাধিক এজেন্ট বাংলাদেশে রয়েছে। এসব এজেন্সির প্রত্যেকের একাধিক পেমেন্ট গেটওয়ে রয়েছে। সাধারণত ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব এজেন্সির বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়। সাধারণ ব্যবহারকারীরা এজেন্সির পেমেন্ট গেটওয়ের মাধ্যমে নির্দিষ্ট পরিমাণের অর্থ প্রদান করে ডায়মন্ড কেনেন।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশি লক্ষাধিক অ্যাপ ব্যবহারকারী ও প্রবাসী বাংলাদেশি অনলাইন ব্যাংকিং, হুন্ডি, ভার্চুয়াল মুদ্রা ও ব্যাংকের মাধ্যমে ডায়মন্ড কিনছেন। বাংলাদেশি এজেন্সিগুলো ডায়মন্ড কিনে আনে বিদেশি অ্যাডমিনদের কাছ থেকে। এসব এজেন্সি বিভিন্ন অবৈধ মাধ্যম ব্যবহার করে বিদেশে অর্থ পাচার করে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে প্রতি মাসে অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হচ্ছে।’
কালের আলো/এমএ/বিএসবি