মুরাদনগরে মা-ছেলে-মেয়েকে হত্যার পরিকল্পনা আগের রাতে
প্রকাশিতঃ 10:24 pm | July 04, 2025

কুমিল্লা প্রতিবেদক, কালের আলো:
কুমিল্লার মুরাদনগরে গণপিটুনিতে একই পরিবারের তিনজনকে হত্যার ঘটনায় আগের দিন রাতে পরিকল্পনা করার খবর পাওয়া গেছে। ওই রাতে একাধিক বৈঠক করার ঘটনা ঘটেছে। বৈঠকে উপস্থিত ও ইন্দনদাতাদের খুঁজছে পুলিশ।
এ খবরে ইতোমধ্যে কড়ইবাড়ী গ্রাম পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে। গ্রেফতার আতঙ্কে এলাকার অধিকাংশ নারী-পুরুষ বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছেন। তবে এখনো কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।
শুক্রবার (৪ জুলাই) বিকালে ময়নাতদন্ত শেষে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। সন্ধ্যার পর পুলিশ পাহারায় তাদের লাশ দাফনের প্রক্রিয়া চলছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্থানীয় স্কুলশিক্ষক রুহুল আমিনের একটি মোবাইল চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেদিনের গণপিটুনির ঘটনার সূত্রপাত। উপজেলার বাঙ্গরা বাজার থানাধীন কড়ইবাড়ী গ্রামের মাদক ব্যবসায়ী রোকসানা বেগম রুবীর মেয়ের জামাই মনির হোসেনের সহযোগী মারুফ মোবাইলটি চুরি করেন। এ ঘটনায় ইউপি চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে মারুফকে ডেকে নেওয়া হয়। সেখানে রুবী ইউপি চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাল এবং ইউপি সদস্য বাচ্চু মিয়াকে মারধর ও কাপড় ছিঁড়ে হেনস্তা করেন। এদিকে মাদক ব্যবসা, মিথ্যা মামলায় হয়রানি এবং নানা অপকর্ম নিয়ে রুবী পরিবারের সঙ্গে দীর্ঘ দুই দশক ধরে বিরোধ চলছিল স্থানীয়দের।
স্থানীয় সূত্র জানায়, এ বিরোধকে কেন্দ্র করে রুবীর প্রতিপক্ষরা সোচ্চার হয়ে ওঠে। বুধবার রাতে গ্রামে একাধিক বৈঠকে মিলিত হয় তারা। মূলত ওই গ্রামের বাছির মিয়াসহ কয়েকজন মিলে এসব বৈঠক ডাকেন। সেখানে রুবীর পরিবারের সবাইকে গণপিটুনিতে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। এতে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে পুরো গ্রামের বাসিন্দারা রুবীর বাড়ির আশপাশে অবস্থান নেয়। দফায় দফায় হাতাহাতি করে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করা হয়। পুরো উত্তেজনা তৈরির নেপথ্যে কাজ করেন বাছির মিয়া গং। পরে কয়েকশ মানুষ একসঙ্গে হয়ে হামলা করা হয়। এ সময় বাড়ির শিশুদের সরিয়ে দেওয়া হয়। পরে পরিকল্পনা অনুযায়ী কিলিং মিশন বাস্তবায়ন করা হয়। তবে হামলায় গুরুতর আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যায় রুবীর অন্য মেয়ে রুমা আক্তার। মুমূর্ষ অবস্থায় তিনি কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
স্থানীয় আলমগীর হোসেন বলেন, আমাদের গ্রামের অধিকাংশ বাড়িঘর এখন নারী-পুরুষশূন্য। গ্রামে বিপুল পরিমাণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঘুরাফেরা করছে। গ্রেফতার আতঙ্কে গ্রামের লোকজন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক নারী বলেন, পুরো ঘটনার নেতৃত্বে ছিলেন এলাকার মৃত বারু মিয়ার ছেলে বাছির মিয়াসহ কয়েকজন। রুবীর পরিবারের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার অভিযোগ তুলে তারা সবাইকে উসকে দেন। এরপরই শুরু হয় হামলা।
নিহত রাসেলের স্ত্রী মীম আক্তার বলেন, মোবাইল ফোন চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করেই পরিকল্পিতভাবে আমার স্বামী, শাশুড়ি এবং ননদকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের আগের রাতে বাছির মিয়ার নেতৃত্বে কয়েকবার বৈঠক করা হয়। এর আগে বুধবার বাছির আমার স্বামীকে কল দিয়ে বলেছিল, আমাদের পুরো পরিবারকে শেষ করে দেবে। তখন রাসেল বলেছেন, পারলে তুই কিছু করিস; কিন্তু আমি স্বপ্নেও ভাবিনি, এমন ঘটনা ঘটবে।
মীম আক্তার বলেন, আগের দিন বুধবার বাগবিতণ্ডা ও হাতাহাতির পর রাসেল আমার বাবার বাড়িতে ছিলেন। সকালে ঝামেলার কথা শুনে তিনি মোটরসাইকেল নিয়ে কড়ইবাড়ি আসেন। বাড়ির কাছে আসতেই তার ওপর হামলা চালানো হয়। ইট দিয়ে থেঁতলে রাসেলকে হত্যা করা হয়। তিনি বারবার বলছিলেন, ‘আমাকে মারিস না, আমার ছোট্ট একটা বাচ্চা আছে।’
মীম দাবি করেন, এ ঘটনায় চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাল, বাচ্চু মেম্বারসহ কয়েকজন মাতব্বরের ইন্ধন থাকতে পারে।
এলাকাবাসীর দাবি, রুবীর পরিবার দুই দশকের বেশি সময় ধরে মাদক কারবারে জড়িত। মাদকের টাকায় তারা ব্যাপক সম্পদ গড়েছেন। পুলিশ বেশ কয়েকবার তাকে গ্রেফতার করলেও জামিনে বের হয়ে আবার মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়েন। তার স্বামী, প্রতিটি সন্তান এবং মেয়ে জামাইও মাদক কারবারে জড়িত। এজন্য এলাকার মানুষ তাদের ওপর ক্ষিপ্ত ছিলেন। এসব বিষয়ে প্রতিবাদ করায় রুবী এলাকার লোকজনের বিরুদ্ধে ৮২টি মামলা দায়ের করেছেন।
সরেজমিন দেখা যায়, রোকসানার ছয়তলা বিশাল বাড়ি। বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে তিনতলা ও একতলা আরও দুটি ভবন রয়েছে। পাশেই একটি দোতলা মার্কেট। সবই তাদের।
কুমিল্লা জেলা পুলিশ ও বাঙ্গরা বাজার থানা-পুলিশের তথ্য বলছে, এখন পর্যন্ত রুবীর বিরুদ্ধে ১৬টি মামলা হয়েছে। ২০১৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি সর্বশেষ তিনি গ্রেফতার হন। এরপর থেকে তিনি জামিনে ছিলেন। এছাড়া তার ছেলে রাসেলের বিরুদ্ধে ৯টি, মেয়ে তাসপিয়া জোনাকির বিরুদ্ধে ৫টি, রুমার বিরুদ্ধে ২টি, তাসপিয়ার স্বামী মনিরের বিরুদ্ধে ১১টি, আরেক মেয়ের স্বামী আমির হামজার বিরুদ্ধে দুটি মাদকের মামলা রয়েছে।
কড়ইবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা বিল্লাল হোসেন অভিযোগ করেন, রুবী মাদক কারবারি। তার কারণে এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ; কিন্তু এভাবে তাদের হত্যা করা হবে- সেটা আমরা বুঝতে পারিনি। আমরা পুরো ঘটনা তদন্ত করে দেখার দাবি জানাচ্ছি।
এ বিষয়ে বাঙ্গরা বাজার থানার ওসি মাহফুজুর রহমান বলেন, এ ঘটনায় ভুক্তভোগী পরিবারের পক্ষ থেকে এখনো এজাহার দেওয়া হয়নি। এখনো কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। আমরা বেশ কিছু মুটিভ নিয়ে কাজ করছি। ঘটনার মাস্টারমাইন্ড এবং ইন্ধনদাতাদের খোঁজ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, শুক্রবার বিকালে ময়নাতদন্ত শেষে নিহতদের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
কালের আলো/এএএন