টিকটক ভিডিও থেকে নারী পাচারের হোতা

প্রকাশিতঃ 3:03 pm | May 30, 2021

নিজস্ব সংবাদদাতা, কালের আলো:

নিজের রুমে দিন-রাত ফেসবুকিং আর টিকটক নির্মাণ নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন ওই যুবক। এক পর্যায়ে হয়ে যান টিকটক সেলিব্রেটি। আর এই টিকটক ভিডিও নির্মাণ করতে গিয়েই নারী পাচারের হোতা হিসেবে নাম লেখিয়েছেন রিফাতুল ইসলাম হৃদয় ওরফে ‘টিকটক হৃদয়’।

স্থানীয় লোকজন ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, টিকটক ভিডিও বানাতে গিয়ে বিভিন্ন বয়সী তরুণীর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়তে থাকে। এজন্য বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গেও তেমন মিশতেন না। অধিকাংশ সময় বাসাতে থেকেই এই অপরাধচক্রের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন ‘টিকটক হৃদয়’।

সম্প্রতি ভারতে এক বাংলাদেশি তরুণী নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে হৃদয়সহ কয়েকজনকে আটক করা হয়। মূলত এরপরই তদন্ত করতে গিয়ে এসব ঘটনা সামনে এসেছে।

পুলিশ সূত্র জানায়, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও ভারতের কয়েকটি রাজ্যের কিছু অপরাধীর সঙ্গে জোট বেঁধে ঢাকায় ‘টিকটক হৃদয়’ গড়ে তুলেছিলেন আন্তর্জাতিক নারীপাচারের শক্ত নেটওয়ার্ক। এই নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ, ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যের দুবাইসহ কয়েকটি দেশে বিস্তৃত।

ফেসবুক, টিকটক আর লাইকিতে পরিচিত হয়ে প্রেমের ছলনা আর চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে কয়েকজন তরুণী ও কিশোরীকে ঘরছাড়া করে অবৈধ পথে বিদেশে নিয়ে বিক্রি করে দিয়েছেন তিনি। টিকটক-লাইকির ভিডিও তৈরির মাধ্যমে আয়ের সুযোগ করে দেওয়ার কথা বলে তাদের ফেসবুক গ্রুপে যুক্ত করে বিভিন্ন দেশে পার্লার, সুপার শপ কিংবা বড় শপিংমলে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করা হয়েছে।

এ বিষয়ে পুলিশের কর্মকর্তারা বলেন, ভুক্তভোগীদের অধিকাংশই দরিদ্র পরিবার থেকে আসা।পাচারের পর নির্যাতন করে ওইসব নারীকে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা হতো।

জানা গেছে, ভারতে যৌন নির্যাতনের শিকার তরুণীর গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জ সদর থানা এলাকায়। দরিদ্র পরিবারের মেয়েটির লেখাপড়া এগিয়েছে মাত্র তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত। ২০১৪ সালে প্রেম করে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের কুয়েত প্রবাসী এক যুবকের সঙ্গে তার বিয়ে হয়।

বিয়ের পর থেকে ওই তরুণীকে শ্বশুরবাড়ির কেউ মেনে না নেওয়ায় তাকে বিভিন্ন সময় শ্বশুরবাড়ির নির্যাতন ও অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। এ কারণে বিয়ের প্রায় পাঁচ বছর পর্যন্ত বাবার বাড়ি ছিলেন তিনি। প্রবাসী স্বামীও কোনো খোঁজখবর নিতেন না। বাবার আর্থিক অনটনের কথা চিন্তা করে ওই তরুণী সৌদি আরব যাওয়ার চিন্তা করেন।

ভুক্তভোগী তরুণীর পরিবারের সদস্যরা জানান, পারিবারিক আর্থিক অনটনের মাঝে ভাগ্য বদলের আশায় সৌদি আরব যাওয়ার জন্য এক দালালকে ৩০ হাজার টাকাও দেন ওই তরুণী। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। এর মাঝে কাউকে কিছু না জানিয়ে-ই মাস কয়েক আগে আকস্মিক নিখোঁজ হন তিনি। তার চার বছরের একটি ছেলে রয়েছে।

জানা যায়, টিকটক হৃদয়ের সঙ্গে ওই তরুণীর পরিচয় হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে। প্রেম-ভালোবাসার পর হৃদয় তাকে ভালো বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে অবৈধভাবে ভারতে পাচার করে। এরপর সেখানে তাকে যৌন ব্যবসা করতে বাধ্য করা হয়।

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. শহিদুল্লাহ সাংবাদিকদের জানান, ‘টিকটক হৃদয় বাবু’ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও ভারতের কয়েকটি রাজ্যের কিছু অপরাধীর সঙ্গে মিলে মানবপাচারের আন্তর্জাতিক চক্র গড়ে তুলেছিল। চক্রটির নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ, ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যের দুবাইসহ কয়েকটি দেশে বিস্তৃত। মূলত পতিতাবৃত্তিতে নিয়োজিত করার উদ্দেশ্যেই বিভিন্ন বয়সের মেয়েদের ভারতে পাচার করত হৃদয়ের চক্র। ভারতের কয়েকটি রাজ্যের কিছু হোটেলের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ছিল চক্রটি। হোটেলগুলোতে চাহিদামতো বিভিন্ন বয়সী মেয়েদের নিয়মিতভাবে সরবরাহ করা হয় বলে তথ্য মিলেছে।

তিনি জানান, এই চক্রের সদস্যরা মূলত স্কুল-কলেজের বখে যাওয়া ছেলে-মেয়েদের টার্গেট করত। বিশেষ করে টিকটক গ্রুপে অন্তর্ভুক্ত করে তারা পাচার কাজে সহযোগিতা করছিল। টিকটক হৃদয় টিকটকের একটি গ্রুপের অ্যাডমিন। সেই গ্রুপের মাধ্যমে ২০২০ সালের শেষের দিকে ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলার একটি রিসোর্টে প্রায় ৮০০ তরুণ-তরুণী পুল পার্টিতে অংশ নেয়।

‘মূলত টিকটক ভিডিও তৈরি করতে গিয়ে তরুণ-তরুণীরা পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত হয়ে একটি ফেসবুক গ্রুপে সংযুক্ত হয়। যে ফেসবুক গ্রুপটির মূল পৃষ্ঠপোষক নারীপাচারের এ আন্তর্জাতিক চক্রটি,’ যোগ করেন পুলিশের এই কর্মকর্তা।

পুলিশ জানায়, চক্রটির মূল আস্তানা হচ্ছে- ভারতের ব্যাঙ্গালুরুর আনন্দপুর এলাকায়। চক্রের সদস্যরা পাচার করা বিভিন্ন বয়সী মেয়েকে ভারতের ব্যাঙ্গালুরুর আনন্দপুরায় নিয়ে যাওয়ার পর কৌশলে নেশাজাতীয় বা মাদকদ্রব্য সেবন করিয়ে বা জোর করে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করা হতো। পরবর্তী সময়ে সেই ভিডিও দেখিয়ে বলা হতো, অবাধ্য হলে বা পালানোর চেষ্টা করলে এসব কুকীর্তির ভিডিও পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।

চক্রটি ভারতের কয়েকটি রাজ্যের কিছু হোটেলের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ। হোটেলগুলোতে চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন বয়সের মেয়েকে নিয়মিতভাবে সরবরাহ করা হয় বলে তথ্য রয়েছে।

পুলিশের ডিসি শহিদুল্লাহ বলেন, ‘টিকটক হৃদয়’ রাজধানীর মগবাজার এলাকার বাসিন্দা। নির্যাতনের শিকার মেয়েটিও ওই এলাকায় থাকতেন। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে হৃদয়। এর পর পড়াশোনা ছেড়ে বন্ধুদের সঙ্গে টিকটক ভিডিও তৈরিতে জড়িয়ে পড়ে।

তিনি জানান, ভারতে গ্রেপ্তার ছয়জনের মধ্যে হৃদয়সহ পাঁচ বাংলাদেশি অবৈধভাবে দেশটিতে অনুপ্রবেশ করেছিল কোনো পাসপোর্ট ছাড়াই। সে ক্ষেত্রে ভিসার প্রশ্ন তো আসে না।

মানবপাচার ও পর্নোগ্রাফি মামলায় এনসিবির মাধ্যমে দ্রুততর সময়ে গ্রেপ্তারদের ভারত থেকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে বলে জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।

কালের আলো/এসজে/এমআরকে