বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার ‘বার্তা’ শান্তির অগ্রসেনাদের; গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ‘আর্মি চিফ’স কনক্লেভ’
প্রকাশিতঃ 10:59 pm | April 11, 2021

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :
বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় আজীবন সংগ্রাম করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছিলেন বিশ্বের মুক্তিকামী, নিপীড়িত, মেহনতি মানুষেরও অবিসংবাদিত নেতা। বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদানের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পেয়েছিলেন। তাঁরই নির্দেশে বাঙালি জাতি ঝাঁপিয়ে পড়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে।
সেই মুক্তি সংগ্রামে একাত্ন হয়ে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল দেশপ্রেমিক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শহীদ বীর সেনারাও। অভ্যুদয় হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের। হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙা দেশটি এখন পালন করছে মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী।
একই সঙ্গে সংগ্রামে সিদ্ধপুরুষ পিতা মুজিবের জন্মশতবার্ষিকীর শুভক্ষণে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতির পিতার অবদানকে চিরস্মরণীয় করে রাখতেই এবার বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আয়োজন করেছে বহুজাতিক সামরিক অনুশীলন ‘শান্তির অগ্রসেনা’।
বিশ্ব পরিমন্ডলেও বাঙালিত্বের মহান সাধককে এরই মাধ্যমে আবারও যেন বিশ্ব শান্তির উজ্জ্বল প্রতিভূরূপেই উপস্থাপন করেছেন দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতীক বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। ‘শক্তিশালী শান্তিরক্ষা কার্যক্রম’ স্লোগানে বহুজাতিক সামরিক অনুশীলনের অংশ হিসেবে ঢাকা সেনানিবাসের মাল্টিপারপাস কমপ্লেক্সে রোববার (১১ এপ্রিল) দেশি-বিদেশি সামরিক এবং বেসামরিক ব্যক্তিদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘আর্মি চিফ’স কনক্লেভ’ শীর্ষক সেমিনার।
‘বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের সময়ে শান্তিরক্ষাই বড় চ্যালেঞ্জ’-এমন গুরুত্বপূর্ণ ভাষ্যই উঠে এসেছে বহুজাতিক এই সেমিনার থেকেই। আবার শুধু সংঘাতপূর্ণ এলাকায় নয়, বাংলাদেশ পুরো বিশ্বেই শান্তির সংস্কৃতি ছড়িয়ে দিতে চায় এমন গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন।

আলোচনায় কি-নোট স্পিকার হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ড.আজিজ আহমেদ, ভারতের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এম এম নারাভানে, ভুটান সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ অপারেশন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল দরজি রিনচেন, ফোর্স কমান্ডার ইউনাইটেডন্যাশন স্মালটি ডাইমেনশনাল ইন্টিগ্রেটেড স্ট্যাবিলাইজেশন মিশন ইন মালি লেফটেন্যান্ট জেনারেল ডেনিস জিলেনসপোরে এবং ফোর্স কমান্ডার ইউনাইটেড ন্যাশনস মালটি ডাইমেনশনাল ইন্টিগ্রেটেড স্ট্যাবিলাইজেশন মিশন ইন দ্যা সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিজিয়ন লেফটেন্যান্ট জেনারেল সিদকি ড্যানিয়েল ত্রাওর।
শান্তিরক্ষা অপারেশন নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য জেনারেল আজিজ আহমেদের
সেমিনারে কি-নোট স্পিকার হিসেবে তাৎপর্যপূর্ণ এক বক্তব্যই উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ড.আজিজ আহমেদ। অরাষ্ট্রীয় শক্তির উত্থানে শান্তিরক্ষা অপারেশন জটিল হয়ে পড়েছে, এমন রুঢ় বাস্তবতার কথা যেমন বলেছেন তেমনি দিয়েছেন একটি সুসংবাদও।
জাতিসংঘ মিশনে শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে আবারও শীর্ষস্থান দখল করেছে বাংলাদেশ, স্বাধীনতার ৫০ বছরে এই অর্জন অসামান্য। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র, রাজনৈতিক মতাদর্শ ও আঞ্চলিক বৈষম্য পেছনে ফেলে বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীরা নিজেদের উৎসর্গ করেছেন বিশ্বমানবতার সেবায়।

প্রায় দুই হাজার নারী শান্তিরক্ষী এরই মধ্যে বিভিন্ন সংঘাতপূর্ণ দেশে সাফল্যের সঙ্গেই তাদের দায়িত্ব পালন সম্পন্ন করেছেন। ২০২২ সাল নাগাদ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে নারী সদস্য আরও বাড়াবে বাংলাদেশ-এমন শুভ সংবাদ দিয়েছেন সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ।
বাংলাদেশের সেনাপ্রধান বলেন, ‘অরাষ্ট্রীয় শক্তির উত্থান, অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, রাজনৈতিক সঙ্কট এবং পরিবর্তনশীল ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-কৌশলগত অবস্থানের কারণে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা অপারেশন ক্রমশই চ্যালেঞ্জিং এবং জটিল হয়ে পড়ছে। তাই বর্তমান সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যুগোপযোগী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শান্তিরক্ষীদের সক্ষমতা বৃদ্ধি, কমিউনিটি-বেজড ইনফর্মেশন শেয়ারিং, উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার, জাতিসংঘ সনদের পরিমার্জন এবং প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো তৈরি করা জরুরি।’
বিশ্ব শান্তিরক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বাংলাদেশ
সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় বিশ্বব্যাপী শান্তিও স্থিতিশীলতা রক্ষায় বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতির কথা তুলে ধরেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন। তিনি বলেন, ‘উন্নত প্রযুক্তি ও অত্যাধুনিক অস্ত্রের ব্যবহার, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিরূপ প্রয়োগ এবং চলমান বৈশ্বিক মহামারীর কারণে শান্তিরক্ষার প্রকৃতি রূপান্তরিত হয়েছে। এই নজিরবিহীন বৈশ্বিক মহামারীর ফলে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় উদ্ভূত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় অর্থবহ পারস্পরিক সহযোগিতা, নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্য সম্পর্কিত জরুরি অবস্থার উন্নয়ন প্রয়োজন।’

কী বলেছেন ভারতের সেনাপ্রধান?
সেমিনারে ভারতের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মনোজ মুকুন্দ নাভারানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের উদীয়মান চ্যালেঞ্জসমূহ এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার কিভাবে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনসমূহকে অত্যন্ত কঠিন এবং চ্যালেঞ্জিং করে তুলেছে-এমন মন্তব্য করেন।
কীভাবে যুদ্ধাঞ্চলগুলোতে সংঘাতের গতি প্রকৃতি ভিন্ন বলয়ে প্রবাহিত হচ্ছে সে বিষয়ে তিনি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সশস্ত্র দলগুলো কীভাবে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে সে বিষয়গুলোও তিনি তার বক্তব্যে উপস্থাপন করেন।
জেনারেল মনোজ মুকুন্দ নাভারানে বর্তমানে শান্তিরক্ষীরা কি ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে তা তুলে ধরে এই চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবেলায় অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে শান্তিরক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা, জাতিসংঘের মতবাদে নমনীয়তা, উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার, যথোপযুক্ত লজিস্টিকস সহায়তা এবং জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাজেট বৃদ্ধির উপর গুরুত্বারোপ করেন।

বৈশ্বিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকায় এই সেমিনার
সেমিনারে নৌ ও বিমান বাহিনীর এবং বাংলাদেশ পুলিশের বিভিন্ন উর্ধতন কর্মকর্ত, কুটনৈতিক ও জ্যেষ্ঠ সম্পাদক ও সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন। সেমিনারে অংশগ্রহণকারীরা এবং অতিথিরা আগামী দিনগুলোতে বিশ্বে বিভিন্ন সংঘর্ষ মোকাবেলায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীদের ভূমিকা এবং বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়ে মতবিনিময় করেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের অন্যতম প্রধান সহযোগি দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উদ্যোগে আয়োজিত এই সেমিনার ভবিষ্যতে বৈশ্বিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করবে বলেও বক্তারা দৃঢ়ভাবে আশাবাদী।

কালের আলো/আরআইএ/এমএএএমকে