ভ্যাকসিন আসছে কিন্তু আপনি কি করছেন?
প্রকাশিতঃ 10:33 am | December 24, 2020

ডা. পলাশ বসু :
শীতের সময় করোনার বিস্তার বাড়বে বলে ধারণা করা হয়েছিলো। সে বিস্তাররোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কথা বারবার করে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। মাস্ক পরিধানে বাধ্যবাধকতা আরোপের জন্য মাস্ক না পরলে জরিমানাও করা হচ্ছে। ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’ বিধি প্রতিপালনের জন্য সরকারি ও বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। ফলে শীতের শুরুতেই করোনা পরিস্থিতি হঠাৎ অবনতির দিকে গেলেও এখন সে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। একই সাথে বেদনার সাথে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে , মাস্ক পরিধানে আবার একটা ঢিলেমি ভাব শুরু হয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে পরিস্থিতি খারাপ হতে সময় লাগবে না কিন্তু।
ধরে নেয়া যায় আরো প্রায় ২ মাস শীত থাকবে। ঢাকায় হয়ত কিছুটা কম সময় শীতকাল উপলব্ধি করা যায়।তবে এ সময়ে ঢাকার বাতাস ভয়াবহ হারে দুষিত হয়ে থাকে। শীতের শুষ্ক বাতাসের সাথে ঢাকায় অপরিকল্পিত উন্নয়ন কাজের জন্য বাতাসে দুষনের মাত্রা আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে থাকে। আবার এ সময়ে হিমালয় থেকে আসা উত্তরী বাতাসের বেগ কম থাকায় বাতাসে ভেসে থাকা ধূলিকণা স্থানান্তরিত হতে পারে না। ফলে বাতাসে দূষণের মাত্রা একবার বেড়ে গেলে তা আর সহসা কমে না। সম্প্রতি ঢাকার বাতাসের গুণগত মান সবচেয়ে খারাপ হয়েছে বলে সূচক বলছে। এমনিতেই শীতকালে শুষ্ক বাতাসের জন্য শ্বাসকষ্টে ভোগা রোগীদের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। তার উপরে যদি বাতাস দূষিত হয়ে গেলে অবস্থা হয় যেন ‘সেরের উপর সোয়া সের’ এর মতো। এর সাথে যোগ করুন মহামারি করোনাকে। তাহলেই শ্বাসকষ্টে ভোগা রোগীদের আতঙ্ক ও আশঙ্কা কিছুটা হলেও বুঝতে পারবেন।
করোনার ভ্যাকসিন এরই মধ্যে আমেরিকা, ইংল্যান্ডে দেয়া শুরু হয়ে গেছে। কানাডাও সেই পথেই আছে। সম্প্রতি আমাদের এশিয়া অঞ্চলের দেশ মডার্নার এ ভ্যাকসিন দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। আমরা আগেই অবশ্য আস্ট্রেজেনেকার ভ্যাকসিন নেয়ার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছি।অন্য উৎস থেকেও নেয়ার কথা চলমান আছে। আস্ট্রেজেনেকার ভ্যাকসিনের যে দিকটা ভালো সেটা হচ্ছে এটা ফ্রিজের তাপমাত্রায়ই ভালো থাকে। ফলে এর পরিবহন ও বিপণন করা সহজ। টিকার সক্ষমতা তাতে ঠিক থাকে। কিন্তু মডার্নার ভ্যাকসিন পরিবহন ও বিপণন জটিল। কারণ এটা মাইনাস ৭০ ডিগ্রিতে সংরক্ষণ করতে হয়। উন্নত বিশ্বের দেশেগুলোর জন্যও কাজটা কঠিন। আর তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য সংগত কারণেই তা অনেকটাই দুরূহ বিষয়। ফলে আমাদের জন্য শেষ বিচারে আস্ট্রেজেনেকার ভ্যাকসিনই লাগসই বলে বিবেচিত হবে বলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে।
ঠিক কবে নাগাদ ভ্যাকসিন দেশে আসবে সেটা নিয়ে কোন সুস্পষ্ট কোনো ঘোষণা এখনও আসেনি। কারণ ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউট এখনও উৎপাদন শুরু করেনি। তবে আশা করা যায় অচিরেই সেটা শুরু হবে। তবে, মনে রাখতে হবে ভ্যাকসিন দেয়াটাই বোধ হয় শেষ কথা হবে না। কারণ আমাদের দেশের মতো জনবহুল দেশে একসাথে এত লোককে ভ্যাকসিন দেয় সম্ভবপর হবে না। বস্তুত কোন দেশই তা পারছে না। ফলে কারা আগে ভ্যাকসিন পাবে এর জন্য একটা গাইডলাইন তৈরি হবে আগে। তারপর বিষয়টা পরিষ্কার হবে। যেটা বলছিলাম যে ভ্যাকসিন দেয়াটাই বোধ হয় শেষ কথা হবে না। কারণ এক. সবাই একসাথে ভ্যাকসিন পাবে না। পাবে ধাপে ধাপে। দুই. ভ্যাকসিন নিলে তা কতদিন শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করবে সেটাও অজানা।
আর তিন. এটা দীর্ঘমেয়াদে শরীরে কোনো খারাপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে কিনা সেটা নিয়েও একটা উদ্বেগ রয়ে গেছে। এমনিতেই ভ্যাকসিন নিয়ে নানাধরনের গুজব, সত্য-মিথ্যা পৃথিবীব্যাপী শোনা যায়। এসব প্রপাগান্ডায় কান না দিয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ এবং স্ব স্ব দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর কি বলছে সেটা খেয়াল করুন। তাহলেই আপনি সঠিক তথ্য জানতে পারবেন। অহেতুক ইউটিউবে দেয়া কোন বক্তব্য বা ফেসবুকে কারো দেয়া, শেয়ার হওয়া কোন তথ্যকে বিচার না করে বিশ্বাস ও প্রচার করবেন না। এতে সার্বিক প্রক্রিয়াটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শেষ বিচারে তাতে ক্ষতি কিন্তু আমাদেরই হবে।
শেষ কথা বলব, করোনার মতো ছোঁয়াছে রোগকে নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে সবার আগে আমাদেরকে সচেতন হতে হবে। এজন্য স্বাস্থ্যবিধি মানার কোন বিকল্প নেই। ঘরের বাইরে গেলে অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে। আর হাতটাকে পরিষ্কার রাখতে হবে। হাত প্রয়োজন মতো সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলুন বা স্যানিটাইজ করুন। এ দুটো সহজ বিষয় মেনে চলুন। আমি, আপনি, আমরা সবাই যদি মাস্ক পরি তাহলেই কিন্তু করোনার বিস্তার রোধ করা খুব সহজেই সম্ভবপর হবে। একবার ভাবুন তো, হাসপাতালে চিকিৎসক, নার্স এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরা ঘন্টার পর ঘন্টা কিভাবে মাস্ক, পিপিই পরে রোগীদেরকে সেবা দিয়ে থাকেন! এ সময়ে কিন্তু তারা না পারেন বাথরুমে যেতে, না পারেন একটু পানি পান করতে! আর সেখানে আমরা সামান্য মাস্ক পরেই থাকতে এত অনীহা দেখাচ্ছি কেন?
উপরন্তু মাস্ক পরতে বললে অনেকেই বলেন- আরে! মাস্ক পরে কি হবে! রোগ হলে এমনিই হবে!এসব মাস্ক পরে কাজ হবে না।বেশ ভালো কথা! তাহলে এই প্রশ্নটির উত্তর দিন তো- হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হলে মনের মতো সেবা না পেলে অথবা মৃত্যু হলে এত হৈ চৈ করছি কেন আমরা? ভবিতব্যকে যখন আগেই মেনে নিয়েছেন তখন তার পরিণামকে মেনে নিতে কষ্ট হবে কেন, বলুন তো? মনে রাখতে হবে, আমরা যা করব, যেভাবে করব তার প্রায়শ্চিত্তটাও আমাদেরকে সেভাবেই করতে হবে। এখন আপনিই ভাবুন- স্বাস্থ্যবিধি না মেনে নিজের, পরিবারের ও অন্যজনের অসুস্থতা, ভোগান্তি এবং সর্বোপরি মৃত্যুর কারণ হবেন নাকি সবার জন্য সুস্থতার বার্তা নিয়ে আসবেন! কারণ এক যাত্রায় তো আর দুই ফল ফলে না!
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ এনাম মেডিকেল কলেজ।